সিঙ্গাপুর ট্যুর

যে দলের প্রধান নেতা খালেদা জিয়া দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, সে দলের শীর্ষ নেতারা চিকিৎসা বিলাসিতা করছেন সিঙ্গাপুরে গিয়ে। প্রথমে সপরিবারে খন্দকার মোশাররফ, তারপর মির্জা ফখরুল দম্পতি এবং সর্বশেষ মির্জা আব্বাস দম্পতি গেলেন সিঙ্গাপুরে। তাও আবার কয়েকদিনের ব্যবধানে। হঠাৎ বিএনপির শীর্ষ তিন নেতা একইসময়ে একই জায়গায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, বিষয়টা বাড়াবাড়ি রকমের কাকতালীয় নয়? এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে গুঞ্জন। জানা গেছে, আব্বাসের পেটে সমস্যা, ফখরুলের গলায় ব্যথা, মোশাররফের মাথায় সমস্যা- এসব নিয়ে তারা সিঙ্গাপুরে গিয়ে মিলিত হয়েছেন। আসলেই কি তারা সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন নাকি দেশবিরোধী নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন?

এর আগেও পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র এজেন্ট মেহমুদ-এর সাথে কয়েকদফা গোপন বৈঠকের রেকর্ড আছে মোশাররফের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে মক্কায় তাদের গোপন বৈঠকের ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেই ফোনালাপে বিএনপির নেতাদের সাথে আইএসআই’র পূর্বেকার বৈঠকগুলোর কথাও ফাঁস হয়; জানা যায় ব্যাংককসহ আরও কয়েকটি দেশে পাকিস্থানি গোয়েন্দাদের বৈঠকের খবর। ২০১৭ সালে খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্য সফরে আইএসআই’র দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে বৈঠক হয়। সেসময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাকিস্থানের সহযোগিতা চান খালেদা। নির্বাচনে পাকিস্থান প্রতিশ্রুত সাহায্য করে বিএনপিকে। বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেয়। বিনিময়ে পাকিস্থানের পছন্দনীয় কয়েকজনকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য বিএনপির হাতে তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়, যারা পাকিস্থানের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে নির্বাচিত হলে। এসব তথ্য পরে ফাঁস হয়।

পাকিস্থানসহ বাংলাদেশবিরোধী কয়েকটি পক্ষের সাথে বিএনপির এমন ষড়যন্ত্র ও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের খবর এবং ফোনালাপ বিভিন্ন সময় ফাঁস হয়েছে। পরিকল্পনার খবর, কখনো গোপন বৈঠকের ছবি বা নানান তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসায় গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি গোপন বৈঠকের ক্ষেত্রে স্থান পরিবর্তন করেছে। ব্যাংকক, দুবাই ও মালয়েশিয়া ছিল তাদের পছন্দের স্থান, যা গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে দেখা যায়। তবে এসব দেশে সম্প্রতি বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় এখন বিকল্প বেছে নিয়েছে বিএনপি। সিঙ্গাপুরকে তাই ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান সূতিকাগার ভাবা হচ্ছে। হঠাৎ সেখানে বিএনপির ৩ নেতার একসাথে অসুস্থতাজনিত কারণে সম্মেলন- এই সন্দেহের আগুনকে উস্কে দিচ্ছে।

[বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হঠাৎ সিঙ্গাপুর ট্যুর : চিকিৎসা নাকি দেশবিরোধী চক্রান্ত?]

সিঙ্গাপুর বহুদিন ধরেই বিএনপির জন্য অন্যতম অনুকূল স্থান। তারেক রহমান ও কোকোর অর্থপাচারের অন্যতম প্রধান র‌্যুট সিঙ্গাপুর। সেখানকার কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আটকে দিয়ে তাদের পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরিয়ে এনেছিল বর্তমান সরকার। শুধু খালেদার দুই পুত্র নয়, গত বছর বিএনপির আরেক নেতা, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পাচারকৃত সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার হদিস পাওয়া যায়। সেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ করে দেয় সিঙ্গাপুর সরকার বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে।

কেবলমাত্র অর্থ গচ্ছিত রাখা নয়, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মুদ্রা পাচার এবং অফশোরে বিভিন্ন বেনামী খাতে বিনিয়োগের নামে কালো টাকা সাদা করার জন্য এখান থেকেই ফান্ড ট্রান্সফার করেছিল বিএনপির অনেক নেতা। যাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং তার পরিবারের সদস্যদের নাম উল্লেখযোগ্য। যাদের নাম প্যান্ডোরা, পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছিল।

অর্থপাচারসহ মানি লন্ডারিংয়ের যত কেলেঙ্কারির খবর পাওয়া যায় বিএনপি নেতাদের নামে, তাদের বেশিরভাগই সিঙ্গাপুর কানেক্টেড। কেউ কেউ সেখানকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছেন, কেউ আবার সেখানকার কনসালটেন্সি ফার্মগুলোর সহায়তা নিয়েছেন। যাদের মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের কালো টাকা কয়েকটি হাত ঘুরিয়ে এনে সাদা করা হয়েছে। তবে শুধু ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম নয়, ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়াদের সাথে বৈঠকের ক্ষেত্রে দুবাই ও মালয়েশিয়ার পর সিঙ্গাপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। নেতারা ছাড়াও এই সিঙ্গাপুরেরই মারিনা বে-তে খালেদা-ফালুর ভিডিওর ফুটেজ ফাঁস হয়েছিল।

এবারের এই ট্যুর সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে ফখরুল ও মোশাররফের বহুবার আসা-যাওয়ায় গোপন বৈঠকের জন্য এই দেশকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, তারেকের প্রতিনিধি হিসেবে এখনও আইএসআই’র সাথে লিয়াঁজো বজায় রাখেন মোশাররফ। তবে বয়স হয়ে যাওয়ায় এবার সিঙ্গাপুর সফরে তার সহযাত্রী হয়েছেন তার পুত্র, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার মারুফ হোসেন। পিতা-পুত্র আবারও বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তে আইএসআই এজেন্টদের সাথে বৈঠক করছেন- এমন ধারণা বিশ্লেষকদের।

[বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হঠাৎ সিঙ্গাপুর ট্যুর : চিকিৎসা নাকি দেশবিরোধী চক্রান্ত?]

ফখরুল ও আব্বাস পরিবারের আগেই সিঙ্গাপুরে পৌঁছেছেন মোশাররফ পরিবার। দলের দুই দাতা এবং ধনী হিসেবে পরিচিত মিন্টু এবং আব্বাস। ধারণা করা হচ্ছে, নয়া ষড়যন্ত্রের ফাইন্যান্সার হিসেবে আব্বাস এই ট্যুরে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনার সমন্বয়ক হিসেবে ফখরুল সম্পৃক্ত বাকি দুজনের সাথে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এই হিসাব-নিকাশ উড়িয়ে দেয়া যায় না। নির্বাচনের আগে তিন নেতার একইসাথে অসুস্থতা এবং একই জায়গায় চিকিৎসার সফরকে গোয়েন্দা সংস্থা নজরে রেখেছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে একটি বিশেষ দল সিঙ্গাপুরে বিএনপি নেতাদের ওপর নজরদারি করছেন। তাই দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের জাল যেন বুনতে না পারে কেউ, সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ রাজনৈতিক মহলের।

আরও পড়ুনঃ