খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য মানবিকতার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে মানবিক রাজনীতির উর্ধ্বে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে হবে। এই মানবিক দৃষ্টি দেখিয়ে খালেদা জিয়াকে যেন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয় সেজন্য শুধু বিএনপি নয় বিভিন্ন সুশীল মহলের দাবি জানাচ্ছে।

কিন্তু মানবিকতার প্রশ্ন যখন আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই আসে যে খালেদা জিয়া নিজে কতটা মানবিক ছিলেন? ১০ বছর তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেসময় তিনি দেশের রাজনীতিতে এবং জনগণের সাথে কতটুকু মানবিক আচরণ করেছিলেন?

খালেদা জিয়ার ১০ বছরের শাসনামলে ১০টি বহুল আলোচিত অমানবিকতার ইতিহাস তুলে ধরা হলো:

১. ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা: ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সুস্পষ্টভাবে ছিল বিএনপি-জামায়াতের এক মাস্টারপ্ল্যান। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা এবং শেখ হাসিনাকে চিরতরে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য গ্রেনেড হামলার এই ঘৃণ্য ঘটনা হয়েছিল। এটি আজ আদালতের রায়ে প্রমাণিত।

খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আদালতের রায়ে দেখা যায়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিল সে সময়। খালেদা জিয়া এই গ্রেনেড হামলার পর ন্যূনতম দুঃখ প্রকাশ করেননি বরং তিনি তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা ‘ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন’ এমন উদ্ভট, অমানবিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছিলেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, বিশ্বের যে কোন দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলোর আলোকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দলের ওপর চালানো নৃশংসতা ও অমানবিকতার এক জঘন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে।

[খালেদা জিয়ার বহুল আলোচিত ১০টি অমানবিকতার ইতিহাস]

২. ১৫ আগস্টের ভুয়া জন্মদিন পালন: ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার বিয়োগান্তক দিন। এই দিনে ভুয়া জন্মদিন পালন করেছিলেন খালেদা জিয়া। এবং শুধু ভুয়া জন্মদিন পালন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, ভুয়া জন্মদিনের তিনি বড় বড় কেক কাটার উৎসব করেছিলেন যেন শোকের আবহ নষ্ট হয়।

একজন মানুষ কতটা অমানবিক হলে রাষ্ট্রের স্থপতির শাহাদাৎ দিবসে ভুয়া জন্মদিনের উৎসব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জানজুয়ার সাথে স্বেচ্ছায় থেকে যাওয়ার কারণে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়াকে গ্রহণ করেননি তার স্বামী জিয়াউর রহমান।

বঙ্গবন্ধু নিজের মেয়ে বলে স্বীকৃতি দেয়ায় সেই খালেদা জিয়াকে গ্রহণ করে জিয়া। আর তার প্রতিদান খালেদা জিয়া দিয়েছেন ১৫ আগস্টে কেক কেটে! এটিই খালেদা জিয়ার অমানবিকতার আরেকটি উদাহরণ।

৩. অক্টোবরের নির্বাচনের পর সারাদেশে তান্ডব: ২০০১ এর অক্টোবরের সেই ম্যানিপুলেটেড নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয় বিএনপি-জামায়াত। এই বিজয়ের পর পরই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সারাদেশে তাণ্ডব, শুরু করে।

আরো পড়ুনঃ নির্দয়-নৃশংস খালেদার প্রতি আর কতো মানবিক হবে সরকার?

বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং ভোটারদেরকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য সশস্ত্র হামলা, আক্রমণ, লুটপাট, দেশত্যাগে বাধ্য করা, ধ-র্ষণ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। বাংলাদেশের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ইতিহাসে একটি এটি একটি নৃশংস বড় ঘটনা।

৪. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের অস্বীকৃতি: ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল সপরিবারে হত্যাই করা হয়নি বরং এই হত্যাকাণ্ডের যেন বিচার না হয় সেজন্য বিচারের পথরুদ্ধ করেছিলেন খুনি মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন শপথ নেন তখন তার সামনে সুযোগ এসেছিল এই কালো আইনটি বাতিল করার। আওয়ামী লীগ এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এর জন্য বিল এনেছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে অস্বীকৃতি জানান। এটি অমানবিকতার আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

৫. যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করা: বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়া দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াত এবং দলের নেতাদেরকে পাশে নিয়েই ২০০১ এর মন্ত্রীসভায় বসেন খালেদা জিয়া। রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী এবং রাজাকার আলী আহসান মুজাহিদের মত নরঘাতকদেরকে মন্ত্রী বানানো ছিল মানবতার বিরুদ্ধে এক ধরনের অপরাধ।

৩০ লাখ শহিদ এবং ৬-৮ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই রক্তস্নাত পবিত্র বাংলার মাটিতে এই দেশের পতাকা ওড়ানো গাড়িতে চড়ে বেড়িয়েছে তারা। খালেদা জিয়ার অমানবিক কর্মকাণ্ডের এটি আরেক দৃষ্টান্ত।

৬. ১৯৭৫ এর খুনিদের চাকরিতে বহাল: জাতির পিতার হত্যাকারীদেরকে কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে পুরো জাতিকে কলঙ্কিত করেছিলেন খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান। আর সেই কলঙ্কের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন খালেদা জিয়া স্বয়ং। তিনি কেবল খুনিদের চাকরি বহাল রাখেননি বরং তাদেরকে পদোন্নতিও দিয়েছেন।

খালেদা জিয়ার প্রশ্রয়েই খুনিরা সারাদেশে আস্ফালন করে বেড়িয়েছে। এমনকি তারা ভরা জনসভায় দম্ভের সাথে বলেছিল- মুজিবকে হত্যা করেছি, কেউ আমার বা** ছিঁড়তে পারেনি! এর চেয়ে অমানবিক কান্ড আর কী হতে পারে!

৭. ১৯৭৫ এর খুনিদেরকে সংসদে নিয়ে আসা: খালেদা জিয়া জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকে সংসদে নিয়ে আসেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে খুনিদেরকে নির্বাচিত করিয়ে আনেন তিনি।

খালেদা জিয়ার কল্যাণে জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকে জাতীয় সংসদে বসিয়ে পবিত্র সংসদের অবমাননা করেছিলেন। এটাও একটি অমানবিকতার একটি উদাহরণ।

৮. বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার বন্ধ: ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করে। এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে। গদিতে বসেই খালেদা স্ব-উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির পথ বন্ধ করে দেন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তার আত্মজীবনীমূলক লেখায় এ ব্যাপারে নিজের দুঃখ এবং ক্ষোভের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।

৯. শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকান্ড: শাহ এ এম এস কিবরিয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ডিপ্লোম্যাট এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী ছিলেন। হবিগঞ্জের এক জনসভায় বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড হামলা চালায়। একইসাথে নির্বিচারে গুলি চালায়।

শাহ এ এম এস কিবরিয়া যখন সন্ত্রাসীদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন তখন সরকারের কাছে একটি হেলিকপ্টার চাওয়া হয়েছিল। হবিগঞ্জে সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। তাই গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু খালেদা জিয়া হেলিকপ্টার দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। ফলাফল- জাতি হারায় একজন সূর্যসন্তানকে।

১০. আওয়ামী লীগ নেতা আহসানুল্লাহ মাস্টারকে হত্যা: আওয়ামী লীগের নেতা আহসানুল্লাহ মাস্টারকে গাজীপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে খালেদা জিয়ার অনুগত বাহিনীর লোকজন। যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ও তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের রংমহল খ্যাত ‘খোয়াব ভবন’- এ বসে।

মূমুর্ষ অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসানুল্লাহ মাস্টারকে ঢাকার পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হলে রাস্তায় দফায় দফায় বাধা দেয়া হয়। এক পর্যায়ে টঙ্গীতে তাকে বহনকারী গাড়ি আটকে দেয় সন্ত্রাসীরা। এভাবে বাধা দেওয়া না হলে শেষ পর্যন্ত হয়ত আহসানুল্লাহ মাস্টারকে যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া যেত। তিনি হয়ত বেঁচে থাকতেন। এটিও অমানবিকতার একটি বড় উদাহরণ।

এখানে মাত্র ১০টি ঘটনার কথা বলা হয়েছে। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ওপর নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা এবং হত্যাচেষ্টার অনেক ঘটনা রয়েছে। আরও রয়েছে গ্যাসের দাবিতে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা। রয়েছে সারের দাবিতে তীব্র আন্দোলনে গুলি চালিয়ে বহু সংখ্যক কৃষককে হত্যার ঘটনাও।

পুত্র কোকোর মৃত্যুর ঘটনা শুনে রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বাড়িতে। প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রটোকল ফেলে সেদিন খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়ানোর জন্যই গিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার বাড়ির গেট খোলা হয়নি সেদিন। এমনই অমানবিক তিনি।

খালেদা জিয়া আপাদমস্তক একজন উগ্র মনোভাবের মানুষ। প্রতিহিংসার রাজনীতি করে গেছেন জীবনভর। এমনকি তার দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম তাকে অশিক্ষিত এবং যোগ্যতাহীন বলে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী বলেই তিনি দলের পদ পেয়েছেন, এছাড়া তার আর কোনো যোগ্যতাই নেই।

আরো পড়ুনঃ