
বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখতাম, ৭ই নভেম্বর দিনটা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারতাম না। স্বাধীনতা দিবস বুঝি, বিজয় দিবস বুঝি কিন্তু এই সংহতি দিবসটা কী বস্তু?
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সরকারীভাবে মহাসমারোহে একদল মানুষ সিপাহী জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের দিবস হিসেবে দিনটা পালন করতো। এই বিপ্লবের কারণ কী ছিল, কেন হয়েছিল- আশেপাশের পরিচিতদের এই প্রশ্ন করলে প্রায় কেউই উত্তর দিতে পারতো না।
আজও পারে না। কেবল পোষা ময়নার মত মুখস্ত আউড়ে যায়,
‘৭ই নভেম্বর স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সিপাহী জনতা এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্ত করে আনে, তারপর জিয়া বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন, দেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি…’
৭ই নভেম্বর, ১৯৭৫। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট। শেরেবাংলা নগর। অফিসার্স ক্যান্টিন। পরোটা আর গরুর মাংস দিয়ে নাস্তা করছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এটিএম হায়দার এবং কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা।
এর আগে রাত ১২টার দিকে শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রোমান্টিসিজম মাখা অভিলাষ বাস্তবায়নে পুরো ক্যান্টনমেন্টকে উন্মত্ত ষাঁড়ের মত খেপিয়ে তুলে খালেদের বিরুদ্ধে ক্যু করেছে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা; সুপরিকল্পিতভাবে খালেদকে ভারতের চর, দেশ বিক্রি করে দেওয়া দালাল হিসেবে প্রচার করে গণ্ডায় গণ্ডায় লিফলেট বিলিয়ে প্রত্যেকটা সেনার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে বিচিত্র এক স্লোগান- “সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই”।
আরো পড়ুনঃ ৭ নভেম্বর: মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও রাজাকারদের ক্ষমতায়ন শুরু করে জিয়া
বন্দী অবস্থা থেকে বের করে এনেছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী মেজরদের নির্দেশদাতা জেনারেল জিয়াকে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় বিচারের মুখোমুখি হবার অপেক্ষায় ছিল যে। জিয়া বের হয়েই কর্নেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বন্ধু! তোমার এই উপকার আমি কোনোদিনই ভুলব না…।
খালেদ সবই শুনেছেন। কিন্তু তার পাথুরে শান্ত মুখাবয়ব দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টটা খালেদ নিজের হাতে বানিয়েছিলেন, এই রেজিমেন্টের সেনারা সবাই তার খুব আপন, খুব চেনা। এদের নিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চিন্তা ঘুরছিল হয়তো মাথায়, হঠাৎ করেই শোরগোল উঠলো বাইরে।
আচমকা একজন বিপ্লবী হাবিলদার আর কয়েকজন সৈন্য নিয়ে মেজর জলিল আর মেজর আসাদ প্রবেশ করলো ক্যান্টিনে। পাশেই ১০ম বেঙ্গলের কমান্ডার কর্নেল নাজমুল হুদা, সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই সেনাপ্রধানের সামনে চিৎকার করে সে বললঃ আমরা তোমার বিচার চাই।
Table of Contents
[বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ-হায়দার-হুদার রক্ত ঝরানো বিপ্লব ও সংহতি দিবস]
পাথুরে চোয়ালবদ্ধ খালেদের গলাটা আশ্চর্যরকম শান্ত শোনাল– “ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার করো”, আমাকে তোমাদের কমান্ডিং অফিসারের কাছে নিয়ে চলো।”
স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার চিৎকার করে বললোঃ আমরা এখানেই তোমার বিচার করবো।
খালেদ বুঝতে পারলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজরদের মতো ওদের অর্ডারটাও কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে আসেনি। একজন সাধারণ কমান্ডিং অফিসারের এরকম অর্ডার দেবার দূরদর্শিতা থাকে না, সাহস হয় না। দে আর স্পেসিফিক, দ্যা অর্ডার ইজ স্পেসিফিক। এমন কেউ দিয়েছে, যে চাচ্ছে তার পথে আর কোনো কাঁটা না থাকুক!
উদ্যত বন্দুকের সামনে একটা পলকও পড়ল না, ঠাণ্ডা চোখে ঋজু ভঙ্গিতে বসে থাকা মানুষটাকে হঠাৎ অকুতোভয় টাইগার বলে বিভ্রম হলো।
– ঠিক আছে, তোমরা এখানেই বিচার করো।
ট্যাট্যারররর শব্দে গর্জে উঠলো অটোম্যাটিক। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন খালেদ মোশাররফ। সেই খালেদ মোশাররফ, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে কমান্ডার হিসেবে কিংবদন্তী ছিলেন, সেক্টর কমান্ডার হয়েও যুদ্ধক্ষেত্রের পেছনে বসে যুদ্ধ পরিচালনার বদলে অস্ত্র হাতে বাঘের গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন শত্রুর ওপর, এক হাতে সিগারেট টানতেন আর আরেক হাতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে স্টেনগান চালাতেন, যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধ পরিচালনা যার নীতি ছিল…।
সেই খালেদ মোশাররফ, কুলনেস ও ক্র্যাক কী জিনিস, তা ২ নাম্বার সেক্টরের যোদ্ধারা যার কাছ থেকে হাতে কলমে শিখত, শিক্ষক ছিলেন তিনি আর এটিএম হায়দার! সেই খালেদ মোশাররফ, মার্চের ২৬ তারিখেই ফোর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন যিনি, ঢাকায় যে তার বউ-বাচ্চা আছে, তাদের যে পাকিস্থানিরা মেরে ফেলতে পারে, একবারও ভেবে দেখেন নাই।
আরো পড়ুনঃ ৭ নভেম্বর: মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হত্যার শুরু যেভাবে
সেই খালেদ মোশাররফ, যার অসমসাহসী পরিকল্পনায় পাকিস্থানি জেনারেল টিক্কা খানের দম্ভ ভরে দেওয়া ঘোষণা (জুন মাসের মধ্যেই ঢাকা চট্টগ্রাম রেললাইন খুলবে, মুক্তিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে) মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে একশ’র উপর পাকিস্থানি সেনা বেঘোরে মরেছিল, কিন্তু পাকবাহিনী মেজর সালেক আর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনদের হারাতে পারে নাই, ওই রেললাইন আর কখনো চালুই হয় নাই!
সেই খালেদ মোশাররফ, একাত্তরের ২৩শে অক্টোবর যুদ্ধক্ষেত্রে আচমকা পাকিস্থানি মর্টার শেলের আঘাতে যার মাথার বাম পাশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, ব্রেনের একটা বিশাল অংশ প্রায় অকেজো হয়ে কোমায় চলে যাওয়ার পরও মেডিক্যাল সায়েন্সের অবিশ্বাস্য মিরাকল হয়ে যে বেঁচে উঠেছিলেন আবারো, বেশ কয়েকবার অপারেশনের পরেও সেই শেলের অনেকগুলো স্পিন্টার যার মাথা থেকে বের করা যায় নাই।
আঘাতটা এতই মারাত্মক ছিল যে, তার বেঁচে ওঠাটা ছিল এক বিশাল বিস্ময়। সেক্টর টু এর বাংলাদেশ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা খালেদের সহযোদ্ধা মেজর (অব.) ডা. আখতার তার বই “বার বার ফিরে যাই” তে লিখেছিলেন-
খালেদের মস্তিস্কের আঘাতটা অনেক গভীর ছিল। গোলার আঘাতে তার মস্তিস্কের ঘিলুর অনেকটাই মাথা থেকে ছিটকে বাইরে চলে গিয়েছিল যেমনটা পুকুরে ঢিল মারলে পানি ছলকায়। প্রত্যক্ষদর্শী ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এবং ডা. মনসুরের বিবরণী থেকে জানা যায় যে- মাথার ব্রেন ম্যাটার লিক বন্ধ করার জন্য একটা গামছা নিয়ে তার মাথা এবং কপাল বাঁধতে হয়েছিল। খালেদ আহত হবার মুহুর্তে আমি সাথে ছিলাম না। খবর পেয়ে আগরতলা 160 GH ভারতীয় আর্মি হসপিটালে যাই। পরদিন সকাল পর্যন্ত ছিলাম।
[বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ-হায়দার-হুদার রক্ত ঝরানো বিপ্লব ও সংহতি দিবস]
এক্স-রেতে দেখা গেল একটা বড়সড় স্প্লিন্টার এর টুকরো ব্রেনের ভেতরে সামনের দিকে সাসপেন্ডেড হয়ে আছে। যে জায়গাটায় আঘাত লেগেছে ওটাকে বলে ফ্রন্টাল লোব। ব্রেইনের প্রত্যেকটি অংশই আলাদা আলাদা কাজ করে, যেমন- ব্রেনের পিছন দিকটা দৃষ্টি কন্ট্রোল করে, পাশের লোবগুলো কন্ট্রোল করে কান ও শ্রবণ, আবার কোনোটা কন্ট্রোল করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, আর কোনো এরিয়া কন্ট্রোল করে হাঁটা-চলা, বুদ্ধি, কথা বলা, স্মৃতি। শুধু ফ্রন্টাল লোব, যেখানে খালেদের গোলা লেগেছিল এবং যেখান থেকে ব্রেন ম্যাটার বা হলুদ ঘিলু কিছুটা বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই অঞ্চলটা সরাসরি কিছু না করলেও বুদ্ধিবৃত্তির উপর একটা বড় ধরণের প্রভাব ফেলে।
এর অর্থ হচ্ছে, যে খালেদ পুরো একাত্তর জুড়ে অমিত সাহসে অসামান্য বুদ্ধিমত্তা আর দ্রুত তীক্ষ্ম প্রত্যুৎপন্নমতিতায় যুদ্ধটা পরিচালনা করেছিলেন, সেই খালেদকে পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সেই খালেদ মোশাররফ, ১৪-১৫ বছর বয়সী ইয়াং প্লাটুনের (ওয়াই প্লাটুন) এর দুর্ধর্ষ কিশোরদের যিনি দূরের সদাসতর্ক পাহারারত পাকিস্থানি আর্মির বাংকার দেখিয়ে বলতেন, “যে গ্রেনেড চার্জ করে ওই বাঙ্কার ধ্বংস করবে সে আমার হাত ঘড়িটা পাবে।”
সেই খালেদ, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে যার ললাটে ছিল এ মাটির বীর সন্তানের জয়টিকা, মাথায় বীর উত্তমের শিরস্ত্রাণ আর মাথার বামপাশে মগজের ভেতর আজীবন ধরে বয়ে বেড়ানো পাকিস্থানি গোলন্দাজ বাহিনীর মর্টার শেলের স্পিন্টার…।
সেই খালেদ মোশাররফ লুটিয়ে পড়লেন। স্বাধীনতার মহান আদর্শ আর দীপ্তিমান চেতনার অনির্বান শিখা জ্বালিয়ে রাখতে “দ্যা লাস্ট স্ট্যান্ড” হবার অপরাধে তার বিচার করলো তারই অনুগত কিছু সেনা, মুক্তিযুদ্ধের যে মেজর জলিলকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এলেছিল খালেদ, সেই খালেদের উপর রাইফেলের পুরো ম্যাগাজিন খালি করতে একবিন্দু কাঁপলো না জলিলের হাত।
অর্ডারটা বরাবরের মতই এল পর্দার ওপারের এক চাপা কণ্ঠ থেকে। রাত ৪টার দিকে ফোন এল। না, টেন্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসারের কাছে না, এক সামান্য মেজরের কাছে। মেজর জলিলের কাছে। কালো সানগ্লাসের আড়ালে থাকা সেই নির্দেশদাতা চোস্ত উর্দু বলতে পারলেও তার কণ্ঠটা কখনই শুদ্ধ উচ্চারনে বাঙলা বলতে পারেনি… কখনোই না…।
খালেদ মোশাররফ আর এটিএম হায়দার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের আরবান গেরিলা ফতেহ আলী চৌধুরী আজও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তার স্পষ্ট মনে পড়ে খালেদ মোশাররফকে, ট্রেনিং নিতে মতিনগর গিয়েছিল ওরা, মেলাঘরের আগে যেখানে ছিল ছিল ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়াটার।
ট্রেনিং-এর প্রথম দিনে বর্ডারের ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের নিচে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা, হঠাৎ নেমে এলেন তিনি, সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ, পাথুরে শান্ত চেহারা, সৌম্য দৃষ্টি, তবে একটু ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারা যায় চোখটা আসলে তপ্ত ভাটার মতো জ্বলছে। নেমে কিছু কথা বললেন তিনি, কথাগুলোর ভেতরে বোধহয় বারুদ লুকানো ছিল, এক অনির্বচনীয় অনুভূতি হল সবার।
শেষে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন জনৈক ক্যাপ্টেন হায়দারের সাথে, বাঁ-হাত ভাঙা, স্লিঙে ঝুলছে। বিকালের মরে আসা নরম আলোয় শক্ত চেহারার ভাবলেশহীন এ মেজরকে ফতেহর হঠাৎ কোনো গ্রিক দেবতার স্কাল্পচার বলে মনে হল। পাকিস্থান আর্মির স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের ডাকসাইটে কমান্ডো ছিলেন এই মেজর, তিনিই ঢাকা এরিয়ার কমান্ডার হবেন, তার নেতৃত্বেই বিভিন্ন হাবিলদার, সুবেদার মেজররা গেরিলাদের ট্রেনিং দেবেন।
ফতেহ আলী চৌধুরীর এক ভিন্ন জীবন শুরু হল। মেজর হায়দার নামের এই মানুষটা যে কতটা অসামান্য একজন ইন্সট্রাকটর এবং লিডার ছিলেন, সেটা আরবান গেরিলাদের এই দলটা খুব দ্রুতই বুঝে গেল।
[বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ-হায়দার-হুদার রক্ত ঝরানো বিপ্লব ও সংহতি দিবস]
একেবারে বিজন পাহাড়ে জঙ্গল কাটা, তাঁবু তৈরি, খাওয়া দাওয়ার কষ্টকর ব্যবস্থা থেকে শুরু করে হাড়ভাঙা ট্রেনিং– সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন মেজর হায়দার। ব্যক্তিত্বের পারফেকশনে কড়া শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের সময় বাঘের মতো ভয় পেত সবাই, কিন্তু যখন কেউ হঠাৎ করেই কিছু একটা শিখে ফেলতো, করে দেখাত নিখুঁতভাবে, তখন তৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠত তাঁর মুখে, পিঠ চাপড়ে বলতেন, ওয়েল ডান বয়, ওয়েল ডান। ব্যস, সব রাগ-অভিমান ভ্যানিশ।
ফতেহ আলী চৌধুরী মানুষ হিসেবে ছিল সদারসিক, কারোর কোন কথা মাটিতে পড়তে দেবে না, জবাব রেডিই আছে। এমন একটা কথা বলবে যাতে মানুষটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও হেসে ফেলতে বাধ্য। মেজর হায়দারের খুব প্রিয় সোলজার ছিল ফতেহ, যেকোনো গুমোট পরিস্থিতি খুব সহজে হালকা করে ফেলতে পারত ছেলেটা।
একবার এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং চলার সময় একটা গাছে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে বললেন হায়দার। লাগিয়েই সবাইকে সরে যেতে বললেন, সবাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সরে গেল। সবাই, কেবল ফতেহ আলী ছাড়া। বিকট বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেল, তার মধ্যেই হায়দার খেপে গিয়ে ফতেহকে জিজ্ঞেস করলেন, সরে যেতে বললাম না? খাম্বার মতো দাঁড়ায়া ছিলা কেন?
চটপটে ফতেহর উত্তর, আপনি তো স্যার যান নাই, আমি কেবল আপনারেই ফলো করছি মাত্র। মরতাম না এদ্দুর সিউর ছিলাম। জবাব শুনে ফতেহকে এই মারেন তো সেই মারেন হায়দার, ফাজিল পোলা, মাইর না খাইলে সিধা হইবা না…।
খালেদ মোশাররফের অমিত ব্যক্তিত্বের কারনে তাঁকে সবাই দূর থেকে সম্মান করতো, ভালোবাসতো, আইডল হিসেবে স্যালুট করতো। কিন্তু মেজর হায়দার ছিলেন তাদের খুব আপনজন, খালেদের মতো একই ছাঁচে রাশভারী ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও ট্রেনিংয়ের মাঝে কখন যেন ছেলেদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন মানুষটা।
পৃথিবীর ইতিহাসে গেরিলাযুদ্ধের সংজ্ঞা পাল্টে দেয়া অবিস্মরণীয় বীরযোদ্ধা সেই কর্নেল এটিএম হায়দারকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে টেনে এল ওরা। পৈশাচিক কায়দায় বেয়োনেট চার্জ করার একপর্যায়ে বার্স্টফায়ার করা হল তার উপর, লুটিয়ে পড়লেন ২ নম্বর সেক্টরের হাজার হাজার দুর্ধর্ষ গেরিলার প্রিয় “হায়দার ভাই”। পুরো মুক্তিযুদ্ধই যিনি করেছিলেন এক হাতে। যুদ্ধের প্রথম দিকেই এক দূর্ঘটনায় হাতে গুলি লেগেছিল। পরিপূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিলেন ডা. মেজর আখতার তাকে।
কিন্তু হায়, সেই বিশ্রাম আর কখনো মেলেনি। পুরো একাত্তরে এক হাতেই ট্রেনিং দিয়েছিলেন হায়দার হাজার হাজার মুক্তিপাগল গেরিলাদের, যুদ্ধ করেছিলেন, পাকিস্থানিদের পরাজিত করতে করতে ডিসেম্বরে ঢাকায় বীরদর্পে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকেছিল মেজর হায়দারের নেতৃত্বে, প্রিয় কমান্ডার খালেদ ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে সেক্টর টু এর কমান্ডার যে ছিলেন হায়দারই।
আর কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম? সেই যে অমিতসাহসী বীরযোদ্ধা, পাকিস্থানি আর্মির উপর বাঘের গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যিনি। সেই নাজমুল হুদা যিনি ১৯৬৯ সালে পাকিস্থানি শোষণের নাগপাশ ছিড়তে এক সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন, ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকেও আটকে রেখেছিল আইয়ুব জান্তা সরকার।
৮ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদাকে বিনা অপরাধে মেরে ফেললো মেজর জলিল, মেজর আসাদেরা, অথচ ব্রিগেড কমান্ডার ছিল মানুষটা ওদের!
একাত্তরে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় লে. জে. অরোরা আর নিয়াজীর সাথে যে মানুষটা অভূতপূর্ব দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুর্তি হয়ে, সেই আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের পবিত্র রক্তে রাঙা হল চিরদুঃখী বাংলা মায়ের আঁচল…।
“চিন্তা করো না, আমি ভালো আছি। কাল চলে আসবো…”
স্ত্রী সালমাকে দেওয়া এই কথা রাখতে পারেননি মহাবীর খালেদ। ঠিক যেমনি নাজমুল হুদা পাননি স্ত্রীর প্রিয় মুখখানা শেষবারের মত দেখার সুযোগ।
“আব্বা, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি তাড়াতাড়িই চলে আসবো”- বলে সেই যে গেলেন, আর ফেরা হয়নি এটিএম হায়দারের। প্রিয় বড় বোন, আদরের ছোটবোনটার পথ চেয়ে থাকা আকুল অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি। আর কখনো ফিরতে পারেননি মানুষগুলো, ফিরতে পারেননি পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থান দমনের অজুহাতে জিয়ার ক্যাঙ্গারু কোর্টে প্রহসনের বিচারে নির্বিচার গণহত্যার শিকার হওয়া সশস্ত্র বাহিনীর হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা অফিসার।
কেবল বিমান বাহিনীরই ১১০০ এরও বেশী দেশপ্রেমিক অফিসারকে মেরে ফেলেছিল জিয়া তার ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে উদার ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই বাংলাদেশের কবর রচনা করে পাকিস্থানের মত ধর্ম্মান্ধ আর উগ্র মৌলবাদী জঙ্গীদের আখড়া বানাবার আইএসআই-এর মিশনের অংশ হিসেবেই জিয়া মুক্তিযোদ্ধা অফিসার মেরে ফেলেছিল একে একে!
যেন আর কেউ আইএসআই-এর পরিকল্পনার সামনে দাঁড়াতে না পারে। যে লাল-সবুজের বাংলাদেশ খালেদ-হায়দার-হুদার মতো অগণিত মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে এনেছিলেন পাকিস্থানি শকুনগুলোর গ্রাস থেকে, সেই বাংলাদেশকেও আর তাই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
[বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ-হায়দার-হুদার রক্ত ঝরানো বিপ্লব ও সংহতি দিবস]
জিয়া তার উপর পাকিস্থানের অর্পিত দায়িত্ব নিখুঁত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিল, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ইনডেমনিটি (বিচার হতে পারবে না এমন আইন) দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মত সম্মানিত দায়িত্ব দেওয়া থেকে শুরু করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আজমকে পাকিস্থানি পাসপোর্টে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এই জমিনে দাঁড়াতে দেওয়া এবং তার দল একাত্তরের নরপিশাচ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিল।
যার পথ ধরে জিয়ার দল বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী আর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে স্বাধীন বাংলাদেশে মন্ত্রী বানিয়ে সরকারী গাড়িতে তুলে দিয়েছিল শহীদের রক্তে ভেজা জাতীয় পতাকা। হরকাতুল জিহাদ, জেএমবিসহ নানা জঙ্গী সংগঠন গড়ে তুলে দেশব্যাপী ৬৪ জেলায় সরকারী মদদে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নিজেদের দাপট জানিয়েছিল ওরা।
আইএসআই-এর বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার মিশন সফল করেছিল। এই পুরো প্ল্যানের গ্রাউন্ড তৈরি করেছিল জিয়া, খুব সুচারুভাবে অকল্পনীয় দক্ষতায় ৩০ লাখ শহীদের রক্তাক্ত এই জমিনের শিরায় শিরায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল দূষিত পাকিস্থানি রক্ত।
তাই আজও লাল-সবুজ পতাকার মাঝে কালো থাবা বসায় চাঁদতারা রঙের শকুন, লাল টুকটুকে সূর্যের এক রৌদ্র ঝলমলে সকালে মিছিল করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করে কিছু মানবরূপী জন্তু…।
লেখক: রহমান রা’দ
আরো পড়ুনঃ
- ৭ নভেম্বর জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন: ওবায়দুল কাদের
- ৭ নভেম্বর: মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও রাজাকারের ক্ষমতায়ন শুরু করেন জিয়া