
১৩ অক্টোবর. ২০২১। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটানোর ষড়যন্ত্র হয় কুমিল্লায়। কোরআন শরীফ অবমাননার নাটক সাজানো হয় দুর্গাপূজার জন্য সাজানো একটি মণ্ডপে। এরপর ইস্যু তৈরি করে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালায় ওই মণ্ডপে। তছনছ করে দেয় পুজার সাজসজ্জা, ভাঙচুর করে দেবতাদের প্রতীমা। সেদিন সারাদিনে কুমিল্লার প্রায় ৭০টি পূজা-মণ্ডপে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার সর্বোচ্চ অপচেষ্টা করে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরলপ্রাণ অনেক মানুষকেও বিভ্রান্ত করে খেপিয়ে তোলে তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে, ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য ও গুজব ছড়াতে থাকে সারা দেশে।
এরপর শুধু কুমিল্লাতেই এই হামলা থেমে থাকেনি। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বান্দরবান, ফেনী, কিশোরগঞ্জ ও রংপুরেও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কোরআন মাজিদের সম্মান রক্ষার ফাঁদ পেতে নির্বিচারে মানুষের ওপর হামলা চালায় ইসলামের নামধারী একদল সুবিধাবাদি ও সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতিকারী।
বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গা ও লক্ষীপূজার উৎসবকে রক্তাক্ত করে তোলে তারা।
তবে, ১৩ অক্টোবর মণ্ডপে কোরআন রাখার যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, তার গোঁমড় ইতোমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে কোরআন নিয়ে মণ্ডপে রেখে এসেছিল, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্ত ও আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই কালপ্রিটের নাম ইকবাল হোসেন। এছাড়াও এসব সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে ইতোমধ্যে ১০২টি মামলায় প্রায় ৬০০ লোক গ্রেফতার করা হয়েছে।
সবগুলো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, ঘটনার দিন রাতে ইকবাল স্থানীয় মসজিদে বসে মসজিদটির খাদেমদের সঙ্গে বৈঠক করে। এরপর সেখান থেকে একটি কোরআন শরীফ সংগ্রহ করে নানুয়ার দীঘি পূজা-মণ্ডপে যায়। কিছুক্ষণ পর তাকে হিন্দুদের দেবতা হনুমানের প্রতীমার হাতে থাকা ‘গদা’ হাতে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সিসিটিভির সার্বিক ফুটেজ পরীক্ষা করে প্রমাণ হয় যে, ইকবালই মণ্ডপের হনুমানের হাত থেকে গদা সরিয়ে সেখানে কোরআন শরীফ রেখে আসে। অর্থাৎ একজন মুসলমান হয়ে সে মুসলমানদের পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থকে অবমাননা করলো। অথচ, হামলার শিকার হলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
শেষ রাতের দিকে, মণ্ডপে কোরআন রাখার ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন মণ্ডপে কেউ উপস্থিত
ছিলেন না। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তখন ওই এলাকার রাস্তাতে কোনো জনমানুষই ছিলো না। সেই সুযোগে ইকবাল হোসেন এই গর্হিত অপকর্মটি করার সুযোগ পায়। এরপর সকালে মোহাম্মদ ফয়েজ নামের সৌদি-ফেরত এক স্থানীয় ব্যবসায়ী মণ্ডপে কোরআন শরিফের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে এবং সাথে সাথে তা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বেগের সুযোগ নিয়ে একদল মানুষ মন্দিরে হামলা চালায় এবং ব্যাপক ভাঙচুর করে। এলাকার সাধারণ মানুষ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এই হামলাকারীদের কাউকেই চিনতে পারেন নি। পরে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায়- বিভিন্ন এলাকার হামলায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা অধিকাংশই নিজ এলাকায় এই কাজ করেনি, এমনকি পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও না। তাদের কেউ চিনতে পারবে না এমন এলাকায় গিয়ে তারা নাশকতা চালিয়েছে। পূর্ব-পরিকল্পনা না থাকলে এমন কাজ করা সম্ভব নয়।
[সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিক্ষত বাংলাদেশ: জেঁকে বসেছে সেই পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা]
পূর্ব-পরিকল্পনার মাধ্যমে অনলাইনে গুজব:
এসব সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভাঙচুর করার জন্য উস্কানি দিতে দুষ্কৃতিকারীরা সংঘবদ্ধভাবে ফেসবুক-ইউটিউবকে ব্যবহার করেছে। পুলিশ অনেকগুলো ইউটিউব চ্যানেলকে শনাক্ত করেছে, যারা হামলার সময় উস্কানিমূলক ভিডিও প্রচার করেছে। তরুণ ওয়াজ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ছয়টি ভিডিও পোস্ট করে। এই চ্যানেলের মালিক খুলনার বায়তুন নাজাত মসজিদের খতিবের সহকারী। রোজ টিভি নিউজ নামের আরেকটি ইউটিউব চ্যানেল তিন দিনে ২৭টি ভিডিও সম্প্রচার করে। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে এসব করা একেবারেই অসম্ভব। এরকম আরেকটি ইউটিউব চ্যানেল নিউজ বিডি, যারা শুধু ঘটনার দিনই ১০টি ভিডিও প্রচার করে। পরিকল্পনামাফিক কাজ করার প্রমাণ এখানেও সুস্পষ্ট।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নূরের দলের নেতাকর্মীরা:
অন্যদিকে চট্টগ্রামে জেমসেন হল পূজা-মণ্ডপে হামলার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে ৯ জন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের সংগঠন ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের নেতাকর্মী। সরকারবিরোধী যেকোনো কাজে বেশ কিছুদিন থেকেই ভিপি নূর পটভূমি তৈরি করে দেওয়ার ভূমিকা পালন করছে। এর আগে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠান বানচালের জন্যেও নূরের দলের ব্যানারে বিএনপি-জামায়াতের জোটভুক্ত সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে সহিংসতা ছড়ানো শুরু করেছিল, সেই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে হেফাজতেরএকাংশের কর্মীরা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।
কী চায় বিএনপি:
বাংলাদেশের আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টির পর এই দরের নেতারা স্বভাবসুলভভাবেই সরকারকে দায়ী করে চলেছে। অথচ সাধারণ মানুষ যখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে, রাস্তায় নেমে এসেছে, কিন্তু বিএনপি এখন (২৪ অক্টোবর) পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। বরং ঘটনার ক্রীড়নক ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতারের পর তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী, মাদকাসক্ত বলে দোষ ঢাকার চেষ্টা করছেন বিএনপির মহাসচিব। রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কী মানুষের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই? মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহস তারা কেন করেন না?
আরো পড়ুন- লন্ডনী যুবরাজের প্ল্যান এবং অর্থায়ন, ইকবালকে ভাড়া করে বিএনপি নেতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতাকে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূচনা করেন। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, সহিংসতা, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মতো নৃশংসতার পথ পাড়ি দিয়ে স্বৈরশাসকদের হাতে আমাদের সংবিধান বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যগুলোও ধীরে ধীরে মুছে দিয়েছে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল ও সরকারেরা। বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষের মাঝে ধর্মের মনগড়া ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, স্বাধীনতার সত্য ইতিহাসকে ধামাচাপা দিয়ে একটি অসহিষ্ণু, বাংলাদশেক অন্ধকারাছন্ন দেশে পরিণত করার চেষ্টা করেছে তারা বারবার। অমুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে ভাঙচুর ও তাণ্ডবের মাধ্যমে নিজেদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সবসময়ই সচেষ্ট বিএনপি-জামাতের মতো পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। এবারের ঘটনাতেও ব্যতিক্রম নেই।
আরো পড়ুন-