
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালনের সময় খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আসিফ নওয়াজ জানজুয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে শোক বিবৃতি পাঠালেন। পরদিন দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, অবজারভারসহ বাংলাদেশের সকল পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় এ শোকবার্তা ছাপা হয়। ‘পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল নওয়াজের ইন্তেকাল : খালেদা জিয়ার শোক’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শুক্রবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাছে পাঠানো এক বার্তায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আসিফ নওয়াজের আকস্মিক মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। খবর বাসস’র। ‘প্রধানমন্ত্রী তার বার্তায় মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেছেন। তিনি মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।’ [সূত্র : সংবাদ, ৯ জানুয়ারি, ১৯৯৩]
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন একজনকে সে সময়েই জিজ্ঞেস করি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য একটি দেশের সেনাবাহিনী প্রধানের মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠাতে পারেন কী-না। উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণভাবে এটা প্রোটোকলসিদ্ধ নয়। তবে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বা পারিবারিক পর্যায়ে সম্পর্ক থাকলে কিংবা তার প্রতি বিশেষ কোনো কারণে সম্মান-শ্রদ্ধা জানানো প্রয়োজন মনে করলে এমনটি করতেই পারেন।
জেনারেল জানজুয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা করে তিনি ছিলেন মেজর পদে অধিষ্ঠিত, ১১১তম পদাতিক ব্রিগেডে ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার চূড়ান্ত অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্র বাহিনী গঠন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর এ মিত্র বাহিনীর কাছেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করে। এ বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ চুক্তিতে সই করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ২০০৫ সালের ৩ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খালেদা জিয়া সে সময়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তিনি শোক বার্তা প্রেরণ করেননি।
শোকবার্তা না পাঠানোর মধ্য দিয়েও বার্তা যেতে পারেÑ জগজিৎ সিং অরোরা বাংলাদেশের জন্য কোনো বিষয় না। কিংবা এমনটিও হতে পারেÑ মিত্রবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে হিসেবে যিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করেছেন খালেদা জিয়া তার প্রতি যথেষ্টই রুষ্ট ছিলেন। জেনারেল আসিফ নওয়াজ জানজুয়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযানে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। নির্বিচারে বাঙালি নিধন ধর্ষণ-লুটপাট, এ সব দায় তারও। পরের ২২ বছর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই ছিলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের ভাল চেয়েছেন, এমন একটি দৃষ্টান্তও কি কেউ দিতে পারবে? তাহলে খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়ে কী বার্তা দিলেন? আমাদের এটাও জানা আছে যে খালেদা জিয়া ও জনারেল জানজুয়ার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কূটনৈতিক বিপর্যয় ঘটবেÑ এমন শঙ্কা থেকে কিছু লোক তাকে বিরত রাখতে পারেন। জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকবার্তার অর্থ হতে পারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তিনি যে ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছেন, খালেদা জিয়ার কাছে তা দোষণীয় কিছু ছিল না।
না-কি ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্কের কারণে খালেদা জিয়া ওই শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন? ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালের ৮ মে (২৫ বৈশাখ) রাতে হাসিনা আমাকে জানায়, কর্নেল জিয়াউর রহমান সাহেবের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পারিবারিক কিছু সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ইতোপূর্বে বেশ কয়েকদিন বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসেছিলেন। হাসিনা আমাকে আরও জানায় যে, ১৯৯১ সালের মে মাসে বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়াউর রহমান সাহেব লোক মারফত চিঠি লিখে ভারতে তাঁর (জিয়া সাহেবের) নিকট চলে যাওয়ার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ভারতে যাননি বলে জিয়া সাহেব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাছাড়া ১৯৭১-এর জুলাই মাসে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দুই সন্তানসহ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার খবর শুনে জিয়া সাহেব শুধু দুশ্চিন্তাগ্রস্তই হননি, মনে মনে ক্ষুদ্ধও হয়েছিলেন। এ সব ঘটনার কারণে ঐ সময়ে কর্নেল জিয়াউর রহমান সাহেব ও তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে মনোমানিল্য চলছিল। হাসিনা আমাকে আরও জানায় যে, এই পারিবারিক মনোমানিল্যের সমস্যা নিরসনে সাহায্য করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ঐ সময় অনেক অনুরোধ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।’ [সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা১৩৫]
বিএনপির নেতাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে ভারত ভূখণ্ডে যাওয়া ব্যক্তিদের সমালোচনা করে বলেন, তারা ফূর্তি-মৌজ করার জন্যই ভারত গিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া কি এ কারণেই জিয়াউর রহমানের অনুরোধ সত্ত্বে¡ও ভারতে যাননি? তাঁর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দিজীবন কবে শুরু হয়েছিল এবং কীভাবে তার অবসান ঘটেছিল, সেটা বলতে পারেন কেবল একজন খালেদা জিয়া। তিনি কী মুখ খুলবেন?