জিয়ার কবর নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবর নেই। একটি কফিন সেখানে দাফন করা হয়েছে। বিএনপি কেন এই জিয়ার কবর নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। তারা তো জানে, সেখানে জিয়ার কোনো কবর নেই। প্রধানমন্ত্রী এটিও বলেছেন, যখন কফিন খোলা হয়েছিল একটি কমব্যাট ড্রেস (সামরিক বাহিনীর সদস্যদের যোদ্ধার পোশাক) পরা মরদেহ ছিল। জিয়াউর রহমান সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাই তিনি তখন কমব্যাট ড্রেস পরতেন না।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি সত্য অনুসন্ধানের চিন্তা উৎসাহিত হয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে পরদিনই সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপির এই বক্তব্য যে ইতিহাস এবং সত্যান্বেষী নয়, তা গবেষকরা মনে করেন। জিয়ার কবর আসলে কোথায়- এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামে বলেছেন, রাঙ্গুনিয়াতেও জিয়াউর রহমানের কবর নেই। তাহলে জিয়াউর রহমানের কবর কোথায় সে প্রশ্ন উঠেছে।

জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে বিতর্কে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি বলেছেন, জিয়ার কবর আসলে কোথাও নেই। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পরপরই সার্কিট হাউজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে বিদ্রোহী সৈনিকরা।

এ সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ডিসক্লোজড গোপন নথির বরাতে জানা যায়, জিয়াউর রহমানের লাশটি আসলে গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এই বক্তব্যের প্রতিবাদ বিএনপি সেই নথি প্রকাশের সময় করেনি। একজন সৈনিক গান পাউডার দিয়ে জিয়াউর রহমানের লাশ পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। সেই ছাইভস্ম রাঙ্গুনিয়ার একটি পাহাড়ি এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।

এর পেছনে মূল কারণ ছিল জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে যেন কোনো রাজনীতি করা না হয়। কাজেই জিয়াউর রহমানকে প্রথম যেখানে ‘দাফন’ করা হয়েছিল বলে দাবি হচ্ছে- চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়, সেখানেও জিয়াউর রহমানের দেহ ছিল না বলেই একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং অনুসন্ধানে পাওয়া যায়। সেখানে আসলে কার লাশ ছিল- সেটি এখনও পর্যন্ত এক বিতর্কিত প্রশ্ন। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেই রাতে জিয়াউর রহমানের অনুগত সৈনিকদেরও হত্যা করা হয়েছিল। তাদের কাউকে কমব্যাট ড্রেস পরা অবস্থায় রাঙ্গুনিয়ায় জিয়াউর রহমান বলে ‘দাফন’ করা হয়েছিল।

একটি বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেখানে যারা ছিলেন, তারা কেউই জিয়াউর রহমানের লাশ দেখেনি। বিএনপির দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য- ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী (সাবেক রাষ্ট্রপতি) দুজনই জিয়ার মৃত্যুর সময় চট্টগ্রামে ছিলেন। তারা কেউই জিয়াউর রহমানের মরদেহ দেখেননি।

তাহলে জিয়াউর রহমানের মরদেহ দেখলো কে?

একাধিক সূত্র বলছে, জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যার পর বিদ্রোহ দমন করা হলে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় গিয়ে কমব্যাট ড্রেস পরা একটি মরদেহ তুলে আনা হয়। কিন্তু সেটি জিয়াউর রহমানের মরদেহ- তা নিশ্চিত করা যায়নি। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম করতে হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো পোস্টমর্টেম করার অনুমতি দেয়া হয়নি। ফলে রাঙ্গুনিয়ার সেই মরদেহটি ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি তুলে ধরেছেন, সেই মরদেহের পরনে কমব্যাট ড্রেস ছিল। একজন রাষ্ট্রপতি মাঝরাতে নিশ্চয় কমব্যাট ড্রেস পরে ঘুমাতে যান না। অর্থাৎ, জিয়াউর রহমানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কোনো এক সৈনিক- যিনি ওই সময় গোলাগুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাকেই রাঙ্গুনিয়ায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সেটিই জিয়াউর রহমানের লাশ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সেই মরদেহ ঢাকায় এনে চন্দ্রিমা উদ্যানে দাফন করার সময়ও কফিন খোলা হয়নি। তাই তার মুখ কেউ দেখেনি।

চিকিৎসকদের মতে, এসব ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি অত্যন্ত জরুরী। পোস্টমর্টেম করলেই তিনি আদৌ জিয়াউর রহমান কি না, তা বোঝা যেত। কিন্তু কোনো সুরতহাল এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্টও করা হয়নি। যার ফলে জিয়াউর রহমানের কবর আসলে কোথাও নেই বলে প্রকাশিত মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে, সেটিই আসল সত্য বলে মত বিশ্লেষকদের।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, রাজনৈতিক মঞ্চে বিএনপি সব সময় কিছু কিছু অভিযোগ-অনুযোগ করে। নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, গুম-খুন, নির্যাতন ইত্যাদি অনেক কিছুই। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার চাননি। পুত্র তারেক রহমানও কখনও এ নিয়ে আলাপ তোলেননি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেও এই মামলা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। নথিপত্র অনুসন্ধান করেনি, তদন্ত পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় রহস্যজনক কারণে। এ বিষয়ে অসন্তোষ আছে বিএনপির ভেতরেই।

অনেকের অভিযোগ আছে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসে কি না- এই চিন্তা থেকেই বিএনপি কখনও দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার চায়নি। কিন্তু তাকে নিয়ে রাজনীতিটা তারা ঠিকই জিইয়ে রেখেছে। দলের কর্মসূচিতে এক দৌড়ে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার মাজারে হাজির হন নেতাকর্মীরা। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানে দলের প্রতিষ্ঠার হত্যার কোনো বিচার চান না তারা- রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।

সৌজন্যেঃ সময় এখন