গত কয়েকদিন ধরে যাকে কেন্দ্র করে অনলাইনে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে একটি মহল, সেই ব্যক্তির নাম আবু ত্ব-হা আদনান। ৩১ বছর বয়সী এই ব্যক্তি দুই স্ত্রী-সম্পর্কিত পারিবারিক ঝামেলা এড়াতে ১০ জুন আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তার আত্মগোপনকে নিয়ে অপরাজনীতির চেষ্টায় মত্ত হয়ে ওঠে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে তাদের হয়ে সরকারবিরোধী প্রচারণা শুরু করে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও হেফাজতের নাশকতার উস্কানিদাতা নুরুল হক নুর এবং ফেস দ্য পিপলের সঞ্চালক সাইফুল সাগর। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে সক্রিয় হয় দেশবিরোধী অপপ্রচারের অন্যতম কুশীলব ও আইএসআই এজেন্ট পিনাকী ভট্টাচার্য।

ত্ব হা আদনানের আত্মগোপনকে কেন্দ্র করে, গত কয়েকদিন ধরে অনলাইনে বানোয়াট ও উস্কানিমূলক তথ্য পরিবেশন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছিল এই চক্রটি। তবে ১৮ জুন ত্ব হাকে বড় স্ত্রীর রংপুরের ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর তিনি আত্মগোপনের আসল ঘটনা জানান। ফলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

তবে আসুন, যাকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের জাল ছড়ানো হচ্ছিলো, সেই ত্ব হা আদনান সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। কে এই ত্ব হা আদনান? আর কেনইবা তার আত্মগোপন?

কে এই ত্ব হা আদনান:

অনলাইনে ইসলামী স্কলার হিসেবে ত্ব হা আদনানকে পরিচিত অভিহিত করছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মূলত ইসলাম বিষয়ক উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নাই। তিনি রংপুর কারমাইকেল থেকে সাধারণ দর্শন নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। তারপর কিছুদিন তিনি আফগানফেরত কিছু কট্টর মোল্লার সংস্পর্শে থাকেন। এরপর থেকেই ইউটিউব ও ফেসবুকে ইসলামী বয়ানের নামে আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিদের পক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় মাসাআলা দেওয়া শুরু করেন। ফলে জামায়াত ও উগ্র ধর্মবাদী গ্রুপের সমর্থকরা তাকে দ্রুত লাইম লাইটে নিয়ে আসে। অনলাইনে উগ্রবাদীরা তাকে সেলিব্রিটি হিসেবে তুলে ধরায়, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য দিতে শুরু করেন তিনি।

তার বিভিন্ন ইউটিউব বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি গত কিছুদিন থেকে আফগানিস্তানের তালেবানদের পক্ষে একটি বড় ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। জিহাদের অপব্যাখ্যা করে দেশবিরোধী ও উগ্র কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলেন দেশের সরলপ্রাণ মুসল্লিদের। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও প্রকৃত আলেমরা অনলাইনেই তার এসব বক্তব্যের প্রকাশ্য ও কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাকে বাহবা দিয়ে আরো কট্টর পথে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলো। জামায়াত, হেফাজত ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে দেশবিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করেন তিনি। ইসলাম নিয়ে কোনো উচ্চ শিক্সা না থাকার পরেও তাই এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাকে ইসলামি বক্তা এবং ইসলামি স্কলার উপাধি দেওয়া হয়। তাদের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে ত্ব হা আদনানকে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের সামনে ইসলামী বক্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

কেনো তার আত্মগোপন:

ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায়, নানার পরিবারের বড় হন ত্ব হা আদনান। দর্শনে অনার্স মাস্টার্স করেও খুব দ্রুত পেশাগত জীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে ব্যর্থ হন। ফলে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন তিনি। পরিবার সূত্রে জানা যায়, এরমধ্যেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় আফগানফেরত উগ্রবাদী কয়েক ব্যক্তির। তারা ইসলামের প্রচারের নামে ত্ব হা আদনানকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করেন। তাদের কাছ থেকে কয়েক মাস দীক্ষা নিয়ে, নিজেই উগ্রবাদী ইসলামী প্রচারণা শুরু করেন ত্ব হা আদনান।

উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে নিমগ্ন হয়ে পড়ার তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে পরিবারের। এর আগে থেকেও কিছু পারিবারিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কারণ, কয়েক বছর আগে রংপুরের আবিদা নুরকে বিয়ে করেন ত্ব হা। কিন্তু এর পরপরই বিধবা ও অসহায় বৃদ্ধা মাকে ছেড়ে আলাদা বাসা নিতে হয় তাকে। এদিকে সেই ঘরে দুই সন্তানের জন্ম হয়। তবে পারিবারিক অশান্তির কারণে কিছুদিন আগে ঢাকার একটি মাদ্রাসা শিক্ষিকা সাবেকুন্নাহারকে বিয়ে করেন তিনি। আর্থিক সচ্ছলতার আশা করলেও, ফলাফল হয় উল্টো। কারণ, তার দ্বিতীয় স্ত্রী আগের স্বামী শেখ হাবিবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় তার। ফলে আরো উত্তাল হয়ে ওঠে তার পারিবারিক জীবন।

সবশেষে, সম্প্রতি তিনি পারিবারিক চাপ সহ্য করার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতার কথা শেয়ার করেন তার কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে। একইসঙ্গে কয়েকদিন তাকে নিভৃতে রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ফলে তারা তাকে নিজ এলাকা রংপুরেই কয়েকদিন থাকার পরামর্শ দেন। এরপর সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে, ফোন বন্ধ রেখে, ১০ জুন রংপুরেই আত্মগোপন করেন তিনি। তাকে মানসিকভাবে সঙ্গ দেওয়ার জন্য সঙ্গে থেকে যায় তার সঙ্গীরা। এদিকে তাকে খুঁজে না পেয়ে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী গণমাধ্যমে স্বামী নিখোঁজ বলে দাবি করেন। এরপর সক্রিয় হয়ে ওঠে উগ্রবাদী গোষ্ঠীদের প্রোপাগান্ডা মাধ্যমগুলো। তারা এই ঘটনার জন্য কখনো সরকার, কখনো দেশের আইনশৃঙ্খরা বাহিনী, আবার কখনো জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে টার্গেট করে অপপ্রচার চালাতে থাকে।

এদিকে, এক সপ্তাহের বেশি সময় পর, ফোন অন করার সঙ্গে সঙ্গে ত্ব হা আদনানের অবস্থান চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জানা যায়, রংপুরে নিজের প্রথম স্ত্রীর ভাড়া করার বাস ভবনে অবস্থান করছিলেন ত্ব হা। এরপর তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের অবগত করে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।

নূর-সাগর-পিনাকীদের সমস্যা কী:

মূলত যে কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে এই চক্রটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রাক্কালে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে, ঢাকায় বিক্ষোভের নামে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের উগ্রবাদীদের নিয়ে নাশকতা চালায় ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরের সংগঠন ছাত্র যুব শ্রমিক অধিকার পরিষদ। এরপরই ইস্যু সৃষ্টি করে দেশজুড়ে বর্বর তাণ্ডব চালায় হেফাজতের উগ্রবাদীরা। এসময় নুরুল হক নুর নিয়মিত ফেসবুকে উগ্র ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজ অব্যাহত রাখে।

এমনকি হেফাজতের তৎকালীর যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বেগানা নারীসহ প্রমোদরত অবস্থায় জনগণের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরেও, তাকে ইসলামী নেতা বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে নুর। একইসঙ্গে সরকার এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুসলামান নয় মর্মেও নিকৃষ্ট ফতোয়া দেয় সে। কিন্তু পরবর্তীতে মামুনুলের যাবতীয় তথ্য প্রমাণ ছড়িয়ে পড়লে, প্রসঙ্গ বদল করে অন্য দিকে চলে যায় নুর। কিন্তু জনগণের মধ্যে তথ্য প্রমাণ ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত দেশজুড়ে উগ্রবাদীদের মদদ দিতে থাকেন নুর।

এদিকে ত্ব হা আদনান আত্মগোপনের পর থেকেই এটি সরকারের এবং দেশের বিভিন্ন আইনশঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপানোর জন্য অনলাইনে প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকেন ফেস দ্য পিপল নামক ফেসবুক টকশোর সঞ্চালক সাইফুল সাগর। এর আগে, বিভিন্ন বিতর্কিত ওয়াজকারী বক্তাদের নিয়ে অনলাইনে প্রোগ্রাম করে তাদের পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করতো সে।

এদিকে দেশের ভেতর নুর-সাগর গংরা উগ্রবাদে মদদ দেওয়া শুরু করায়, বিদেশ থেকে আরো তৎপর হয়ে ওঠে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এজেন্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি এর আগেও দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য সেনাবাহিনী, পুলিশ,গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারকে নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার ছড়াতেন।