স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নথিপত্র চুরির ঘটনায় রোজিনা ইসলামের নাম এখন দেশজুড়ে পরিচিত। এই ঘটনাকে সাংবাদিকতার অংশ বলে প্রচার করে দেশজুড়ে আবেগ সৃষ্টি করা তার পক্ষে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জানা যাচ্ছে সেদিনের ঘটনার নেপথ্য কারণগুলো। সাংবাদিক হিসেবে নিজের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে সরকারের কাছ থেকে আগাম তথ্য সংগ্রহ করে, বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির কাছে তা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। এমনকি সাংবাদিকতার পেশাগত নৈতিকতার আদর্শের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) তোয়াক্কা না করে, করোনার মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বামীকে মিঠুকে নিয়ে দিয়েছেন শত কোটি টাকার কাজ। মন্ত্রণালয়, পুলিশ, সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। কিছু কিছু প্রমাণ অনলাইনেও প্রকাশ হয়েও পড়েছে।

কী তথ্য ছিল ওই নথিতে

অনুমতি ছাড়া সচিবের ব্যক্তিগত সহকারীর অনুপস্থিতিতে, তার কক্ষে ঢুকে, সরকারি নথি ঘাঁটা শুরু করেন রোজিনা ইসলাম। সেখান থেকে একটি ৬২ পৃষ্ঠার ফাইল খুঁজে বের করেন তিনি। ফাইলটিতে ছিল- বিদেশি ফর্মূলা অনুসারে দেশে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য কয়েকটি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য। অনেক কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি এর অনুমোদন চাইলেও, তিনটি কোম্পানিকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাকিরা পরবর্তী ধাপে নতুন করে চেষ্টায় আছে। এর বাইরে আরো কমপক্ষে দুটি কোম্পানি রয়েছে, যারা যৌথভাবে চীনের ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে চেয়েছে। এ নিয়ে বেশ দৌড়ঝাঁপ চলছে। তাই দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে এই নথির মূল অনেক।

এদিকে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের জন্য এখন পর্যন্ত শুধু একটির চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। সেটি হলো রাশিয়ার করোনা ভ্যাকসিন স্পুটনিক এবং বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি ইনসেপটা ফার্মার মধ্যে। বাকিগুলো অর্থাৎ চীনের সঙ্গে টিকার চুক্তির বিষয়টি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ইনসেপটা-স্পুটনিক ভ্যাকসিন চুক্তিটি বিকাশমান হওয়ায়, তা বানচাল করার জন্য উঠে পড়ে লাগে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলো।

এই বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘যে কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে, তাদের কাছে এই নথির মূল্য কোটি টাকা। বিশেষ করে যারা চীনের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, সেসব কোম্পানির কাছে এই নথিতে থাকা তথ্যগুলোর মূল্য অনেক। রোজিনা এদের মতো এক বা একাধিক ক্লায়েন্টের কাছে আগাম তথ্য সরবরাহের জন্যই নথি চুরি করা চেষ্টা করেছেন।’ ওই দিন রোজিনা ধরা পড়ার পর তাকে এসব এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা, কিন্তু রোজিনা অ্যারোগেন্সি দেখিয়ে এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যায় এবং একেকবার একেক রকম উত্তর দিয়েছেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি কর্পোরেট কোম্পানির কাছে আগাম তথ্য বিক্রি

এই কর্মকর্তা সেদিনের ঘটনার একটি সিসিটিভি-ফুটেজ দেন সাংবাদিকদের। সেখানে দেখা যায়, রোজিনা প্রথমে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ধরা পড়ার পর ভুল স্বীকার করেন এবং মুচলেকা দিয়ে মীমাংসা করার প্রস্তাব দেন।

এ বিষয়ে ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের সুশীল সমাজেরর লোকজন রোজিনাকে হিরো বানানোর যে চেষ্টা করছে, রোজিনা আসলে তা না। আবার প্রশাসন তাকে যেভাবে দেশবিরোধী ভিলেন বানাচ্ছে, রোজিনা আসলে সেটাও না। তিনি মূলত এই কাজটি করার জন্য কর্পোরেট কোম্পানির কাছ থেকে টাকা পান, তাই তিনি তাদের চাহিদামতো টিকা সংক্রান্ত তথ্যগুলো তাদের কাছে আগাম সরবরাহ করার জন্য কাজটি করেছেন। এটা কোনো সাংবাদিকতা না। সাংবাদিকতা পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে ঢুকে কর্পেোরেট কোম্পানির দালাল হিসেবে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন তিনি। এটা আসলে দালালি। ব্যক্তিগতভাবে অর্থ উপার্জন করার জন্য এটি করেছেন তিনি।’

তদন্ত সূত্রে আরো জানা যায়, এর আগেও ঠিকাদারদের দেওয়ার জন্য নৌমন্ত্রণালয়ের দরপত্রের কাগজ চুরি করেছিলেন তিনি। শত কোটি টাকার ব্যবসায় আগাম তথ্যের মূল্য অনেক। রোজিনার সঙ্গে এসব কর্পোরেট বসদের ভালো সম্পর্ক। তিনি তাদের চাহিদা অনুযায়ী আগাম তথ্য সরবরাহ করেন, এজন্য তিনি অর্থ পান।’

যেভাবে কোটি টাকার কাজ নেন রোজিনা ও তার স্বামী

রোজিনার স্বাস্থ্য খাতের সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার পর নিজের স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠুকেও ঠিকাদারির কাজ নিয়ে দেন। রোজিনার মাধ্যমে করোনার মধ্যে সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের জন্য শত কোটি টাকার কাজ পান মিঠু। এরমধ্যে একটি কাজই ছিল প্রায় ৩২ কোটি টাকার। তার কোম্পানিগুলো হলো- ওয়ান কন্সট্রাকশান, আরএম এন্টারপ্রাইজ এবং এসএস নেটওয়ার্ক। স্বামীর এসব কোম্পানিতে মালিকানার ভাগ রয়েছে রোজিনারও।

গোয়েন্দা ও পুলিশ জানায়, সাবেক স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে সুস্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন রোজিনা ও তার স্বামী। রোজিনাকে সহযোগিতা করতেন মন্ত্রণালয়েরই আরো দুই কর্মচারী। সাবেক সচিবের মাধ্যমেই শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। কিন্তু নতুন সচিব যোগদানের পর রোজিনার স্বামীর কোম্পানির কাজ পাওয়ায় প্রক্রিয়া এবং তাদের কাজের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফলে রোজিনার সঙ্গে সম্পর্কের তাল কেটে যায় মন্ত্রণালয়ের। এরপরই এই খাত নিয়ে নেতিবাচক রিপোর্টিং শুরু করেন রোজিনা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের শীর্ষ পত্রিকা প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে মানুষের মধ্যে বেশ পরিচিত এই রোজিনা ইসলাম। এটির মালিক ট্রান্সকম গ্রুপ। এদের আরেকটি কোম্পানি হলো এসকেএফ (এসকে+এফ) ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির কাছ থেকে এটি কিনে নেয় ট্রান্সকম। দেশের ওষুধ ব্যবসায় এই কোম্পানির অবস্থা বেশ রমরমা। সেই ধারাবাহিকতায় এটি এখন ওষুধের বাজারের শীর্ষস্থান দখলের প্রতিযোগিতায় রয়েছে।