ভোটে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই ২৫ মার্চের গণহত্যা, ভুট্টোর স্বীকারোক্তি

১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে ১৬৭ আসন পেয়ে উভয়-পাকিস্তানের একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি পায় মাত্র ৮১টি আসন। কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে বাহানা শুরু করে। ফলে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। এদিকে গণরায়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে জান্তাপ্রধান ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে) গণহত্যা চালানোর পরামর্শ দেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরবর্তীতে নিজের লেখা বইতে এই তথ্য জানিয়েছেন ভুট্টো।

১৯৭১ সালের এপ্রিলে, পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের পরাজিত পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো মিশরে যান। কায়রোতে গিয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাতের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নিজের লেখা একটি বই উপহার দেন। ভুট্টোর লেখা সেই বইটি ছিল প্রায় ১২৫ পাতার। বইটি খুব স্বল্প সংখ্যক কপি প্রকাশ করা হয়েছিল। বইটির একটি কটি সংগ্রহ করে, তা ফটোকপি করে জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেনকে এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দফতরে দফতরে পাঠান ভারতের একজন দূতাবাস কর্মকর্তা। ভুট্টো এই বইতে শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং বাঙালিদের প্রচুর নিন্দা করেছিলেন।

তিনি আরও লিখেছিলেন যে, ঢাকাতে তিনি ইয়াহিয়ার অনুরোধে গিয়েছিলেন বটে তবে মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না। শুধু তাই নয়, ভুট্টো এই বইতে লিখেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া খান তার পরামর্শেই পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিধান শুরু করেন।

বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর পর ভুট্টো মিশরের পাশাপাশি আরো কিছু মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র ভ্রমণে যান এবং নিজের লেখা বইটি সেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের উপহার দেন। তবে ভুট্টো কখনও ভাবতে পারেননি যে তার বইয়ের কপি সমর সেন কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর হাতে চলে যাবে।

পরবর্তীকালে, ১৯৭১ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে, জাতিসংঘে বক্তৃতার সময় সেন ভুট্টোর লেখা বইয়ের অংশ পড়ে প্রমাণ করেছিলেন যে- ২৫ মার্চ পাকিস্তানি জান্তা-বাহিনীকে হামলা করবার নির্দেশ ইয়াহিয়া খান দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ভুট্টোর লেখা বই অনুযায়ী কাজটি তিনি ভুট্টোর পরামর্শ অনুসারে করেছিলেন। এরপর জাতিসংঘের বৈঠকেই সবার সামনে ভুট্টো চিৎকার করে ওঠেন এবং সমর সেনের কাছে জানতে চান- তিনি বইটি কোথায় পেয়েছেন!

মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান সমর সেন। তার তৎকালীন সহকর্মী বিক্রমাদিত্যের লেখা ‘কনফিডেনসিয়াল ডায়েরি’তে তথ্য-উপাত্তসহ এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী অগ্নিগর্ভ সময়ে তিনি মিয়ানমারে কর্মরত ছিলেন।

এদিকে পাকিস্তানি খুনি জেনারেলরাও ২৫ মার্চের কালোরাতের বিষয়ে নিজেদের আত্মজীবনীতে লিখেছেন। যুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান ছিল জেনারেল এ কে নিয়াজী। তিনি নিজের লেখা ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানে। একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। চারিদিকে আর্তনাদ ও অগ্নিসংযোগ। ২৫ মার্চের সেই সামরিক অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুতাকেও ছাড়িয়ে যায়। বেসামরিক লোকজন হত্যা ও পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল টিক্কা খান।’

এই বর্বরোচিত গণহত্যায় ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিয়াজী এই গ্রন্থে আরো লেখেন, ‘২৫ মার্চ অভিযানের নির্দেশ দিয়ে সিভিল ড্রেসে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য ঢাকা ত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু ভুট্টো থেকে যায়। রাতভর সে এই ধ্বংসযজ্ঞ উপভোগ করে। সকালে ফরমান ও আরবাবকে পিঠ চাপড়িয়ে অভিনন্দন জানায়। ২৬ মার্চ দিনের বেলা ঢাকা ত্যাগ করে ভুট্টো। করাচিতে নেমে সে বলে: আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’