
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। যাদের ওপর যাকাত ফরজ, তাদের জন্য যাকাত দেওয়া অপরিহার্য কর্তব্য। তবে যাকাতকে কেন্দ্র করে মানুষ যেনো নিজেকে জাহির না করে এবং যাকাতের নামে ভুল স্থানে অর্থ অপব্যয় না করে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে শরিফে মুমিনদের সতর্ক করেছেন আল্লাহ। এছাড়াও যাকাত ও সাদকাতুল ফিতর (ফিতরা) দেওয়ার ক্ষেত্রে কাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেই ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ৮টি খাত উল্লেখ রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন: নিশ্চয়ই যাকাত হলো কেবল ফকির-মিসকিন, যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী, নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে নিমগ্ন ব্যক্তি ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথসন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী। সূত্র: (সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৬০)।
এই ৮টি খাতের মধ্যে যুগচাহিদা ও গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাকাতের প্রধান উদ্দেশ্য যাকাতের হকদার ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আর্থিক অসঙ্গতি দূর করা।
যাকাতের মাসাআলায় আরো বলা হয়েছে: যাকাত গ্রহণকারীকে একথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে। যাকাতের অর্থ বা মাল দেওয়ার ক্ষেত্রে মনে মনে যাকাতের নিয়ত করলেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আপন ভাই-বোন গরিব হলে তাদের যাকাত দেওয়া যাবে এবং তাই আগে উচিত। সূত্র: (রদ্দুল মুহতার ২/২৬৮)।
যাকাতগ্রহীতা যদি আত্মীয়স্বজন, আপনজন বা পরিচিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি (যিনি এখন আর্থিকভাবে চলতে অক্ষম) হন, তাহলে যাকাত উল্লেখ করাটা মোটেই সমীচীন হবে না। কারণ, এতে যাকাতগ্রহীতা অপমানিত, অসম্মানিত ও বিব্রত বোধ করবেন। যাকাত দেওয়ার সময় মানুষকে হেয় করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এটি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আদায় করতে বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। যাকাত দানের ক্ষেত্রে শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে যাকাতের নিয়ত করাটাই যথেষ্ট।
যাকাত-ফিতরার প্রকৃত হকদার কারা
যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো- উপযুক্ত (অভাবী) ব্যক্তিকে সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়া, যাতে সে নিজের খুশি মতো তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি যাকাতদাতা নিজের খুশি মতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকাটি খরচ করে- যেমন: তার ঘর সংস্কার করে দেওয়া, টয়লেট স্থাপন করে দেওয়া কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা, তাহলে যাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার ২/২৫৭)।
যাকাতের টাকা যাকাতের হকদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের টাকা নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে, অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে, যাকাত আদায় হবে না। যেমন: রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুত-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি করে যাকাত আদায় হয় না। যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামি মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।
নিয়ম হলো- যাকাতের টাকা দরিদ্র ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেওয়া। সেই টাকা দিয়ে সে তার অভাব মোচন করবে, সচ্ছল হয়ে উঠবে, ভবিষ্যতে নিজে যাকাত দেবে। আত্মীয়-স্বজন যদি যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের যাকাত দেওয়াই উত্তম। ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগনে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়রা যাকাতের হকদার হলে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া যাবে। দেওয়ার সময় যাকাতের কথা উল্লেখ না করে, মনে মনে যাকাতের নিয়ত করলেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম।
সূত্র: (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদিস ৭১৬০,৭১৬১,৭১৬৪,৭১৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪২-৫৪৬)
সাদকাতুল ফিতর বা ফিতরার মাসআলা
যাকাত ও সদাকাতুল ফিতর প্রদানে যাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম, তাদের প্রসঙ্গে সরাসরি নির্দেশনা দেওয়া আছে কোরআন শরিফে। যাকাত দিতে বলা হয়েছে এমন মানুষকে, ‘যারা অভাবী লোক, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে উপার্জনের জন্য দুনিয়া চষে বেড়াতে পারেন না। এমন লোক, যাদের সম্ভ্রান্ততার কারণে বাইরে থেকে অভাবহীন মনে হয়, তারা মানুষের কাছে নির্লজ্জভাবে ভিক্ষা করে না।
আর তোমরা যে কোনো উত্তম জিনিস ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সে বিষয়ে অবগত আছেন।’ তাই যাকাত ও ফিতরা বিতরণের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। [সূত্র:সুরা বাকারা, আয়াত ২৭৩]
যাকাত কাদের দেবেন, কী দেবেন
যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে, তার চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত দেওয়া ফরয। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে।
সূত্র: (সুনানে নাসায়ী হাদিস ২২৩০-২২৩৩; সুনানে আবু দাউদ হাদিস ১৫৭০-১৫৭২; সুনানে তিরমিযী হাদিস ৬২৩; সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস ১৮০৩ ; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদিস)।
কিন্তু কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হলে, সেটা যাকাত হিসেবে আদায় হবে না। যেমন: রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুত-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি করে যাকাত আদায় হয় না। এমনকি যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামি মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।
সূত্র: (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদিস ৭১৬০,৭১৬১,৭১৬৪,৭১৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪২-৫৪৬)
যাকাতের টাকা বা মাল দিতে হয় দরিদ্র ব্যক্তিকে। যারা যাকাতের হকদার, এই দান সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের প্রাপ্য। এর উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তি বা পারিবারের অভাব মোচন করা, তাদের আর্থিক অসঙ্গতি দূর করা; যাতে ভবিষ্যতে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরাও যাকাত দানের সামর্থ্য অর্জন করেন। এভাবে সমাজের দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং সাম্যাবস্থা সৃষ্টি করাই যাকাত প্রদানের উদ্দেশ্য।
যাকাতের বিষয়ে আল্লাহর সতর্কতা
যাকাতের বিষয়ে পবিত্র কোরআন-এ মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। এটি যেনো লোক দেখানো না হয় এবং এর উদ্দেশ্য যেনো ঠিক থাকে, সেই প্রসঙ্গে সুরা বাকারার ২৭২ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘… এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ব্যয় করে থাক। যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর, তার পুরস্কার তোমাদের পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।’
তবে লোক দেখানোর জন্য বা প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্য যাকাতকে ব্যবহার করার ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কোরআনে। সুরা বাকারার ২৬৪ নম্বর আয়াতে আরো বলা আছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না, ওই লোকের মতো যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর।