হিলারি

বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নারীদের অন্যতম মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। তবে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এক ঘৃণ্য চরিত্র। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলায় নগ্ন সমর্থন দেয়ায় জার্মানির বার্লিনে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়েন হিলারি। দর্শকরা তাকে যুদ্ধাপরাধী ও ভণ্ড বলে দুয়োধ্বনি দেন। গত ৪ মাসে প্রায় ৩০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে গাজায়, আহত প্রায় ৭০ হাজার। এই প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিলারিকে প্রশ্ন করেন গাজায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ায় তিনি মর্মাহত কিনা? নির্বিকার হিলারি জবাব দেন, ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে? যুদ্ধে তো এটাই ঘটে।’

লিংক:
বার্লিনে হিলারিকে দুয়োধ্বনি

হিলারির বক্তব্যে দর্শকরা ক্ষুব্ধ হন। এক দর্শক চেঁচিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনিরা মরছে যখন, আপনি তখন মানবাধিকারের কথা বলছেন, অথচ মানবাধিকার রক্ষায় কিছুই করছেন না। লজ্জা করে না আপনার? আরেক ক্ষুব্ধ দর্শক বলেন, ‘ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় আপনারা অর্থ দিয়ে আবার নারী অধিকারের কথা বলেন? ওখানে মার্কিন অর্থায়নে গণহত্যা চলছে, এখানে আপনি শান্তির জন্য সিনেমার কথা বলছেন। আমরা তো আপনার তৈরি গণহত্যার সিনেমা দেখছি।’ অপর এক ক্ষুব্ধ দর্শক বলেন, আপনি আফগানিস্তান, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন। আপনি যুদ্ধাপরাধী, আপনি ভণ্ড, লজ্জা করে না আপনার? অবস্থা বেগতিক দেখে ক্ষুব্ধ দর্শকদের অডিটরিয়াম থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়।

হিলারি সম্পর্কে:

১৯৯৭ সালে হিলারি ক্লিনটন আমেরিকার সেরা সঙ্গীত পুরস্কার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। এটা ছিল নন-মিউজিক্যাল বিভাগে। `ইট টেকস আ ভিলেজ` শিরোনামে হিলারির লেখা বইয়ের অডিও সংস্করণ এ বিভাগে বিজয়ী হয়। বইয়ের মূল বিষয় ছিল শিশুদের বৃদ্ধি এবং শিক্ষা। আইরনি হলো, হিলারি নিজ স্বার্থে এতই বুঁদ যে, ফিলিস্তিনে গত চার মাসে নিহত ১২ হাজার শিশুর রক্ত তার হাতে লেগে আছে। তাদের বৃদ্ধি ও শিক্ষা দূরে থাক, বেঁচে থাকার অধিকার নিয়েও চিন্তিত নন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর উত্থানের পেছনেও হাত রয়েছে হিলারির। উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া নথিতে সেই প্রমাণও মিলেছে।

লিংক:
Hillary Rodham Clinton has also won a spoken-word Grammy.

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হিলারির ষড়যন্ত্র:

বিএনপি-জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে ইউনূস তার বান্ধবী হিলারিকে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোন করান। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধের অপচেষ্টা করেন তিনি। আন্তর্জাতিক মানদন্ডের ধুয়া তোলেন। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশিট তৈরি করা হয়েছিল। সেই ৭১-এর সময় থেকেই দেশবাসী তাদের অপরাধ সম্পর্কে জানেন। দালাল আইনে আটক ছিল তাদের অনেকেই, বাকিরা ছিল পলাতক। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে সব যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে দেন। শেখ হাসিনা নির্দয় ছিলেন না। আইনি প্রক্রিয়ে মেনে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের আদলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আইন সংশোধন করান।

যুদ্ধাপরাধীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়া হয়। যা নজিরবিহীন। তবুও ইউনূস তার বান্ধবী হিলারিকে দিয়ে ফোন করিয়ে চাপ সৃষ্টি করেন। জাতিসংঘের মহাসচিবও শেখ হাসিনাকে ফোন করে বিচার বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু হিলারি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করেন। যুদ্ধাপরাধী আর যুদ্ধাপরাধী যে বন্ধু, তার প্রমাণ দিলেন হিলারি। বললেন- এই বিচার বন্ধ না করলে পরিণতি ভালো হবে না, শেখ হাসিনার রাষ্ট্রক্ষমতা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে ইত্যাদি। কিন্তু শেখ হাসিনা কিছুই গ্রাহ্য করেননি। যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া মেনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান।

পাত্তা না দেয়ায় সেই অপমান ভোলেননি হিলারি। শোধ নিতে পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বেনামি ইমেইলে পাঠানো একটা কাল্পনিক অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে আখ্যা দিয়ে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়া হয়। যার প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। সেসময় ইউনূস, হিলারি ছাড়াও সিআইএ’র মদদপুষ্ট বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ দৈনিক পত্রিকা এবং তাদের ভাড়াটে কলামিস্টরা প্রতিদিন নিয়ম করে এই কাল্পনিক অভিযোগ নিয়ে রঙ মেশানো সংবাদ পরিবেশন করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা শুরু করে। এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারের মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ করে তাদের সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। তবুও অবিচল ছিলেন শেখ হাসিনা। চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন পাল্টা।

পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব অভিযোগ কানাডার আদালতে ভুয়া প্রমাণ হয়। সবার নাকের ডগায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পন্ন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। যা ছিল সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনিদের জন্য বিশাল পরাজয়। হিলারি একে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নেন। উইকিলিকস বলছে, ড. ইউনূস হিলারির নির্বাচনী ফান্ডে ৬০ লাখ ডলার দিয়েছেন। বলা হয়েছে, কেবল ইউনূস একা নন, জামায়াত ও বিএনপিও হিলারির নির্বাচনে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। হিলারি ও তার স্বামী প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বদান্যতায় ইউনূস নোবেল পেয়েছিলেন। যা হিলারি নিজে শেখ হাসিনাকে টেলিফোন আলাপে উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ইউনূস তাদের কত বড় বন্ধু। এসব তথ্যও রয়েছে উইকিলিকসে। এখনো ইউনূসের হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়ম, মানিলন্ডারিং, শ্রমিকশোষণসহ লজ্জাজনক অপরাধগুলোর বিচার বন্ধ করতে হিলারি প্রচুর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন বাংলাদেশের ওপর।

লিংক:

 

যুদ্ধবাজ হিলারি:

হিলারির আরও কিছু কুকীর্তি দেখা যাক। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় হিলারি ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজ হিসেবে আবির্ভূত হন। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বিস্তারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ব্যক্তিগতভাবে সিআইএ’র পরিচালক ডেভিড পেত্রাউসের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষ বিষয়টি ফাঁস করে দিতে পারে ভেবে ঐ প্রস্তাব হোয়াইট হাউজ নাকচ করে। যদিও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সিরিয়ায় অস্ত্র পৌঁছানো হয় বিদ্রোহীদের।

ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধের অন্যতম হোতা পেত্রাউস ছিলেন হিলারির অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরে তাকে সিআএই’র পরিচালক করেন হিলারি। বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে নিজেদের স্বার্থে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দেয়া হতো পেত্রাউসের মাধ্যমে। সংঘাত জিইয়ে রাখতে হিলারি-পেত্রাউস বিদ্রোহীদের লালন-পালন করেন। পরকীয়া ইস্যুতে পেত্রাউসের পদত্যাগের প্রেক্ষিতে হিলারি মানসিক আঘাত পেয়ে মূর্ছা যান। ফলে মাসখানেক বিশ্রামে থাকতে হয় তাকে। এসময় সিরিয়ায় আসাদবিরোধী মার্কিন গোপন অপারেশন ভেস্তে যায়।

লিংক:
হিলারি ক্লিনটনের সাফল্য ও ব্যর্থতা :একটি পর্যালোচনা

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করেন হিলারি। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমনের জন্য নানাবিধ সহায়তা দেন। যার ভয়াবহ পরিণাম দেখা গেছে আরাকানে। জান্তার সাথে সম্পর্ক রেখে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করার নেপথ্যে রয়েছেন হিলারি। চীন যেন মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেজন্য জান্তাকে মার্কিন বলয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সাল আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণবিপ্লব উস্কে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এখানেও রয়েছেন হিলারি। শুরুটা হয় তিউনিসিয়া থেকে। এরপর তা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। ফলে মাত্র পৌনে ২ বছরে লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনে জিডিপির ক্ষতি হয় আড়াই হাজার কোটি ডলারের। এসব অঞ্চলে যে গণঅভ্যুথান হয়েছে তা নজিরবিহীন।

আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিশর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরনের সংঘাত হয়েছে। ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়াসহ কয়েকটি দেশে ঘটেছে সংঘর্ষ। তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের ফলে শাসক জেন এল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে। তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। মিশরের বিদ্রোহে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক পদত্যাগ করেন। যিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অতি ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু তার কদর ফুরিয়েছিল মার্কিনিদের কাছে।

একই সাথে জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ নতুন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন। ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলী আব্দুল্লাহ সালেহও তার ৩৫ বছরের শাসনের ইতি ঘটান। অবসান ঘটে লিবিয়ায় মার্কিন পুতুল মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের। এসব গণঅভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে। সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীনদের পতন ঘটায়। এই আরব বসন্তের ফলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হয় এই দেশগুলোতে।

লিংক:

আরব বসন্তের ভয়াবহ স্বরূপ

এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজ হিলারি ক্লিনটন। কোটি কোটি মানুেষর রক্ত ঝরানোর পেছনে দায়ী তিনি। বাস্তুহারা, সহায়-সম্বল হারিয়ে শরণার্থী, সন্তানহারা পিতা-মাতা কিংবা সবাইকে হারানো এতিম শিশুদের দুর্ভাগ্যের মূলনায়ক হিলারি। গত কয়েকবছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাদেশে একটি বাংলা বসন্ত ঘটানোর। বন্ধু ইউনূসের মাধ্যমে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন হিলারি এখনো।

বিশ্বের দেশগুলোকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিলে লাভ কার?

সদ্যপ্রয়াত সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, কেউ যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হলে সেটা তার জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু কেউ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হলে সেটা হবে ভয়াবহ ব্যাপার। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হতে হলে তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। মার্কিনিরা বন্ধুর জন্য অনেক কিছু করে। কিন্তু বিনিময়ে আদায়ও করে নেয়। শত্রুর সাথে সম্পর্ক তো একবারেই শেষ, শত্রু খতমের সাথে। কিন্তু বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে সবসময় গিভ এন্ড টেকের মাঝে থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে কারো জন্য কিছু করে না। বন্ধু থেকে প্রাপ্তির কিছু থাকলে, বন্ধুকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ থাকলেই যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসে। তবে যাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা দুরূহ হয়ে ওঠে, তার সাথে বন্ধুত্বের অবসান ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। সম্পর্কচ্ছেদ করলেও তাকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে যায় না। তার চূড়ান্ত ধ্বংস করে ছাড়ে।

উদাহরণ- ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন মার্কিনিদের খুব ভালো মিত্র ছিলেন। ইরানের বিরুদ্ধে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতেই সাদ্দামকে বন্ধু বানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই ইরাককে মাটিতে মিশিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সাদ্দামকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দিয়েছিল সম্পূর্ণ বিনা কারণে। একই অবস্থা করেছে লিবিয়ারও। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের বড় মিত্র ছিলেন গাদ্দাফি। সিআইএ’র অনেক এজেন্টের গোপন আস্তানা ছিল লিবিয়ায়। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সিআইএ’র নির্দেশে গাদ্দাফি সেই খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন লিবিয়ায়। স্বার্থ উদ্ধারের পর লিবিয়াকেও মাটিতে মিশিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। গাদ্দাফিকে হত্যা করেছে মার্কিন সেনারা।

আফগানভিত্তিক উগ্র জঙ্গিদের যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। খনিজসম্পদে ভরপুর আফগানিস্তানের ওপর অনেক বছর ধরেই শকুনের নজর যুক্তরােষ্ট্রর। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য সুবিধা করতে পারছিল না। প্রশিক্ষণ, সমরাস্ত্র দিয়ে আফগান মুজাহিদদের সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরসহ কুখ্যাত সব জঙ্গির উত্থান মার্কিনিদের হাতেই। পরের ইতিহাস সবার জানা। ৯/১১-এর প্রেক্ষিতে নিজেদের হাতে গড়া ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আল-কায়দাকে দমনের নামে আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্র। লাদেনকে হত্যার জন্য পাকিস্থানের ভেতরে অপারেশন চালায়। যেসব দেশে ধর্মকে পুঁজি করে মার্কিনিরা নিজ স্বার্থ উদ্ধারে নেমেছিল, সেসব দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। ধর্মীয় উন্মাদনার যে বীজ বপন করেছে তারা, তার খেসারতও দিতে হয়েছে তাদের। তবে খেসারতের তুলনায় লাভের পরিমাণই বেশি।

লিংক:

অস্ত্র ও যুদ্ধ ব্যবসাই যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধির ভিত:

মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন ইত্যাদি নানারকম গালভরা বিষয়ের নামে বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধ-অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন মদদে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও জিইয়ে রেখেছে তারা। মার্কিন প্রশাসন ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে নিজ বলয়ে থাকা মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে, যেন ইউক্রেনকে সহায়তা করে। বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি, যুদ্ধ-বিগ্রহে লাভ মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। যদি কূটনৈতিক অবস্থানের কারণে সরাসরি অস্ত্র দিতে না পারে, তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে সেখানে অস্ত্র বিক্রি করা হয়।

যুদ্ধ রপ্তানি, চরমপন্থী মতাদর্শ এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা উস্কে দেয়ার মাধ্যমে সারাবিশ্বে রক্তপাত ও অশান্তির পথ তৈরি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একচেটিয়া ক্ষমতার বলয় তৈরির চেষ্টা চালায় দেশটি। মার্কিন ইতিহাসবিদ পল অ্যাটউডের মতে, ‘যুদ্ধ হলো আমেরিকান জীবনযাত্রা। জন্ম, বেড়ে ওঠার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তিও হয়ে উঠেছে যুদ্ধ, দাসত্ব এবং মানবহত্যা থেকে।’

১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই স্বাধীনতার পর থেকে গত আড়াইশ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১৬ বছর কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। পরিসংখ্যান বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫৩টি স্থানে সংঘটিত ২৪৮টি সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে ২০১টি শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা মোট সংঘটিত যুদ্ধ-সংঘাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া ২০০১ সাল থেকে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানে নিহত হয়েছেন ৮ লাখেরও বেশি মানুষ, অসংখ্য মানুষ হয়েছেন বাস্তুচ্যুত। বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের গণতন্ত্রের বেহাল দশা উপেক্ষা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বিভিন্ন দেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে নিজেদের যুদ্ধাপরাধ ধামাচাপা দিচ্ছে। তারাই মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়ে বিশ্বশান্তিকে হুমকিতে ফেলেছে।

লিংক:
বিশ্বকে যুদ্ধমুখী করছে কারা?

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার স্বীকার করেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে যুদ্ধবাজ জাতি।’ অধ্যাপক লি হাইডংয়ের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যুদ্ধ তাদের সমৃদ্ধি আনতে সক্ষম। যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে গতিশীল রাখে, যা দেশটির আড়াইশ বছরের ইতিহাসে ঐতিহ্যের অংশ।’ স্বাধীন মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক সিকিউরিটি পলিসি রিফর্ম ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শীর্ষ ৫টি অস্ত্র কোম্পানি- রেথিয়ন, লকহিড মার্টিন, জেনারেল ডাইনামিক্স, বোয়িং এবং নর্থরপ গ্রুম্যান– মোট ২.০২ ট্রিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। ‘ক্যাপিটালাইজিং অন কনফ্লিক্ট: হাউ ডিফেন্স কন্ট্রাক্টরস অ্যান্ড ফরেন নেশনস লবি ফর আর্মস সেলস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা দেশটির রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লবিংয়ের জন্য তাদের প্রচারাভিযানে ২৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২ শতাধিক সাবেক সরকারি লবিস্ট নিয়োগের জন্য আড়াই বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।

এটাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। ডেমোক্রেট হোক বা রিপাব্লিকান, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের রাষ্ট্রনীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই মার্কিনিদের সাথে হাত মেলানোর আগে তাদের পুরনো মিত্রদের করুণ পরিণতির কথা স্মরণ রাখা উচিৎ সবারই।

আরও পড়ুনঃ