নির্বাচন

নির্বাচনের নামে বিএনপির একতরফা রঙ্গ-তামাশার নির্লজ্জ ইতিহাস

১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯, ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশে তখন বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা স্বঘোষিত ও দখলদার রাষ্ট্রপতি স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন চলছে। রাষ্ট্রের সংবিধান পুরোপুরি অকার্যকর। সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সামরিক আইনের ফরমানে। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ইতিহাসেরdownload 2 নির্বাচনের নামে বিএনপির একতরফা রঙ্গ-তামাশার নির্লজ্জ ইতিহাস নৃশংস জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অসংখ্য কেন্দ্রীয় নেতা হত্যা ও গুমের শিকার, হাজারো নেতাকর্মী কারাগারে বন্দী এবং পালিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রাণের ভয়ে। সারাদেশে রীতিমত ফরমান জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা নিষিদ্ধ শব্দ হিসেবে তালিকাভুক্ত। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের ভয়ে যেখানে জীবন বিপন্ন, সেখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণের চিন্তা তো প্রশ্নাতীত!

শেখ হাসিনা তখনো নির্বাসিত। তাঁর অবর্তমানে আবদুল মালেক উকিল তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক। দলের ২য় ও ৩য় সারীর নেতাকর্মী নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় দল। বিনা লড়াইয়ে যুদ্ধের ময়দান কাউকে ছেড়ে দেওয়া হবে না- এই মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর কর্মীরা সেদিন নির্বাচন করেন। দিনের বেলায় অধিকাংশ স্থানে প্রচার-প্রচারণা করা যেত না। নির্বাচনী ক্যাম্প জ্বালিয়ে দেওয়া হতো, নৌকার মিটিং, মিছিল করা যেত না। অধিকাংশ প্রার্থী রাতের আঁধারে ৫/৭ জন কর্মী দিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে ভোটের প্রচার করতেন।

বিএনপির গুণ্ডাপাণ্ডাদের সহিংস হামলা, মামলায় অধিকাংশ কেন্দ্রে ভালোভাবে এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারেনি আওয়াম লীগ। যেসব আসনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সমর্থন ছিল, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা ছিল যেসব আসনে, সেসব জায়গায় শত শত কেন্দ্র থেকে সন্ত্রাস-অরাজকতার মাধ্যমে নৌকার ভোটারদের বিতাড়ন করা হয়। সরকার ও প্রশাসন তাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও অনেক কেন্দ্রের ব্যালট বক্স ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্র ও বোমাবাজির মাধ্যমে ত্রাসের সঞ্চার ঘটিয়ে।

সরেজমিন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেসময় ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত, এমন অনেকের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতি বিশ্লেষক জামিল হাসান তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেন এভাবে-

“আমি নিজেই আমাদের বাসার পাশের স্কুল কেন্দ্রে সেদিনকার বিএনপির গুণ্ডাপাণ্ডাদের সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী। আমার বাসার পাশে চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থল আন্দরকিল্লার এমইএস হাইস্কুল কেন্দ্র (আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের বাসার সামনে) ছিল নৌকার ভোটারদের ঘাঁটি। মূলত হাজারী গলির অধিবাসীরাই এই কেন্দ্রের ভোটার। ৮০% হিন্দু ভোটার। সকালে ভোট শুরু হওয়ার পর থেকে দলে দলে নৌকার ভোটার আসা শুরু হয়। ধানের শীষের প্রার্থী আরিফ মইনুদ্দিনের বাসা ছিল এই এলাকায়। সকাল ১১টার পর থেকে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সলিমুল্লাহ, ফয়জুল্লাহ, বডিবিল্ডার মুরাদ (অন্যদের নাম এখন মনে পড়ছে না) অস্ত্রসহ ২/৩টা জীপ গাড়ি নিয়ে বিএনপি কর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক ভোটাররা খালি হাতেই সেদিন রুখে দিয়েছিল তাদের। সাথে ছিলেন মহিলারাও। এভাবে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে হামলা আর প্রতিরোধ।

কেউ ভোটকেন্দ্র ছেড়ে সরে যাননি বিকেল পর্যন্ত। ব্যালট বক্স ছিনতাই করতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপির কর্মীরা পালিয়ে যায়। বিকেলে ভোট গণনা চলার সময় সলিমুল্লাহ তার লাল জীপ গাড়ি নিয়ে আবার ফিরে আসে। এবার সাথে ছিল এক ট্রাক পুলিশ। পুলিশের সহযোগিতায় ব্যালট বক্স জীপে তুলে নিয়ে যায়। বডিবিল্ডার মুরাদের নাম মনে আছে, লাল গেঞ্জি গায়ে বিশাল আকারের একটা কিরিচ নিয়ে সবচেয়ে আগ্রাসী ছিল সে। অনেককে আহত করেছিল সে। ভোটের এক মাসের মধ্যে গলায় ফাঁ স দিয়ে আ ত্ম হ ত্যা করেছিল মুরাদ।”

[নির্বাচনের নামে বিএনপির একতরফা রঙ্গ-তামাশার নির্লজ্জ ইতিহাস]

জামিল হাসান আরও বলেন, “এমন বৈরি পরিবেশে নির্বাচন করেও ২৫% ভোট পেয়ে ৩৯টি আসনে নৌকা জয়লাভ করে, স্বৈরাচার জিয়ার সামরিক সরকার শত চেষ্টা করেও নৌকাকে ঠেকাতে পারেনি। অনেক আসনে নৌকা প্রতীক জয়লাভ করার পরও জিয়ার ইশারায় নির্বাচন কমিশন সেই প্রার্থীদের পরাজিত ঘোষণা করে। যেমন- জামালপুরে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে প্রথমে বিজয়ী ঘোষণা হয়েছিল। পরবর্তীতে গভীর রাতে এক কেন্দ্রে ভোট পুনঃ গণনার পর ফলাফল উল্টে দেয়া হয়। ৩০০ ভোটে নৌকাকে পরাজিত করে ধানের শীষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। ৩৯ জন বিজয়ী নৌকার প্রার্থীর মাঝ থেকে ময়মনসিংহের জেলা নেতা আসাদুজ্জামান খান সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন।”

এখন দেশে এত অবারিত সুযোগ, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ চ্যানেল। প্রতি সেকেন্ডের খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ সব ইস্যু মুহূর্তেই বিদেশিদের কানে তোলা যায়। তবুও পরাজয়ের ভয়ে বিএনপি ও তাদের লেজুড় দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ভয় পায়! মেরুদন্ডহীন রাজনৈতিক দল এমনই হয়।

২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯ || বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীদের তালিকা

১। সিরাজুল ইসলাম. দিনাজপুর-২
২। গোলাম রহমান শাহ, দিনাজপুর-৬
৩। সতীশ চন্দ্র রায়, দিনাজপুর-৭
৪। শাহ মাহাতাব আহমদ, দিনাজপুর-৮
৫। মোহাম্মদ আমিন, রংপুর-২
৬। শামসুল হক চৌধুরী, রংপুর-১৩
৭। লুৎফর রহমান, রংপুর-২০
৮। ইমাজউদ্দিন প্রমাণিক, রাজশাহী-৭
৯। আব্দুল লতিফ খান, খুলনা-৪
১০। প্রফুল্ল কুমার শীল, খুলনা-৫
১২। সালাহউদ্দিন ইউসুফ, খুলনা-৯
১৩। সিদ্দিকুর রহমান, পটুয়াখালী-২
১৪। হাবিবুর রহমান মিয়া, পটুয়াখালী-৫
১৫। আ ষ ম ফিরোজ, পটুয়াখালী-৬
১৬। নজরুল ইসলাম, বাকেরগঞ্জ-২
১৭। এস এম নজরুল ইসলাম, বাকেরগঞ্জ-৩
১৮। সুধাংশু শেখর হালদার, বাকেরগঞ্জ-১৪
১৯। মহিউদ্দিন আহমেদ, বাকেরগঞ্জ-১৭
২০। রাশেদ মোশাররফ, জামালপুর-২
২১। করিমুজ্জামান তালুকদার, জামালপুর-৩
২২। সৈয়দ আবদুস সোবহান, জামালপুর-৫
২৩। জালাল উদ্দিন তালুকদার, ময়মনসিংহ-১২
২৪। মোশাররফ হোসেন, ময়মনসিংহ-১৩
২৫। আবদুল মোমিন, ময়মনসিংহ-১৬
২৬। আসাদুজ্জামান খান, ময়মনসিংহ-১৮
২৭। শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, ফরিদপুর-৪
২৮। কাজী আবু ইউসুফ, ফরিদপুর-৭
২৯। আক্তার মিয়া, ফরিদপুর-৮
৩০। কাজী আবদুর রশিদ, ফরিদপুর-৯
৩১। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ফরিদপুর-১০
৩২। ফণিভূষণ মজুমদার, ফরিদপুর-১১
৩৩। শওকত আলী, ফরিদপুর-১৫
৩৪। ইনামুল হক চৌধুরী, সিলেট-৬
৩৫। সিরাজুল ইসলাম, সিলেট-১২
৩৬। আবদুল জব্বার, সিলেট-১৩
৩৭। মো. জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া, কুমিল্লা-১৬
৩৮। এ বি সিদ্দিক, কুমিল্লা-২১
৩৯। এ বি এম তালেব আলী, নোয়াখালী-৩
৪০। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, চট্টগ্রাম-১২**

** নির্বাচনে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে পরাজিত ঘোষণা করে বিএনপির উকিল শাহাদাত হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে আখতারুজ্জামান বাবু নির্বাচনী ট্রাইবুনালে মামলা করেন। প্রায় ৩ বছর পর রায়ে আদালত তাকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে এমপি হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই দেশে আরেক স্বৈরাচার এরশাদের সামরিক আইন জারি হয়ে যায়। আর ২য় জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘটে।

বি.দ্র: উপরোক্ত তালিকার সাথে উইকিপিডিয়ায় থাকা তালিকার মিল নেই। উইকিতে অনেক তথ্য বিভ্রাট আছে।

 

আরও পড়ুনঃ