বিচার

নিজেদের পুরো শাসনামলে (২০০১-২০০৬) হাজার হাজার সংখ্যালঘু নাগরিক ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপর নির্বিচারে নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ, তুলে নিয়ে গিয়ে গুম-খুন, পুলিশি নির্যাতনে এবং রাজনৈতিক হামলায় জবাই করে বা হাত-পায়ের রগ কেটে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া, সমুদ্রসম দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, অর্থপাচারসহ এমন কোনো অপকর্ম ছিল না, যা করেনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে জোট সমর্থক পাড়ার ছিঁচকে কর্মীরাও বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং সংখ্যালঘুরা নিজের বাড়িঘরেও থাকতে পারতেন না। নিপীড়নের বিরুদ্ধে মামলা করা যেত না, থানায় গেলে উল্টো হয়রানি করা হতো সরকারের নির্দেশে, সেইসাথে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পুরো পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়া হয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট জানত, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার চাপে অথবা দেশি বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে যদি মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, তবে বিপদ ঘটতে পারে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও একটি চাপ তৈরি হচ্ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। আর সে কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃবৃন্দ তাগিদ অনুভব করেছেন নিজেদের দুর্নীতি ও অপশাসন ধামাচাপা দিতে আইন ও বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া উপায় নেই। সেজন্য তারা বিচার বিভাগে নিজস্ব আজ্ঞাবহ লোক নিয়োগ করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় সেই আজ্ঞাবহ দুর্নীতিপরায়ণদের নিয়োগ নিয়ে। যে বিষয়ে মার্কিন দূতাবাস থেকে গোপন তারবার্তা পাঠান তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস। যা উইকিলিকসের বরাতে ফাঁস হয়েছিল। এখানে সেই তারবার্তা বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

উইকিলিকস-এ ফাঁস হওয়া মার্কিন সেই গোপন তারবার্তা:

তারবার্তা নং- ০৬, ঢাকা- ৫৪২২, তারিখ: ২৪শে আগস্ট ২০০৫; সময়: ১২:১৭ অপরাহ্ন, শ্রেণি: কনিফডেন্সিয়াল
বিষয়: বিচার বিভাগের ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তির ওপর আঘাত
তথ্যসূত্র: লিংক: https://wikileaks.jcvignoli.com/cable_06DHAKA5422

১. (এসবিইউ) সারসংক্ষেপ: হাইকোর্টে ১৭ জন সন্দেহজনক চরিত্রের বিচারক নিয়োগ এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরুদ্ধে আরও দুটি দুর্নীতির অভিযোগ বাদ দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সুনাম আরও কালিমালিপ্ত হয়েছে। সারসংক্ষেপ শেষ।

মন্দ খ্যাতির বিচারকগণ:

২. (এসবিইউ) ২৩শে আগস্ট হাইকোর্টের নবনিযুক্ত ১৭ জন বিচারপতি শপথ গ্রহণ করেন। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ও কামাল হোসেনের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ সরকারের এই নিয়োগকে রাজনৈতিক এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর বলে নিন্দা জানিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি এসব নিয়োগ বাতিল করার দাবিতে একটি মিছিল করেছে এবং বিশেষভাবে বিতর্কিত বিচারপতি ফয়েজকে বর্জন করার হুমকি দিয়েছে।

৩. (এসবিইউ) এই বিচারকদের সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ ব্যাপক বিস্তৃত। সরকারের দুটি সংস্থাকে পরামর্শ দেন এমন একজন ব্যরিস্টার, যার সম্পর্কে দূতাবাসের ইতিবাচক ধারণা রয়েছে, তার ভাষ্য অনুযায়ী এই ১৭ জন বিচারক ব্যতিক্রমী মাত্রায় নিম্নমানের বিচারিক দক্ষতার জন্য কুখ্যাত। তিনি বলেন, এর আগে যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ আছে এমন যেসব বিচারককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের ভারে হাইকোর্ট ইতিমধ্যে ক্লিষ্ট এবং যোগ্যতাসম্পন্ন বিচারকের অভাবে সেই সব বিচারকের মামলাগুলো আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যারা মামলা নিষ্পত্তিতে পারঙ্গম, বিশেষত টেকনিক্যাল বিষয়ের মামলাগুলো যাদের ছাড়া নিষ্পত্তি হয় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোম্পানি ট্রেডমার্ক, অ্যাডমিরালটি ও এ সংক্রান্ত বিষয়ের সব মামলার বিচার হয় মাত্র একটি বেঞ্চে, অথচ আগে শুধু কোম্পানি-সংক্রান্ত মামলাগুলোরই বিচার হতো একটি বেঞ্চে।

৪. (সি) অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী আমাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্দরমহলের লোক এস কিউ [সালাউদ্দিন কাদের] চৌধুরী, যার নিজের বিরুদ্ধেও অনেক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তিনি এই বিচারকদের বাছাই করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কুখ্যাত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনও তারই বাছাই করা। বিচারপতি জয়নুল সম্পর্কে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের’ চোর তার বিশেষ সুবিধা প্রাপ্য। মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, যে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারক মামলারত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে তেমন রাখঢাক করেন না, জয়নুল আবেদীন তাদের একজন।

৫. (এসবিইউ) আরও তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে ডিঙিয়ে জয়নুল আবেদীনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; তাদের একজন সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, যাকে ডিঙানো হলো চতুর্থবারের মতো, দৃশ্যত এই কারণে যে, আওয়ামী লীগের প্রতি তার সহানুভূতি আছে বলে বলা হয়, যদিও তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন শাসকদল বিএনপির দ্বারা। ঢাকায় [২০০৪ সালের] ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তদন্তের জন্য গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন তিনি। এখনো অপ্রকাশিত সেই তদন্ত প্রতিবেদনে মূলত বিএনপির হুকুমই তামিল করা হয়েছে, হামলার জন্য দায়ী করা হয়েছে ভারতকে।

৬. (এসবিইউ) নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য বিতর্কিত বিচারক হলেন বিচারপতি ফয়েজী, ২০০৪ সালে যখন তিনি একজন অতিরিক্ত বিচারক হন, তখন অভিযোগ ওঠে, তার আইনের ডিগ্রিটি নকল। অভিযোগ থেকে তিনি বেঁচে গেছেন; ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার ডিগ্রির বৈধতা তদন্ত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন; কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সে নির্দেশনা দৃশ্যত উপেক্ষা করেন।

[মার্কিন গোপন তারবার্তা: বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করতে আজ্ঞাবহ লোক নিয়োগ দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট]

এরশাদের জন্য আরও দুটি ছাড়:

৭. (এসবিইউ) এর মধ্যে, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময়ের দুটি দুর্নীতির অভিযোগ ২৪শে আগস্ট খারিজ করা হয়েছে। অভিযোগ দুটি প্রমাণ করা যাবে না- মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে এই কথা বলার পর তা খারিজ করা হয়। এরশাদ বলেছেন, তার বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির অভিযোগ যদি সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করা হয়, তাহলে তিনি শাসক জোটে যোগ দেবেন।

মন্তব্য

৮. (সি) সেই সব দিন অনেক আগেই গত হয়েছে, যখন বাংলাদেশের সবচেয়ে মর্যাদাবান বেসামরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাইকোর্টের গুণকীর্তন করা হতো; প্রতিষ্ঠান তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে (পররাষ্ট মন্ত্রণালয়?) তাও পরিস্কার নয়। নিম্ন আদালতকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ব্যাপকভাবে রাজনীতকৃত বলে মনে করা হয় অনেক আগে থেকেই; কিন্তু হাইকোর্টকে অপেক্ষাকৃত সৎ ও নির্বাহী বিভাগকে প্রভাবমুক্ত বলে মনে করা হতো। গতমাসে হাইকোর্টের একদল বিচারক ইচ্ছামত মামলা বন্টন (অরবিট্র্যারি কেস অ্যাসাইনমেন্ট) ও বিচারিক গুণমানহীন রায়ের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছেন; প্রধান বিচারপতি তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু বলেছেন, তার এ বিষয়ে করার তেমন কিছু নেই।

বিউটেনিস

আরও পড়ুনঃ