
ইসরাইলের লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতা ও পলাতক আসামি তারের রহমানের ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বিষয়টি ইসরাইলি নাগরিক মেন্দি নিজেই নিশ্চিত করেছেন দেশের বেসরকারি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে। সেই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, বিরোধি জোটের একাধিক নেতার সঙ্গে তার কথা হয়েছে এবং তারা সকলে ইসরাইলের পক্ষে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসনে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সঙ্গে থাকা অন্যান্য দলগুলোর নিশ্চুপ থাকার মূল কারণ কী তবে এটি?
বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন দিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের কথা জানায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান জানান, বাংলাদেশ তার জন্মের পর ফিলিস্তিনের জন্য রক্ত ঝড়িয়েছে। সেই সঙ্গে সম্প্রতি ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের প্রসংসা করে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশের মত সকল আরব দেশ এভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিলে বহু আগেই ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়ে যেতো।
যখন বাংলাদেশের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করে শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনের পক্ষে জাতিসংঘ, ওআইসি সহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করছেন, ঠিক তখন এর বিপরীত চিত্র বিএনপি-জামায়াত ও এই দুই দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য দলগুলোর মধ্যে। সরকার বিরোধী এই গোষ্ঠীটি বাদে দেশের সকল রাজনৈতিক দলই কম-বেশি ইসরাইলের আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যখন স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বারবার বাংলাদেশের অবস্থানের কথা দৃঢ় চিত্তে ঘোষণা করা হচ্ছে তখন সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি করা বিএনপি-জামায়াত অতিমাত্রায় নিশ্চুপ। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার শিকার হচ্ছে দলটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে দলের তৃণমূলে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের এই নিশ্চুপ অবস্থানের মূল কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দলটির অতি নির্ভরতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০০১ সালে জামায়াত ও বিএনপি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক রেখে চলেছে। চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের এই গোয়েন্দা সংস্থার দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একাধিক সূত্র পাওয়া যায় ২০০১-০৬ সালের মধ্যে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সঙ্গে লন্ডনে ২০০২ সালে একবার তারেক রহমান বৈঠক করেন বলেও জানা যায়। এ ছাড়াও তারেক রহমান আইএসআই এর সহযোগিতায় দাউদ ইব্রাহিম, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল উলফা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে পরিচিত হন বলেও গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়। এই পরিচয়কে ব্যবহার করে পাকিস্তান থেকে আনা গ্রেনেড দিয়েই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।
কিন্তু সম্প্রতি সময়ে অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক চাপের কারণে বেশ কোনঠাসা পাকিস্তান। এমন অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তাদের পূর্বের পেশি শক্তি প্রদর্শনের অবস্থা নেই। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের বিকল্প হিসেবে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে বিএনপি জামায়াত। ২০১৯ সালে জামায়াত ইসলামকে জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি নষ্টকারী দল হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে সব সময় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থা নিতে দেখা যায়। বিশেষত চলতি বছর জামায়াত ইসলামের মত একটি উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বহালের আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে দেষের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো উদ্বেগ জানালেও তা ভ্রুক্ষেপ করছে না যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ অ্যাম্বাসেডর পিটার হাস। এ সবই বিএনপি-জামায়াতের ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতি নির্ভরতার ও লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে বলে মত কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
আরও পড়ুন : বিএনপি সাদা হাতিদের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে
২০১৬ সালে নয়াদিল্লিতে সাফাদি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনের প্রধান মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আসলাম চৌধুরী। সেসময় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, ইসরায়েলের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।
আরও পড়ুন : বিএনপির জন্য ইসরাইলের আহাজারি!
এরপর চলতি বছরের শুরুতে বর্তমান সময়ে বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র গণ অধিকার পরিষদের একাংশের নেতা নুরুল হক নুরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এই ইসরাইলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদি। তিনি প্রথমে বৈঠকের বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে স্বীকার করতে বাধ্য হন। একই বছর তারেক রহমানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মেন্দি এন সাফাদির বৈঠকের একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিএনপির কৃষি বিষয়ক সহসম্পাদক কৃষিবিদ চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও বিএনপিপন্থি সাংবাদিক মামুন স্ট্যালিনকে দেখা যায়। ইসরাইলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের অংশ হিসেবে তারেক রহমান ও তার প্রতিনিধিরা ইসরাইলের সঙ্গে দেন দরবার চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা জাহিদ এফ সাদী ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ জ্যাকব মিল্টন এই সাফাদির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
আরও পড়ুন : এক্সক্লুসিভ: জঙ্গি নেতাদের সাথে গোপন বৈঠক, লন্ডনে তারেক রহমানের বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ
আর এ সকল তথ্য সামনে আসার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে আর কোন মন্তব্য করতে দেখা যায়নি বিএনপি-জামায়াত বা তাদের সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে। ইসরাইলি পণ্য বাতিলের একাধিক আহ্বান জামায়াতপন্থি ফেসবুক পেজ বাঁশের কেল্লা থেকে জানানো হলেও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পৃক্ত দল ও ব্যক্তির সঙ্গে রাজনীতি বাতিলের বিষয়ে কোন কথা জামায়াত ইসলাম বা বিএনপির সঙ্গে থাকা অপরাপর ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর মুখ থেকে শোনা যায়নি। তাদের এমন আচরণে আরও একবার প্রমাণ হয় যে, ধর্মকে শুধু রাজনীতির জন্যই ব্যবহার করছে তারা। ধর্মীও মূল্যবোধের লেশমাত্র নেই দলগুলোর মধ্যে।
[ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিমদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের বিশ্বাসঘাতকতা : ইসরাইলের আগ্রাসন নিয়ে কেনো নিশ্চুপ বিএনপি]
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থন অর্জনের জন্যই দেশের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না বিএনপি-জামায়াত। ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও দেশের শতভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মূলত তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত বিশ্বাসঘাতকতা করছে বলে মনে করছেন দেশের সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠী। সেই সঙ্গে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এই ইস্যুতে নিশ্চল অবস্থানও অবাক করছে তাদের।
আরও পড়ুন :
- বাংলাদেশে ইসরায়েলের দূতাবাস স্থাপনের শর্তে মোসাদের সাহায্য চেয়েছিলো তারেক জিয়া
- ব্যাংককে বৈঠক করতে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে মেন্দি এন সাফাদির চিঠি
- ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিএনপির গোপন আঁতাতের অভিযোগ কাদেরের