
লাগাতার গুজবসন্ত্রাস ও নাশকতার পাশাপাশি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আব্বা-ভগবান-অবতার ডেকেও শেষ রক্ষা হলো না বিএনপির। অগণতান্ত্রিক ও সংবিধান বহির্ভূত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বিএনপি সারাদেশে যে অগ্নিসন্ত্রাস করছে, সরাসরি তার বিপক্ষে দাঁড়ালো মার্কিন প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে বাংলাদেশ সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা মিলে গেছে কাঁটায় কাঁটায়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি তার সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যা বলেছেন, তাতে স্পষ্ট, শেখ হাসিনা সরকার ও বাইডেন সরকারের প্রত্যাশা একই এবং একইসাথে তা বিএনপির এতদিনকার সব দাবিকে বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপি যে লক্ষ্য নিয়ে এতদিন আন্দোলন করে আসছে, তার ওপর যেন পানি ঢেলে দিল তাদের মার্কিন বন্ধুরা।
আরও পড়ুন : বিদেশি বন্ধুগণদের পদলেহন করেও লাভ হলো না বিএনপির, হতাশ বিএনপি পাড়ায়!
১৩ই নভেম্বর জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে স্টিফেন ইবেলি তার বক্তব্যে যে ৪টি পয়েন্ট তুলে ধরেছেন, সেগুলো হলো- ১. যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় এবং সহিংসতা পরিহার ও সংযমী হতে সব পক্ষকে আহ্বান জানায়। ২. কোনো রাজনৈতিক দলের ওপরে আরেকটি দলকে প্রাধান্য দেয় না যুক্তরাষ্ট্র। ৩. যুক্তরাষ্ট্র কোনো শর্ত ছাড়া সংলাপে বসতে সব পক্ষকে আহ্বান জানায়। ৪. গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র থ্রি-সি ভিসানীতি সমভাবে প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে।
আসুন ইবেলির এই পয়েন্টগুলো বিশ্লেষণ করা যাক।
এক নম্বরে বলা হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় এবং সহিংসতা পরিহার ও সংযমী হতে সব পক্ষকে আহ্বান জানায়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেইসাথে বিএনপি যে চলমান সহিংস কর্মকাণ্ড করছে রাজনীতির নামে, তা যেন পরিহার করে। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার সবসময় বলে আসছেন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা যেন বাংলাদেশে আসতে পারে, বাংলাদেশের ‘সংবিধান অনুযায়ী’ আসন্ন নির্বাচন দেখতে চায় এসে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা তুলে ধরতে পারেন, সেজন্য সরকার তাদের স্বাগত জানায়। এটাই সরকার ও কমিশনের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তাই বলা যায় সরকারের চাওয়া-পাওয়া এবং মার্কিন সরকারেরর প্রত্যাশায় কোনো পার্থক্য নেই। বরং বিএনপির মত নাশকতাকারী দলগুলো যেন সহিংসতা পরিহার করে, সেটাই চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয় পয়েন্টে বলা হয়েছে- কোনো রাজনৈতিক দলের ওপরে আরেকটি দলকে প্রাধান্য দেয় না যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ, এতদিন যে বিএনপির অলিখিত মুখপাত্র হিসেবে দেখা হচ্ছিল মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে এবং এ নিয়ে সরকারের অসন্তোষের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভিয়েনা কনভেনশনের শর্ত মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়াস দেখা গেছে, সেটা হয়ত যুক্তরাষ্ট্র অনুধাবন করতে পেরেছে।
পিটার হাসের কারণে মার্কিন সরকারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বাণিজ্যিক-সামরিকসহ বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতায় অস্বস্তি দেখা দিয়েছে কিংবা গণমাধ্যমের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ ইস্যুতে পিটার হাসের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য নাকচ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের বক্তব্যে বোঝা যায় বিএনপির পক্ষ নিয়ে সরকারকে চাপ দিতে গিয়ে উল্টো চাপের মুখে আছেন পিটার হাস স্বয়ং। তার সরকার তাই নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছে ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে। জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনো রাজনৈতিক দলকে একক প্রাধান্য দিচ্ছে না। বরং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিরপেক্ষ থাকতে চায়। বিএনপি তাই অভিভাবকশূন্য হয়ে গেল।
তৃতীয় পয়েন্টে বলা হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র কোনো শর্ত ছাড়া সংলাপে বসতে সব পক্ষকে আহ্বান জানায়। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র চায় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে শর্তহীন সংলাপ হোক। অথচ দীর্ঘদিন ধরে মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু, দুদু, রিজভী, গয়েশ্বর চন্দ্রসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন সংলাপে বসতে হলে সরকারকে আগে তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নির্বাচনের শর্ত মেনে নিতে হবে, নইলে সংলাপে যাবে না বিএনপি।
এদিকে বিএনপির প্রিয় নেতা ও রাজনৈতিক অভিভাবক পিটার হাস চাইছেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারের সাথে শর্তহীন সংলাপে বসুক। এতে একটা বিষয় স্পষ্ট, মার্কিন সরকার চায় বিএনপি যেন সংবিধান মেনে নির্বাচনে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা গত কয়েকমাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সাথে বৈঠক করেছেন, সব পক্ষের বক্তব্য শুনেছেন। তবে শেষপর্যন্ত তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়ে সংবিধান সমুন্নত রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের অঙ্গীকারেই সন্তোষ ও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
চতুর্থ ও সর্বশেষ পয়েন্টে বলা হয়েছে- গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র থ্রি-সি ভিসানীতি সমভাবে প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে। এটা বিশ্লেশষণের পূর্বে থ্রি-সি ভিসানীতি সম্পর্কে বলা দরকার। মার্কিন অভিবাসন আইনের ২১২ (এ) (৩) (সি) (‘৩সি’) ধারার অধীনে প্রণীত ভিসানীতিতে উল্লেখিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরা ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী হলেও ছাড় পাবেনা। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেবে, তাদের এই নিষেধাজ্ঞায় পড়বে।
বাংলাদেশে নির্বাচন নিরুপদ্রবে অনুষ্ঠিত করতে যখন সরকার কাজ করছে, যখন তফশিল ঘোষণার সময় সন্নিকটে, ঠিক তখন দেশকে অস্থিতিশী করে তুলেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। প্রতিদিন অসংখ্য যানবাহন পোড়াচ্ছে তারা, জানমালের ক্ষতি করছে, সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতির সঞ্চার করছে, খেটে খাওয়া মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে, আগুনসন্ত্রাসের ফলে দৈনিক শত শত কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, পণ্যবাহী গাড়ি পোড়ানোয় বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ।
বিএনপির লক্ষ্য, তফশিল ঘোষণায় বাধা দেয়া। ২০১৪ সালের নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে যেভাবে নির্বাচনী কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত সাড়ে ৫শ স্কুল পুড়িয়েছিল, নির্বাচনী দায়িত্বপালনে বাধা দিতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এবং প্রচারণায় যুক্ত আওয়ামী লীগ কর্মীদের হত্যা করেছিল, হাত-পায়ের রগ কেটে, পেট্রোল বোমা ছুড়ে হতাহত করেছিল, ঠিক একইভাবে এবারও সহিংসতায় লিপ্ত বিএনপি। প্রতিদিন হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন তারা তফশিল ঘোষণা করলে পরিণতি খারাপ হবে… ইত্যাদি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর রাজনীতির নামে করা প্রতিটি কর্মকাণ্ডই দেশে নির্বাচনী পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করছে। নিজেরা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করছে সহিংসতার মাধ্যমে। তাই বলা যায়, স্টিফেন ইবেলির বক্তব্য বিএনপিকে লক্ষ্য করে, যারা নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতা চালাচ্ছে। এটা এখন স্পষ্ট।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশকে নিয়ে বিদেশী মোড়লদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা : ব্যর্থ বিএনপির সাথে মাঠে নামানো হচ্ছে জামাতকেও
মার্কিন বন্ধুরা এভাবে সোনার দেওরা বিএনপির হাত ছেড়ে দেবে, তা ফখরুল গং ভাবতে পারেননি হয়ত। তাই বিএনপি মার্কিনিদের শত্রুপক্ষ চীনাদের শরণাপন্ন হয়েছিল। গত ৯ই নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, ‘চীন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন দেখতে চায়।’ অর্থাৎ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে চীন সরকারও একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তাদের এই অবস্থান সইতে পারেননি বিএনপি নেতারা। হতাশ হয়ে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচি রুহুল কবির রিজভী চীনা দূতের বক্তব্যে অসন্তোষ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। চীনের প্রতি যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার প্রতিফলন না দেখে রীতিমত গভীর সংকটে পড়েছে বিএনপি। মার্কিনিদের মত চীনারাও প্রত্যাখ্যান করল বিএনপিকে। সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে চীনারা বিএনপির মুখের ওপর শেষ দরজাটাও বন্ধ করে দিল!
[সংসদ নির্বাচন : বিএনপিকে গাছের ওপর তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিল যুক্তরাষ্ট্র]
এখন দেখার বিষয়, বিএনপি কি শেষপর্যন্ত নাকে খত দিয়ে সংবিধান অনুসারে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশ নেবে নাকি পলাতক তারেক রহমানের নির্দেশে সহিংসতা চালিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসী দলের উপাধিটা পুনরায় প্রমাণ করবে।
আরও পড়ুন :
- সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যান্টি আওয়ামী রাজনীতিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে
- বাংলাদেশের ওপর মার্কিন স্যাংশনগুলোর যোগসূত্র : পিটার হাস থেকে ভায়া রাস্কি পার্টনারস ষড়যন্ত্র
- বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় মার্কিন হস্তক্ষেপ, নেপথ্যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র