বিএনপি

রাজনৈতিক দল হিসেবে ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। ক্যান্টনমেন্টে জন্মের পর ক্ষমতার বাইরে থাকা এটাই সবচেয়ে দীর্ঘতম সময়। একের পর এক আন্দোলন, কর্মসূচি দিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে দলটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক পালাবদল দেখেছেন, এমন প্রবীণ রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সত্যিকারের ইতিবাচক রাজনীতি বোঝে, এমন নেতার অভার বিএনপিতে। কারণও আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে দিয়ে, আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করতেই জন্ম হয়েছিল বিএনপির। স্বাধীনতাবিরোধী অনেক দল ও নেতা, যারা আড়ালে-আবডালে ছিলেন ৭৫ পর্যন্ত, তারা জিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে আসেন সুড়সুড় করে। বঙ্গবন্ধুবিরোধী এই নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় বিএনপি।

মুসলিম লীগ ও ভাসানী ন্যাপের বহু নেতা যোগ দেন দলে। কিন্তু ফ্যাক্ট হলো, মুসলিম লীগ ও ভাসানী ন্যাপ ভোট বা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ দল নয়। তারা সাম্প্রদায়িক দল হিসেবেই চিহ্নিত। তাদের নেতারা বিএনপিতে যোগ দিলেও পুরনো মতাদর্শ বজায় রাখেন। ভাসানী ন্যাপের নেতারা মূলত উগ্র ও বিভ্রান্ত বাম। তাদের ভোটের রাজনীতির ঐতিহ্য নেই, মুসলিম লীগও কখনো নির্বাচনে জেতেনি। এর বাইরে বিএনপিতে রয়েছে ব্যবসায়ী, সুযোগসন্ধানী ও উগ্র বাম-ডান। অর্থাৎ বিএনপিতে যুক্ত হওয়া কেউই আত্মিকভাবে কোনো একক আদর্শের অনুসারী নয়। পরিস্থিতি দেখে পল্টি দেযার অভ্যাস রয়েছে।

গত ১৫ বছরে বিএনপির সব আন্দোলনই ব্যর্থ। কারণ জাতীয় মাপের নেতার অভাব। ভাসানীর অনুসারী যাদু মিয়া থেকে শুরু করে কাজী জাফর কারোরই আন্দোলন সংগঠিত করার সক্ষমতা ছিল না। মুসলিম লীগ থেকে আসা নেতাদের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপিরও ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কর্মকাণ্ড ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভাবে ছাত্রদলের আন্দোলনের ঐতিহ্য নেই। খালেদা জিয়ার তুলনামূলক জনপ্রিয়তা, এরশাদ প্রশাসনের সহায়তা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অনৈক্যের ফলে ঢাবির জাতীয়তাবাদী প্যানেল ডাকসুতে জিতে যায়। বাস্তবে তাদের এরশাদবিরোধী সংগ্রামে তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপ না করলে আমানউল্লাহ আমানও অভিদের মতো জাতীয় পার্টিতেই চলে যেতেন।

বলা যায়, বিএনপি বা ছাত্রদল- কেউই আন্দোলন-সংগ্রামের পরীক্ষিত দল নয়। ফলে বিএনপির গত ১৫ বছরের আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে সরকার, প্রশাসন বা আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব নেই। বরং বিএনপি যে জনগণের পালস বুঝতে পারেনা, সংকটেও নেতৃত্ব দিতে অক্ষম, এটাই তার প্রমাণ।

[কেন বিএনপির মহাযাত্রা সুপার ডুপার ফ্লপ খেল?]

অথচ বিএনপির নেতাদের দাবি, পুলিশ তাদের মাঠে নামতে দেয় না! নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এত মামলা রয়েছে যে, তারা এসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এসব তারা নিয়মিত মিডিয়ায় বলেন। অথচ স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সাক্ষী, জাতীয় নেতারা এরচেয়েও হাজার গুণ বেশি প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশকে পথ দেখিয়েছেন। আন্দোলন সফল নয় শুধু, যুদ্ধ করে দেশও স্বাধীন করেছেন। ৭৫-এর পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এরচেয়েও অনেক বেশি মামলা ছিল। শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার, হত্যা, গুম করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নামা নেতাদের অনেকেই বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের খুনি বাহিনীর ভয়ে নিজ বাড়িতেও ফিরতে পারেননি জিয়ার মৃত্যু পর্যন্ত। তবুও তারা দমে যাননি।

দেখা গেছে, ওপরের সারির নেতাদের কেউ গ্রেপ্তার বা নিহত হলে নিচের সারি থেকে অন্যরা দাঁড়িয়ে গেছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সেসময় আওয়ামী লীগের আন্দোলন ছিল সামরিক সরকার উৎখাতের। যাতে পাশে ছিল জনগণ। তখন এত গণমাধ্যম বা ইন্টারনেটও ছিল না। পত্রিকায় ছিল সেন্সরশিপ। সংবাদের ড্রাফট সেনা কর্মকর্তার অনুমোদন পেলে ছাপা হতো। তবুও জনতা নেমেছিল রাজপথে। বিএনপি বর্তমান সরকারকে স্বৈরাচার দাবি করে অথচ জনতার তাতে সাড়া নেই। এমনকি নিজেদের কর্মসূচিতে দলের নেতা-কর্মী পাওয়া যায় না বলে টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে আনতে হয়। বিএনপির দাবির সাথে যে জনতা একাত্ম নয়, এটাই বড় প্রমাণ।

গত ১৫ বছরে বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে সরকারের বিরুদ্ধে অহেতুক বিষোদগার ছাড়া কোনো গঠনমূলক সমালোচনা ছিল না। সরকারের ইতিবাচক কোনো কাজের প্রশংসা বিএনপি নেতাদের মুখে শোনা যায়নি। বরং সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে তারা জনগণের কাছে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরোর চেষ্টা করেছে। সরকারের কোন সিদ্ধান্তটি বা প্রকল্প জনমুখী নয়, অপ্রয়োজনীয় বা ব্যর্থ- এ নিয়ে তাদের তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ নেই, নেই গবেষণা, ডাটা ও ফ্যাক্ট, দেখাতে পারেনি কোথায় গলদ হয়েছে, কেন হয়েছে। কীভাবে করলে জাতি আরও বেশি উপকৃত হতো- এমন কোনো পরামর্শও তাদের কাছ থেকে আসেনি। বরং তারা যা করেছে, তা হলো- গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সরকারের ইতিবাচক কাজগুলোর বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এমনকি প্রাণঘাতী করোনা মহামারির সময়টাও তারা অপপ্রচার বন্ধ করেনি।

এসব কাজে বিএনপি অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করেছে, সৃষ্টি করেছে গুজবসেল, পলাতক অপরাধীদের দিয়ে ফেসবুক-ইউটিউবে মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে। জনগণকে বোকা বানাতে চেয়েছে বারবার। ইতিবাচক রাজনীতি না করে বিএনপির অহেতুক এই ‘লেগ-পুলিং’ জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। অবারিত তথ্য-প্রবাহের যুগে যেকোনো তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ রয়েছে। ফলে বিএনপির নেতিবাচক রাজনীতির মুখোশও উন্মোচিত হয়ে গেছে প্রকটভাবে।

[কেন বিএনপির মহাযাত্রা সুপার ডুপার ফ্লপ খেল?]

বিএনপি যদি অপরাজনীতি বাদ দিয়ে যোগ্য বিরোধীদল হওয়ার চেষ্টা করত, তা হতো জাতির জন্য কল্যাণকর। জাতির কাছে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারত। কর্মসূচিতেও জনগণকে পাশে পেত। কিন্তু বিএনপি শুধু চেয়েছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় বসা। আর এজন্য যদি দেশের হাজার হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করতে হয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করতে হয়, দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা লাগে, পরোয়া করেনা।

বিএনপির অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। ভুল স্বীকার করার মানসিকতা তৈরি হয়নি। তাদের অতীত জাতি জানে। বিএনপির যদি সৎসাহস থাকত, অতীতের দুঃশাসন, হাওয়া ভবনের জঘন্য রেকর্ড, ২১শে আগস্টসহ বিভিন্ন অপকর্মগুলোর জন্য ক্ষমা চাইত জাতির কাছে। তখন নিশ্চয় রাজনীতিতে সুবাতাস বইত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপি গত ১৫ বছরে কোনো যৌক্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারেনি। যা ৪৫ বছর বয়সী একটি দলের জন্যে শুধু ব্যর্থতা নয়, তারা যে প্রকৃত রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি তারও প্রমাণ।

বিএনপির বর্তমান দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এটা কি জনগণেরও দাবি? মোটেই নয়। হলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যেত, ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসত। অথচ দেখা গেল দাবি আদায়ের নামে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতা, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও হাসপাতালে তাণ্ডব, সারাদেশে আগুন সন্ত্রাসে জনতা ক্ষুব্ধ। তারা কর্মস্থলে যেতে পারছেন না, ভোগান্তি হচ্ছে। যা দেখা গেছে গণমাধ্যমে।

বিএনপি জানে, এই নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জন্য নির্বাচনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা নেই। প্রধান দুই নেতা সাজাপ্রাপ্ত বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য। তত্ত্বাবধায়কের মত অসাংবিধানিক পন্থার দাবিতে কর্মসূচির অর্থ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা। বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১৪ সালেও নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে এভাবে নাশকতা চালিয়েছিল। ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত ৫ শতাধিক স্কুল-কলেজ পোড়ানো, প্রিসাইডিং অফিসারসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের হত্যা করেও তারা ব্যর্থ হয়। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২০১৫ সালেও সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়া ৯২ দিন রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করে ব্যর্থ হয়ে রণে ভঙ্গ দেন। ততদিন তার কর্মীরা দেশব্যাপী অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছে। জীবন্ত অঙ্গার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৬ শতাধিক মানুষ; বিকলাঙ্গ হন ৩ হাজারের বেশি। সক্রিয় হয়ে ওঠে জঙ্গিরা। হত্যা করা হয় দেশি-বিদেশি নাগরিক, ধর্মযাজক, পুরোহিত, মাজারের খাদেম, লেখক, প্রকাশকসহ অনেককে। এসব জঙ্গি সংগঠনের জন্মদাতা বিএনপি-জামায়াত জোট। যাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক ছিল বিএনপির পলাতক নেতা তারেক রহমান এবং অপর মন্ত্রীদের। এরপরেও তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। বরং শক্ত হাতে জঙ্গিবাদ দমন করতে সমর্থ হয় আওয়ামী লীগ সরকার।

এভাবে বারবার চেষ্টা করেও বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু কেন? আসল কথা হলো, তাদের ওপর জনগণের আস্থা নেই। তাদেরকে বিশ্বাস করেনা। জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী নয় বলে তারা সাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচনে যেতে চায় না। নির্বাচনে জয়লাভ করলে জাতিকে নতুন কী দিবে তারা, যা এই সরকার দিতে পারছে না, তার কোনো ইশতেহার নেই বিএনপির। এমনকি বিএনপির আদর্শেও রয়েছে সমস্যা। বস্তুত যতদিন পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিরোধিতা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে নিজেদের চরিত্র থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পারবে, ততদিন তারা জনমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। বিভিন্ন অপশক্তির কাঁধে ভর করেও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। গত দেড় দশকে তা দেখা গেছে।

বিশ্ব রাজনীতির যে চরম সত্য- লক্ষ্য করলে বিএনপিও দেখতে পাবে, ভোটের জন্যে হোক বা আন্দোলনের জন্যে, দরকার জনমুখী কর্মসূচি। সেটা যদি মানুষ গ্রহণ করে, তখনই আন্দোলন ও সফলতার প্রশ্ন আসবে, এর আগে নয়। এই রাজনৈতিক দীনতাই বিএনপির মূল ব্যর্থতা। এ কারণেই বিএনপির মহাযাত্রা সুপার ডুপার ফ্লপ মেরেছে।

আরও পড়ুনঃ