পিটার হাস

রাষ্ট্রদূতরা নিয়োগপ্রাপ্ত দেশে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজ দেশের পূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি ও নিজ দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা অসামান্য। কিন্তু কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রচলিত রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যেন উল্টোপথে যাত্রা করছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই পিটার হাস যে ধরণের কার্যক্রম করছেন তা শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘনই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপের শামিল।

বাংলাদেশে এর আগেও অনেক রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এমন বাড়াবাড়ি কেউ করেননি। হাসের এহেন আচরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতার মত কর্মকাণ্ডের কারণে অনেকেই হাসকে বিএনপি-জামায়াতের যৌথ মহাসচিব হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটর ও বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজের ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর পিটার হাসের বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে।

বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট ফার্ম রাস্কি পার্টনার্স :

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে যে অপতৎপরতা শুরু হয় তাতে কয়েকটি নাম ঘুরে-ফিরে এসেছে, যার অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক লবিস্ট ফার্ম রাস্কি পার্টনার্স। রাস্কি পার্টনার্সের সঙ্গে মেনেনডেজের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন কিছু নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আর্থিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশকারী ওয়েবসাইট ওপেনসিক্রেট-এর প্রকাশিত তালিকায় রাস্কি পার্টনার্সের কাছ থেকে মেনেনডেজের ২৩ হাজার ১৪৯ ডলার গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে। রাজনীতি ও আইনি লড়াইয়ের জন্য মেনেনডেজের যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, সেজন্য তিনি সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল রাস্কি পার্টনার্সের কর্ণধার ল্যারি রাস্কির ওপর। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, পিটার হাসকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন বব মেনেনডেজ।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশনের প্রস্তাবক মেনেনডেজ :

w1k0qgkfগত ১০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন বব মেনেনডেজ ও তার স্ত্রী নাদিন আর্সলানিয়ান মেনেনডেজ। এবার তার বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ অর্থ ও বিপুল স্বর্ণ জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। এ দুটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে যা নিয়ে আগে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে বব মেনেনডেজ ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। যেখানে বাংলাদেশের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

উত্থাপিত অভিযোগের অনেক বিষয়ই ছিল বিতর্কিত, ভিত্তিহীন, অপ্রমাণিত এবং কোনোটি হাস্যকর। প্রস্তাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়। যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্বের বহু দেশের তুলনায় ভালো। তাই পর্যবেক্ষণ বলছে- মেনেনডেজের কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে অস্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়া চলমান ছিল বা রয়েছে। তাই বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি হয়নি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন হয়নি, এমন সম্ভাবনা অন্তত মেনেনডেজ কাণ্ডের পর উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

পিটার হাসের বাংলাদেশে নিয়োগ :

মার্কিন প্রশাসন বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতদের নিয়োগ প্রদান করে সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে। মার্কিন সরকারি নথিতে দেখা যায়, সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি পিটার হাসসহ ১৪ জনের নিয়োগ দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ৩রা নভেম্বর ২০২১ তারিখে মেনেনডজের নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি এই নিয়োগ অনুমোদন করে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ১০ জনকে অপরিবর্তিত রেখে ৪ জনকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেনেনডেজের উদ্যোগে মাসব্যাপী ক্যাম্পেইনের ফলে পিটার হাসসহ ১৪ জনের নিয়োগ প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।

আরও পড়ুন : নিজেদের ভিসানীতির আওতায় নিজেরাই!

এ সম্পর্কে মেনেনডেজ নিজেই স্বীকার করেছেন, এই নিয়োগ অনুমোদন করতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কেন এই নিয়োগদানের জন্য তাকে এত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে! বিশেষ কোনো স্বার্থ ছাড়া কি ৪ জনের পরিবর্তে ১৪ জনের নিয়োগের ক্যাম্পেইন করা হয়েছিল! তার উদ্দেশ্য কী? নিজের আস্থাভাজন লোকজনকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে সেখানে নতুন কোন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে চাইছেন তিনি?

পিটার হাস যেন মার্কিন ক্লাউন :

Peter_Haas,_U.S._Ambassadorপিটার হাস যেভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে চলেছেন তা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণও অনুধাবন করতে পারছে। হাস এখন মানবাধিকার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করছেন। যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তি ও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও, হাস গণমাধ্যমসহ সকল নাগরিককে এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সাধারণ জনগণের কাছে পিটার হাসের ব্যক্তিগত লম্ফঝম্প প্রতিভাত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণ হিসেবে। এখন পিটার হাসের কার্যকলাপের সঙ্গে গুজব ও মিথ্যাচার নির্ভর রাজনীতির কমিক চরিত্র নুরুল হক নুরুর পার্থক্য করা কঠিন। উভয়ের মধ্যে দহরম-মহরম সম্পর্কও রয়েছে। তবে পিটার হাসের কর্মকাণ্ডগুলো একেবারেই ভাঁড়ামিপূর্ণ।

আরও পড়ুন : ঢাকার আমেরিকান এমব্যাসি কি ডানপন্থী জঙ্গিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলো?

এফবিআই এবং ডিওজি (ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস) এর তদন্তে মেনেনডেজের দুর্নীতি উন্মোচিত হয়েছে। মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, মিশরের মতো বাংলাদেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না! কারণ ২০২০ সালের পর থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও বাকস্বাধীনতাসহ গণতান্ত্রিক সকল সূচকে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে।

কিন্তু পরিবর্তন হয়নি বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে মেনেনডেজের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট ফার্ম রাস্কি পার্টনার্সের সম্পর্ক, পিটার হাসকে বাংলাদেশে নিয়োগদানের জন্য মেনেনডেজের মাসব্যাপী ক্যাম্পেইন এবং পিটার হাসের বিরোধীদলীয় নেতার মতো কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ – এসবের নিবিড় যোগসূত্র দৃশ্যমান।

[বাংলাদেশের ওপর মার্কিন স্যাংশনগুলোর যোগসূত্র : পিটার হাস থেকে মেনেনডেজ ভায়া রাস্কি পার্টনারস ষড়যন্ত্র]

তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত স্যাংশন আরোপের সিদ্ধান্ত এবং পিটার হাসের আগ্রাসী মনোভাব সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করার পাশাপাশি এসবের নেপথ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছিল কি না তা অনুসন্ধানে এফবিআই ও ডিওজি-কে তদন্তের অনুরোধ জানানো।

তথ্য সূত্র :

১. বব মেনেনডেজের বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব
https://www.foreign.senate.gov/press/dem/release/bipartisan-letter-calls-for-sanctions-on-bangladeshi-battalion-for-extrajudicial-killings-enforced-disappearances-torture

২. রাস্কি পার্টনারসের কাছ থেকে মেনেনডেজের অর্থ গ্রহণ
https://www.opensecrets.org/members-of-congress/contributors?cid=N00000699&cycle=2020&recs=100&type=C&

৩. ৪ জনকে নিয়োগ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতি বাইডেনের প্রস্তাব
https://www.whitehouse.gov/briefing-room/statements-releases/2021/07/09/president-biden-announces-his-intent-to-nominate-four-individuals-to-serve-as-ambassadors/

৪. মেনেনডেজের কমিটির অনুমোদন
https://www.menendez.senate.gov/newsroom/press/sfrc-approves-14-critical-foreign-policy-nominations

৫. মেনেনডেজের অন্যতম ডোনার রাস্কি পার্টনারসের কর্নধার ল্যারি রাস্কি।
https://www.nj.com/politics/2016/01/menendez_spent_225k_on_legal_bills_in_last_3_month.html 

আরও পড়ুন :