
কথায় বলে- বিচার মানি তবে তালগাছ আমার! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ঠিক সেরকম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সুশাসন- ইত্যাদি বিষয়ে সবক দেয়ার নামে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে দেশটি। তারা এসব ইস্যু বাস্তবায়ন চায় নিজেদের ফর্মূলায়, নিজেদের স্বার্থ যেন ঠিক থাকে। কিন্তু এসব ইস্যুতে তাদের দেশের অবস্থা কেমন, তা নিয়ে তারা কথা বলতে রাজি নয়। অর্থাৎ, অন্যকে সবক দিলেও নিজের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। বড় অদ্ভূত এক জাতি মার্কিনিরা।
গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, বাংলাদেশিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও রয়েছেন। পরদিন শুক্রবার সেই সিদ্ধান্তের সাথে যুক্ত করলেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, বললেন- মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে বাংলাদেশি গণমাধ্যমও।
পিটার হাসের এমন বক্তব্যে স্তম্ভিত দেশের গণমাধ্যমকর্মী এবং সাধারণ মানুষ! যে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রিডম অব প্রেস বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলে, তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের্ ওপর মাতবরি ফলাতে চায় কেন? সাংবাদিকদের এক হিসেবে বিশ্ব নাগরিক বলা হয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ বা যে কোনো সংকটে সাংবাদিকরাই সঠিক তথ্য তুলে আনতে সক্ষম, সংবাদ সংগ্রহে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো। তাহলে বাংলাদেশি গণষমাধ্যমের ওপর কেন পিটার হাসের গাত্রদাহ? এ বিষয়ের সাথে অনেককিছু জড়িয়ে আছে। বিষয়টাকে সরল মনে করারও কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক ও কূটনীতিক বিশ্লেষক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধান করে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে। পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণে যাবার আগে আলোচ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ফ্রন্ট হিসেবে ষাটের দশক থেকে কুখ্যাত ভূমিকায় কাজ করে চলেছে আরেকটি সংস্থা- এনইডি, যারা বিভিন্ন দেশে মিডিয়া ক্যু ঘটিয়ে সেদেশের সরকার পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে সংস্থাটি কাজ করছে ছদ্মবেশে। কয়েকটি গণমাধ্যম ও সাংবাদিককে বড় অঙ্কের ফান্ড সহায়তা দিচ্ছে তারা। পিটার হাস সম্প্রতি সরকারবিরোধি কয়েকটি পত্রিকা অফিসে বৈঠক করে এসেছেন, যা কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতের নিয়মিত কর্মকাণ্ডের এখতিয়ারে পড়ে না। এছাড়াও বাংলাদেশি কয়েকজন চিহ্নিত সিনিয়র সংবাদকর্মীকে প্রায়শ মার্কিন দূতাবাসে আসা-যাওয়া করতে দেখা যায়। আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যার অন্যতম- কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর রয়েছে এই সংগঠনের পেছনে মার্কিন একটা পক্ষ কাজ করছে। দোসর হিসেবে রয়েছে তাদেরই মদদপুষ্ট এদেশি সংস্থা। প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। স্যাংশন- সেই নোংরা খেলারই একটি অংশ।
মিডিয়া ক্যু ঘটানোর অপচেষ্টায় এনইডি:
বিভিন্ন দেশের সরকার পতনের নেপথ্যে কাজ করা কুখ্যাত সংস্থা- ন্যাশনাল এনডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি বা এনইডি (সিআইএ’র ফ্রন্ট) সরাসরি অর্থায়ন করছে বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রোপাগান্ডামূলক ওয়েবসাইট ও পোর্টালের পেছনে। এনইডি বিশ্বের প্রগতিশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির বিভিন্ন দেশগুলোকে ধ্বংস করতে এবং সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ষাটের দশক থেকে। দেশগুলো যেন মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে, মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে না পারে, তাই এনইডি নেপথ্যে সরকারবিরোধী প্রতিপক্ষ তৈরীতে অর্থায়ন ও সাহায্য দেয়। এনইডি’র পরিকল্পনায় কাজ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। যেখানে সরকারবিরোধী অপপ্রচার, গুজব, প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনমতকে ভিন্নপথে পরিচালিত করতে উস্কানো হয়। যেন ক্যু ঘটালে জনগণ তা সহজেই মেনে নেয়- এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এনইডি’র কারণে বহু দেশের সরকার উৎখাত হয়েছে ইতিপূর্বে।
বছরখানেক আগে সুইডেন থেকে প্রচারিত গুজবী পোর্টাল নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল নিজেই তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিশ্চিত করেন তার পোর্টালকে বড় অংকের ফান্ড দিয়েছে এনইডি।
এনইডি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক জেফরি টি রিচেলসনের বই থেকে। তিনি জানান, এনইডি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র একটি আন্ডারকাভার প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তনে হস্তক্ষেপ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় কোনো দেশের কোনো বিরোধী গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে কোনো দেশের সরকারকে কৌশলে হঠানোর পটভূমি তৈরি করে এনইডি। এজন্য তারা সেসব দেশের স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে নেগোশিয়েট করে বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমে ওই দেশ ও সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে চাপ সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে সর্বক্ষেত্রে সে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়। দেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য বৃদ্ধি পায়। নাড়া খায় সরকার। এভাবেই এজেন্ডা সেট করে, মাঠ তৈরি করে, স্থানীয়দের সামনে রেখে, সুযোগ বুঝে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কোনো দেশের সরকারের পতন ঘটায় মার্কিন এই সংস্থা ও তাদের প্রতিপালক সিআইএ।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের সাবেক সিনিয়র ফেলো জেফরি টি রিচেলসন দীর্ঘদিন কাজ করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে। অনেক বছর গবেষণার পর কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তার দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- দ্য ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি এবং দ্য উইজার্ড অব ল্যাংলি: ইনসাইড দ্য সিআইএ’স ডিরেক্টরেট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। ৫৯২ পৃষ্ঠার ‘দ্য ইউএস ইনটেলিজেন্স কমিউনিটি’ গ্রন্থের ১৬তম অধ্যায়ের নাম ‘কাভার্ট অ্যাকশন’। এখানে মার্কিন গোয়েন্দাদের আধুনিক কার্যক্রম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন রিচেলসন। সেই গ্রন্থ থেকে জানা যায়- নিকারাগুয়ায় ক্ষমতাসীন সান্দিনিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে এই পরিকল্পনা গণতান্ত্রিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে অপারেশনে নামে এনইডি। প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে জনমত গঠন করে, তারপর রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে ১৯৯০ সালে নিকারাগুয়ায় সরকারের পতন ঘটায় তারা। একইভাবে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, চিলিসহ অন্তত একডজন দেশে উগ্রবাদীদের দিয়ে সহিংসতা ছড়াতে মোটা অর্থ বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র।
এর আগে, ষাটের দশকের শুরুতে ইরানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকারকে হঠাতে পাহলভী বংশের রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটিও করেছিল সিআইএ। এমনকি একটি পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে সরিয়ে দিতে মার্কিন গোয়েন্দাদের ন্যাক্কারজনক ও নৃশংস ভূমিকাও এখানে উল্লেখ্য। সে সময় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশ থাকায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান।
নেত্র নিউজ ছাড়াও বিএনপিপন্থী পত্রিকা মানবজমিনসহ আরও কয়েকটি পত্রিকা এবং সেখানকার নিয়মিত কলামিস্টদের পেছনে এনইডির ফান্ডিংয়ের বিষয়ে জানা গেছে। এছাড়া প্রথম আলো, ডেইলি স্টার তো বহু আগে থেকেই এসব কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। তারা সুকৌশলে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালায়। এছাড়া নানারকম বিভ্রান্তিকর সংবাদ শিরোনাম দিয়ে পরিবেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উস্কানি দেয়া তো আছেই। মার্কিন মদদপুষ্ট বিভিন্ন এনজিওকে দেয়া ডোনেশনের নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দিচ্ছে এনইডি। যাদের মাধ্যমে তারা সরকারবিরোধী প্রচারণার অপারেশন চালাচ্ছে। যত হাত ঘুরেই আসুক, উন্নয়নখাতের নামে সরবরাহকৃত এসব ফান্ডের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল অনুমোদন লাগে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা আছে যাদের, তারা এসবের উদ্দেশ্য জানেন। বাংলাদেশি কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং এনজিও এনইডির ফান্ডে কাজ করছে। এনজিওগুলো সরকারের সব বিষয়ে সমালোচনা করে, স্বচ্ছতা দাবি করে। অথচ এদের ওয়েবসাইটে গেলে তাদের আর্থিক উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
মার্কিন গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ টি রিচেলসনের গ্রন্থ ছাড়াও ডেভিড মারপলস-এর ‘দ্য ময়দান রেভল্যুশন ইন ইউক্রেন’ বইটি থেকেও অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিনিদের এমন নোংরা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়। যাকে বলা হয় ‘ইউক্রেন স্টাইল’ অর্থাৎ গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরীর কৌশল। ১৯৯০ সালে নিকারাগুয়ায় সরকার পতনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত সিআইএ’র গোয়েন্দারা পদ্ধতিটি প্রয়োগ করে ইউক্রেনের ওপর। ২০১৩-১৪ সালে ইউক্রেনের ইউরো-ময়দান (কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কয়ার) গণবিপ্লবের ছদ্মবেশে সরকারের পতন ঘটায় তারা। তারা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে জনগণকে বিভিন্ন ইস্যুতে উস্কে দিয়ে রাশিয়াসমর্থিত সরকারের বিরোধীপক্ষকে নিয়মিত অর্থায়ন করত। জনরোষ সৃষ্টির পর এক রাতে ফেসবুকে বিপ্লবের ডাক দিলে জমায়েত হয় ক্ষুব্ধ জনতা। জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে ইউক্রেনের ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর বাংলাদেশে সরকার বদলানোর ষড়যন্ত্র জোরদার হয়। ২০১৩’র ৫ই মে শাপলা চত্বরের ঘটনার নেপথ্যেও একই ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল। সেসময় তারা ইউরো-ময়দান স্টাইল ফলো করে। সেই অনুসারে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা হয়। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করেও চেষ্টা করা হয় ক্যু ঘটানোর। মূলতঃ এনইডি বাংলাদেশের সরকার বদলানোর গ্রাউন্ড তৈরিতে ‘এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানেও অর্থায়ন করেছে। তাই গত নির্বাচনের সময় বিদেশি পর্যবেক্ষদের বিভিন্নভাবে সরকারের ব্যাপারে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে তারা। ক্যু ঘটানোর পটভূমি তৈরির অংশ হিসেবে এনইডি-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের গুজবসেল, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচ্ছেন দেশের শত শত সাংবাদিক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা। সাংবাদিকতার নামে গুজব ও অপপ্রচার ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজ করে চলেছে কুখ্যাত সং্স্থাটি। বাংলাদেশে যেসব গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে, গুজবের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য তুলে ধরে, মূলত তারাই এখন মার্কিন প্রশাসনের ব্ল্যাকলিস্টে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না- এমন চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদেরকে সাংবাদিকতার নীতি থেকে বিচ্যুত করার লক্ষ্যে।
মার্কিন দূতাবাসের সাথে বিএনপিপন্থী সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের আঁতাত:
গত ১১ই আগস্ট শুক্রবার ছুটির দিন কারওয়ান বাজারে বিএনপিপন্থী সংবাদপত্র মানবজমিন পত্রিকার অফিসে বেড়াতে যান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গণমাধ্যম ও গণতন্ত্রের পক্ষে বক্তৃতা দেন। হাসকে বরণ করে নিতে সব প্রস্তুতি ছিল প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর। পিটার হাস মানবজমিন-এর বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মতিউর রহমান চৌধুরীর ব্যাপক প্রশংসা করলেন। হাস জানান জনগণের কণ্ঠস্বর যাতে শোনা যায় তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র লড়াই করছে। এসময় হাস বাকস্বাধীনতা ও জনসমাবেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন। স্বাভাবিকভাবেই মানবজমিন-এর পক্ষ থেকে কেউই হাসকে প্রশ্ন করেনি যুক্তরাষ্ট্রের সহিংসতার কথা, সেদেশে চরম সাংবাদিক লাঞ্ছনা, সাংবাদিকদের ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ, সরকাবিরোধী সংবাদ প্রকাশে সংবাদপত্রের ওপর হস্তক্ষেপসহ বর্ণবাদের পক্ষে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান বিষয়ে। আবার পিটার হাস নিজেও মানবজমিন সম্পাদককে প্রশ্ন করেননি তার সংবাদকর্মী ও রুমা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক লোঙ্গা খুমির সাথে জঙ্গি সংগঠন কুকি-চিনের সম্পর্কের কথা।
শুধু মানবজমিন নয়, আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী সংবাদমাধ্যম হিসেবে কুখ্যাত- প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার কার্যালয়েও বেড়াতে গেছেন পিটার হাস। পত্রিকাদুটির সম্পাদক মতিউর রহমান এবং মাহফুজ আনাম, যারা ওয়ান-ইলেভেন ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান দুই কুশীলব, তাদের সাথেও বৈঠক করেন হাস। সিআইএ’র সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা পত্রিকা দুটির সম্পাদক বহুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এনইডি’র সাথে সরাসরি কাজ করছে তারা দীর্ঘদিন ধরে, এমন গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের মাইনাস ফর্মূলা বাস্তবায়নে ব্যর্থ মতি-মাহফুজ চক্রের সাথে মিলে বাংলাদেশে মিডিয়া ক্যু ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে এনইডি। নানারকম গুজব-অপপ্রচারের মাধ্যমে জনঅসন্তোষ সৃষ্টিতে কাজ করছে পত্রিকা দুটি। শিশুর হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তার ছবি তুলে ভুয়া নাম দিয়ে অসত্য বক্তব্য প্রকাশের মত ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ধরা পড়া প্রথম আলো এবং সরকারের মন্ত্রী ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে সেই ত্রাণ ফিরিয়ে নিয়েছেন- এমন মিথ্যাচার করে ধরা পড়া ডেইলি স্টার পত্রিকার কুকীর্তির সংখ্যা অসংখ্য। মত প্রকাশের নামে তারা এ ধরণের হলুদ সাংবাদিকতার চেষ্টা করছে সেই ইত্তেফাক পত্রিকার বাসন্তীর জাল পরানো ছবির ঘটনার মত। ইত্তেফাক সেসময় সিআইএ’র পক্ষে যে কাজটি করিয়েছিল ৭৫-এর পটভূমি তৈরির লক্ষ্যে, একই কাজ এখন করছে প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ বহু সংবাদমাধ্যম। যাদেরকে পেছন থেকে সহায়তা করছে মার্কিন দূতাবাস।
পত্রিকা অফিস এবং সাংবাদিক ছাড়াও নিয়মিত বিএনপি-জামায়াতের সাথে বৈঠক করছেন পিটার হাস। যে জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেই জামায়াতের সাথে সফররত মার্কিন কর্মকর্তারা এসে বৈঠক করেন। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কানাডার আদালতে তিনবার দোষী সাব্যস্ত হওয়া বিএনপি কার্যালয় তো পিটার হাসের দ্বিতীয় অফিস। স্বার্থোদ্ধারের জন্য মার্কিনিরা সবই পারে। এজন্যই কুখ্যাত হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন- America has no permanent friends or enemies, only interests. আরও বলেছিলেন, To be an enemy of U.S can be dangerous, but to be a friend is fatal. অতএব, এটা খুবই স্পষ্ট, নিজেদের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা কিছু করছে এখন, এর সাথে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সুশাসন ইত্যাদির তিলমাত্র সম্পর্ক নেই। সবই উছিলামাত্র।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে মার্কিন ষড়যন্ত্র:
বাংলাদেশের দুটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে, বিদেশি অর্থায়নে বাংলাদেশে কাজ করছে, এমন কয়েকটি এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। একটা জাতিকে ধ্বংস করে, দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে জঙ্গিবাদ ও মাদক খুবই কার্যকরী ও নোংরা ফর্মূলা। বাংলাদেশের অত্যন্ত দক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি-জামায়াত আমলে সৃষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোকে প্রায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলে র্যাব এবং পুলিশ সেটি দ্রুত প্রতিহত করছে। এজন্য্ র্যাবের ওপর নাখোশ যুক্তরাষ্ট্র। তাই এবার ধর্মীয় উগ্রবাদের পাশাপাশি জাতিগত সংঘাত সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। বিশেষ করে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেয়ার মাধ্যমে দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ সৃষ্টির ইন্ধন যোগাচ্ছে। মার্কিনিরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে যেসব এনজিও, তাদের মাধ্যমে অর্থায়ন করছে। এছাড়াও রয়েছে সুজন, টিআইবি,সিপিডির মত সংস্থাগুলো। রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, অধিকার-এর মত অনেক সংস্থাও। এসব সংস্থায় কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মার্কিন গোয়েন্দা সং্স্থার পক্ষে এজেন্ডাভিত্তিক কাজ করছে। বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার মতে টিআইবির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ-এর সৃষ্টি এবং অর্থায়নের সাথে।
পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ-এর প্রধান খাদ্য ও রসদ সরবরাহকারী লোঙ্গা খুমি গত ১৯শে মে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আটক হন। তিনি সংগঠনের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক গুরু। এছাড়া তিনি রুমা উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপির পক্ষে তিনি ২০১৬ সালে রুমা সদর ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচন করেন। লোঙ্গা খুমি বিএনপিপন্থী সংবাদপত্র মানবজমিন-এর সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্বের আড়ালে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত। দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিদেশি এনজিওর অর্থায়নে এবং মদদে লোঙ্গা খুমি কেএনএফ-এর পক্ষে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেনাবাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার ঘটনায় জানুয়ারিতে দায়েরকৃত দুটি মামলার আসামি এই লোঙ্গা। কেএনএফ প্রধান নাথান বমের নির্দেশে কেএনএফ ২৭শে জানুয়ারি পাইন্দু ইউনিয়নের মুন্নুয়ামপাড়া সেনা ক্যাম্পে হামলা চালালে কয়েকজন সেনাসদস্য হতাহত হন। পরদিন ২৮শে জানুয়ারি বাসাত্লাংপাড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর টহল দলের ওপর কেএনএফ আবার হামলা করে। সেখানেও কয়েকজন সেনাসদস্য আহত হন। ঘটনার তদন্তে লোঙ্গা খুমির জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিএনপি নেতা লোঙ্গা খুমি ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা কেএনডিও’র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি কেএনএফ-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ফরেন সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। তিনি নাথান বমের অতি ঘনিষ্ঠ। সাংবাদিকতার ছদ্মবেশে কেএনএফ-এর প্রধান তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লোঙ্গা। দীর্ঘদিন ধরে সেনা-গোয়েন্দাদের নজরদারিতে ছিলেন তিনি। তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা বিষয়ে কেএনএফ-এর গোপন নথি গোয়েন্দাদের হাতে এলে সেই সূত্রে তাকে আটক করা হয়। গোপন নথিতে কেএনএফ-এর শীর্ষ নেতৃত্বের অফিসিয়াল তালিকায় লোঙ্গার নাম রয়েছে। তার সাথে বাংলাদেশি কয়েকটি এনজিওর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তার হাত দিয়েই বিদেশি অর্থায়ন পৌঁছানো হয়। লোঙ্গা ২ বছর আগে এনইডি’র এক এজেন্টের বিশেষ সুপারিশে বিএনপপন্থী মানবজমিন পত্রিকায নিয়োগ পান। এই পরিচয়ে তিনি প্রশাসনের সর্বস্তরে যাতায়াত করতেন, সেইসাথে গহীন অরণ্যেও অবাধ যাতায়াত ছিল তার। সাংবাদিক হওয়ায় কোথাও তাকে জবাবদিহিতা করতে হয়নি। এই পরিচয়ের মাধ্যমে তিনি পাহাড়ের গহীনে বিভিন্ন সন্ত্রাসী-জঙ্গি সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতেন নির্বিঘ্নে। পাশপাশি এনইডি-বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নেও সক্রিয় ছিলেন লোঙ্গা খুমি।
শুধু কেএনএফ নয়, পাহাড়ে আরও অনেক সন্ত্রাসী সংগঠনকেও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন মদদপুষ্ট বিভিন্ন সংগঠন। পাহাড়ে গড়ে ওঠা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে মার্কিন মদদপুষ্ট এনজিওগুলো। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে বলেও গোয়েন্দা তথ্য ছিল। সেই মোতাবেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কয়েকটি মানবাধিকারবারী সংগঠন। তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের যেন বাংলাদেশে চিরস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়া হয়, না হলে অন্তত তাদেরকে কর্মসং্স্থানের সুযোগ দেয়া হয়।
[বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় মার্কিন হস্তক্ষেপ, নেপথ্যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র]
সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শরণার্থী বিষয়ক প্যাক্টে সাক্ষরকারী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন তাঁবেদার পত্রিকাগুলো দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ উল্লেখ করে শরণার্থীদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর এই বিষফোঁড়া চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। তাতে রোহিঙ্গারা চিরস্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থেকে যাবার সুযোগ পাবে। এই কাজটা সুকৌশলে করছে চিহ্নিত সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা। অথচ বাংলাদেশ সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছে রোহিঙ্গাদের স্ট্যাটাস, তারা শরণার্থী নয়, তারা আশ্রিত। এসব কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী নয়, শুধু ফাঁকা বুলি দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যবসা করছে এনজিওগুলো। রোহিঙ্গাদের নামে অর্থ আসছে বাংলাদেশে, যা চলে ্যাচ্ছে টিআইবি, সুজন-এর মত প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত দিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমের পরিস্থিতি:
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসন চেষ্টা করছে ভিসা নিষেধাজ্ঞার জুজু দেখিয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মাঝে ভীতির সঞ্চার সৃষ্টি করা। যেন বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরার পরিবর্তে নেতিবাচক ও সরকারের অহেতুক সমালোচনামূলক সংবাদ বেশি বেশি প্রকাশ করে তারা। এছাড়াও ভাড়াটে লেখকদের দিয়ে এসব পত্রিকায় বিভ্রান্তিকর শিরোনামে কলাম প্রকাশেও উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানা যায়। যে কাজটি নিয়মিত প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, মানবজমিনসহ চিহ্নিত পত্রিকাগুলো করছে। মার্কিনিদের এসব শর্ত মানলে তাদের গুডবুকে থাকতে পারবে সাংবাদিকরা। এতে সারাদেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়া অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে প্যানিক সিচুয়েশন তৈরিতে সুবিধা হয় ভুঁইফোড় পোর্টাল এবং ইউটিউমারদের। বর্তমানে যেসব টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্রে সরকারি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সুবিধাভোগীদের প্রতিক্রিয়া অধিক প্রচারিত হচ্ছে, এসব গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ওপর পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে সিআইএ’র ফ্রন্ট এনইডি।
যে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশি গণমাধ্যমের ওপর এমন নোংরা হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা চালাচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ধুয়া তুলে, তাদের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেমন, আসুন দেখে নেয়া যাক।
যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। মার্কিন সংস্থা প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসে দেশটিতে ১৪ জন সাংবাদিক বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। যাদের ৫ জনকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। ২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হুমকি দেয়া হয়েছে ১ জনকে। তথ্য চেয়ে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন ২ জন। কাজে বাধা দেয়া হয়েছে ২ জনকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়েছেন অন্তত ৪০ জন, কাজে বাধা দেয়া হয়েছে ১০ জনকে। আদালতের মুখোমুখি হতে হয়েছে ৩০ জনকে।
যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০২০ সালে। সে বছর মোট ১৪৫ জন গ্রেপ্তার কিংবা মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৬৩১ জন। ২০২১ সালে মামলা কিংবা গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হয়েছেন ৫৯ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হন ৫৬ জন। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসের হিসাব আমলে নিলে বিগত ৫ বছরে মামলা কিংবা গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন ২৮৩ জন। সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন প্রায় ৯৬৪ জন। তথ্য চেয়ে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন ৭৬ জন সাংবাদিক। হামলার কারণে সাংবাদিকতার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নষ্ট হয়েছে ২০৩ জনের। আদালতের নোটিশের মুখোমুখি হয়েছেন ১৬৭ জন। দেহ তল্লাশি এবং সরঞ্জাম কেড়ে নেয়া হয়েছে ৮৩ জনের।
পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের অবস্থা যতটা ভালো ভাবা হয় বাইরে থেকে, ভেতরে ততটা ভালো নয়। এই অবস্থায় নৈতিকভাবে বাংলাদেশের মতো দেশের বেলায় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থা স্বাধীন সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা শেখানোর সবক দিতে আসতে পারে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ২০২১ সালে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস বা সিপিজে’র নির্বাহী পরিচালক জোয়ের সাইমন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও আটকের জন্য সুস্পষ্ট কোনো কারণ লাগে না। ২০২১ সালে এ ধরনের ৫৬টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় সমস্যাটি বিশাল আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচার চেয়ে চলমান আন্দোলন ও বিক্ষোভে সাংবাদিকদের ওপর দেশটির পুলিশ প্রায় ৯০ বার হামলা চালিয়েছে [সূত্র: প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকার]। সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে সরাসরি রাবার বুলেট ছুঁড়েছে পুলিশ। এমনকি এই আন্দোলন কাভার করতে আসা দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং মরিচ গুঁড়া নিক্ষেপের শিকার হন। পরিচয়পত্র দেখানোর পরও পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালায়। ওই বছরই সরাসরি সম্প্রচার চলাকালে মিনেসোটা পুলিশ সিএনএন-এর সাংবাদিক ও ক্রুদের গ্রেপ্তার করে। এ সময় বারবার গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলেও কোনো উত্তর দেয়নি পুলিশ। টিভি লাইভে দেখা যায় একে একে সাংবাদিক ও ক্রুদের হাতকড়া পড়িয়ে আটক করছে পুলিশ।
মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীটি মুক্ত গণমাধ্যমের নিশ্চয়তা দিলেও তা মানা হয় না। মার্কিন সরকার গণমাধ্যমের তথ্যের গোপন উৎস বের করতে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত ফোন এবং ই-মেইল রেকর্ড জব্দ করে অহরহ। অথচ তারাই বাংলাদেশে সচিবালয়ে ঢুকে স্পর্শকাতর নথি চুরিতে হাতেনাতে আটক করায় প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনার পক্ষে সবক দেয়! সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত ডিভাইস ও যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যে হস্তক্ষেপ এবং বাজেয়াপ্তের এই কৌশলটি ওবামা, ট্রাম্প, বাইডেনসহ সকল সরকারের সময় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটা সাংবাদিকদের নিপীড়নের একটি ঘৃণ্য কৌশল হিসেবে স্বীকৃত।
এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে এ কারণে, এই পরিসংখ্যানগুলো প্রথম আলো কিংবা ডেইলি স্টারে কখনই প্রকাশিত হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থাগুলোর সাথে কারওয়ান বাজারের এই সাংবাদিক সদর্ৱারদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। যারা বিভিন্ন স্বার্থে পরস্পরের পিঠ চুলকে ফায়দা আদায় করে। গণমাধ্যমকর্মীদের নেতিবাচক ও গুজব প্রচারে উৎসাহিত করে জনরোষ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতায় নিজেদের পছন্দমাফিক পুতুল সরকার বসানোর লক্ষ্যে একইসাথে কাজ করছে মার্কিন বিভিন্ন সংস্থা এবং বাংলাদেশি এই গণমাধ্যমগুলো।
মার্কিন ভিসানীতি ও স্যাংশনের খেলা নিয়ে সমালোচনায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব:
মার্কিন স্বার্থের বাইরে গেলে বিভিন্ন দেশকে স্যাংশন দেয়া, তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোুপ করা- এসবই রাজনৈতিক খেলার অংশ। কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মাধ্যমে মার্কিন বলয়ে থাকা অপর দেশগুলোও স্যাংশপ্রাপ্ত দেশগুলোর সাথে অন্যায্য আচরণ শুরু করে। যার ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই স্যাংশন এড়াতে মার্কিনিদের অন্যায় কর্মকাণ্ডে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, মার্কিনিদের সাথে সম্পর্ক ভালো নয়- এমন দেশগুলোর সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য থাকলেও তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলার মত অন্যায় শর্ত মেনে নিতে হয়। মার্কিনিরা এভাবেই বিশ্বজুড়ে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। চীন ও রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক থাকা দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাতে। বিশ্বও ভারসাম্য হারাচ্ছে। মার্কিনিদের এসব হীন চক্রান্ত ও উস্কানিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার পর এবার তাইওয়ান-চীন এবং সর্বশেষ কানাডা-ভারতের মাঝে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এসব দ্বৈরথ থেকে শতভাগ ফায়দা আদায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিবদমান দুুিট দেশের বিবাদ মিমাংসা না করে বরং নিজেদের অস্ত্র বিক্রি করে যুদ্ধ জিইয়ে রাখে মার্কিনিরা।
নিউইয়র্কে সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিনিদের এই ভিসানীতি নিয়ে বলেছেন, দেশবাসী ভোট দিলে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু বিদেশ থেকে নির্বাচন বানচালের কোনও পদক্ষেপ জনগণ মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা করবে যারা, বাংলাদেশের জনগণ উল্টো তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
আরও পড়ুনঃ
- মার্কিন গোপন তারবার্তায় বিএনপি-জামায়াত আমলে বিমানের বোয়িং দুর্নীতি ও ঘুষ কেলেঙ্কারি
- মার্কিন গোপন তারবার্তা: বিএনপি সরকার ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় চাপিয়েছিল ভারতের ওপর
- গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করায় ৪ দেশের ৩৯ জনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, নেক্সট কি বিএনপি?