
বাংলাদেশে সফর করে যাওয়া ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় বিএনপির অদ্ভূত গাত্রদাহ দেখা গেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ক্রমশ লোকসান গুণতে থাকা বাংলাদেশ বিমান যথাযথ পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েক বছরে মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে কয়েকটি অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী বিমান কেনা হয়। এবার আরেকটি বিশ্বখ্যাত ফরাসি কোম্পানি এয়ারবাসের সাথে চুক্তি হয় আরও কয়েকটি নতুন বিমান কেনার। বাংলাদেশ বিমান কেন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো, এই চিন্তায় ঘুম হারাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এখানে নানারকম দূরভিসন্ধি আবিষ্কার করছেন। অথচ সত্যটা হলো বিএনপি-জামায়াত আমলে বিমান প্রতিমন্ত্রী মীর নাছির, খালেদা জিয়ার ছোটভাই ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার শামীম এস্কান্দার, স্বল্পকালীন দায়িত্ব পাওয়া মির্জা ফখরুলসহ জিয়া পরিবারের সংশ্লিষ্টরা বিমানকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিলেন। যার প্রমাণ মার্কিন তারবার্তাতেই রয়েছে।
মার্কিন দূতাবাসগুলোয় কর্মরত বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্যতম কাজ সংশ্লিষ্ট দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর গোপনে অনুসন্ধান চালানো। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তাদের নামে আলাদা আলাদা ডোশিয়ে (ব্যক্তিগত তথ্য সম্বলিত ফাইল) তৈরি করা। সেই আলোকে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অনেকের ডোশিয়ে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয় দূতাবাস থেকে। তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাস সাক্ষরিত তারবার্তায় খোদ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমান ছাড়াও মন্ত্রিসভার অনেকের সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্য ছিল।
উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া সেই গোপন তারবার্তায় (Source: https://wikileaks.jcvignoli.com/cable_05DHAKA2243; Part- E) Civil Aviation State Minister Mir Nasiruddin) বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ও বেসামরিক বিমান চলাচল প্রতিমন্ত্রী মীর নাছির উদ্দিনের দুর্নীতি ও অপকর্মের তথ্য রয়েছে। তার রাজনৈতিক অদক্ষতার পাাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামরিক ও বেসামরিক আকাশযান প্রস্তুতকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িং-এর বিমান ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি এবং ঘুষ সম্পর্কিত তথ্যও পাওয়া গেছে সেখানে।
উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া সেই গোপন তারবার্তার বঙ্গানুবাদ উপস্থাপিত হলো এখানে।
তারবার্তা নং- ০৫, ঢাকা ২২৪৩, তারিখ- ১১ই মে, ২০০৫, সময়- ০২:১৬ পূর্বাহ্ন, শ্রেণি- সিক্রেট
ঙ) মীর নাছির উদ্দিন :
বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার প্রতি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আনুকূল্য রয়েছে অংশত এই কারণে যে সৌদি আরবে একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত হিসেবে ওই দেশের নেতাদের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ আছে এবং খালেদা যখন মক্কায় যান, তখন সেখানে তার যথেষ্ট খাতির-যত্ন তিনি নিশ্চিত করেন। ৯ই মে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে তার প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে জোরদার করতে অনাগ্রহী তারেক ও সাকা চৌধুরীর মতো নেতাদের চট্টগ্রাম যেতে বাধ্য করেন খালেদা জিয়া। অবশ্য এই শেষ চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। নাছির প্রচারক হিসেবে গতিশীল নন, ব্যবস্থাপক হিসেবেও নন। খালেদা জিয়ার মুখ্যসচিব কামাল সিদ্দিকী আমাদের একান্তে বলেছেন, বাংলাদেশের বোয়িং-৭৭৭ জেট বিমান ক্রয় তিনি (মীর নাছির) আটকে রেখেছেন, কারণ তিনি ঘুষ চান।
সাক্ষর
হ্যারি কে. টমাস
বিএনপি-জামায়াত আমলে বাংলাদেশ বিমানের আকাশছোঁয়া দুর্নীতির মূল হোতাবৃন্দ:
বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিমান একটি রুগ্ন ও ব্যর্থ সংস্থায় পরিণত হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে একটি বেসরকারি সংস্থাকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ দেয়া হয়। অন্যদিকে বিমান পরিণত হয়েছিল সোনা এবং অন্যান্য চোরাচালানের এক নিরাপদ র্যুটে। বিএনপি-জামায়াতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর মন্ত্রী হওয়ার আগে সোনা ও মূল্যবান সামগ্রীর চোরাচালান এবং লাগেজ চুরির ধান্দা করতেন বিমানবন্দরে। যে কারণে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘লাগেজ বাবর’ ওরফে ‘ক্যাসিও বাবর’। মন্ত্রী হওয়ার পর তার অধীনস্ত চক্রটি এই র্যুট অপারেট করত। যার বখরা পেতেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মীর নাছির এবং খালেদা জিয়ার ছোটভাই ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার শামীম এস্কান্দারসহ কয়েকজন।
সেসময় বিমান সংশ্লিষ্টরা ছিলেন চরম দুর্নীতিবাজ। শামীম এস্কান্দার ও জিয়া পরিবারের আত্মীয় হিসেবে পরিচিত মীর নাছিরের দুর্নীতি ছিল লাগামছাড়া। ক্ষমতা ছাড়ার ৪ মাস আগেও বিমানের ১০০ কোটি টাকার একটি কাজ বাগিয়ে নেন তারা। ২০০৭ সালের ৯ই মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে জানা যায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি বাবদ বিমানের কাছে দেড় হাজার কোটি টাকা পাবে। এছাড়াও দেশে-বিদেশে বিমানের দেনা আরো প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। জোট সরকারের ৫ বছরে বিমান যখন এই আড়াই হাজার কোটি টাকার লোকসানে পড়ে, ঠিক সেই সময়েই বেসরকারি বিমান সংস্থা জিএমজি নিজেদের ব্যবসার বিপুল লাভ ও প্রসার অর্জন করেছে।
শামীম এস্কান্দার এবং মীর নাছির ৫ বছরে বিমানকে ধ্বংস করে দেন। নাছির কয়েকশ কোটি এবং শামীম ও তার শ্যালক কমপক্ষে আড়াইশ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করেন। দুর্নীতির দায় থেকে বাঁচতে সরকারের শেষ দিকে চাকরি ছেড়ে দেন শামীম। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সার কেলেঙ্কারিতে কৃষকের ওপর গুলি চালানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ মির্জা ফখরুল ইসলামকে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে সরিয়ে আনা হয় বিমানে। দায়িত্ব পেয়ে তিনিও মেতে ওঠেন দুর্নীতিতে। ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। বিমানের লিজ, যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতসহ বিবিধ কাজে নিজের শ্যালক শাহেদুল হককে দিয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খোলান শামীম। এরপর বিদেশি কোম্পানির দেশিয় এজেন্ট হিসেবে সেগুলোর মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দেন বিদেশি কোম্পানিগুলোকে। এর মাধ্যমে মোটা অংকের কমিশন আদায় করতেন তারা।
এছাড়াও শামীম এস্কান্দার তার বোন খালেদা জিয়ার প্রভাব খাটিয়ে বিদেশ থেকে ৪টি জরাজীর্ণ বিমান ভাড়া করেন যাত্রী সেবার নামে। ৫ বছরে বিমানগুলোর পেছনে খরচ হয় ২৫০ কোটি টাকা। অথচ ওই টাকায় ৬টি বিমান কেনা যেত। এমনকি দ্বিগুণ দামে দুটি ডিসি-১০ ভাড়া নিয়ে ৫ বছরে ১০০ কোটি টাকা শুধু মেরামত বাবদ খরচ করা হয়। ৪০ লাখ ডলারে এই বিমান দুটি কেনা যেত, অথচ ৫ বছরে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার ভাড়া পরিশোধ করা হয় এগুলোর জন্য। ঠিক একইভাবে মার্কিন বিমান কোম্পানি বোয়িং দুর্নীতির সাথেও জড়িত ছিলেন শামীম এস্কান্দার। বিমানের কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি থেকে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি করেন প্রতিমন্ত্রী নাছির। এছাড়াও ক্রয়, লিজ ও পুরনো বিমান বিক্রির নামেও টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন তিনি।
বিমানকে বাঁচাতে জোট সরকার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় একপর্যায়ে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেরাই সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং দুর্নীতিবাজদের বিচার দাবি করেন। কিন্তু খালেদা সরকার তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এসব অনিময়, দুর্নীতি এবং কমিশন বাণিজ্যে হরিলুটের তথ্য জনসম্মুখে আসে।
আরও পড়ুনঃ
- বঙ্গোপসাগর কব্জা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র – প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টস
- মার্কিন গোপন তারবার্তা: বিএনপি আমলের হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেন খালেদার মুখ্য সচিব
- এক সেলফিতে ধ্বসে পরেছে বিএনপির শিবির
- ১১শ’ কোটি টাকা কর ফাঁকির দায় থেকে মুক্তি পেতে বিদেশি বন্ধুদের দিয়ে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন ড. ইউনুস