পোর্টাল

নর্থইস্ট নিউজ নামে ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে প্রকাশিত অখ্যাত একটি ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালে একটি মতামত ছাপা হয়েছে। যেখানে লেখক জনৈক চন্দন নন্দির দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয় এস আলমকে বিদ্যুৎকেন্দ্রর যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফের বিনিময়ে ১৫০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। শিরোনামনির্ভর প্রতিবেদনটি যে গোঁজামিলে ভরপুর একটা গুজব, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম আমদানির ওপর কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না, বহু বছর ধরেই সরকার এটা ট্যাক্স ফ্রি করে দিয়েছে। তাহলে এরকম ভুলভাল তথ্য বিদেশ থেকে ছড়ানোর মানে কী? নিশ্চয় উদ্দেশ্য আছে।

Tax Freeবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যত কেনাকাটা করা হয় তার সবই ট্যাক্স ফ্রি। পত্রিকা ঘাঁটলেই এই ট্যাক্স ফ্রি সংক্রান্ত বহু সংবাদ চোখে পড়বে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতির আনতে হলে আমদানির সময় বিদ্যুৎ বিভাগ এনবিআরকে একটি চিঠি দেয়, সেই চিঠির ওপর ভিত্তি করে এনবিআর ট্যাক্স মওকুফ করে দেয়। বাংলাদেশে যে ৭০টির বেশি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, তার সবগুলোই এভাবে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা পেয়েছে। এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে আয়, তার ওপরেও ট্যাক্স বসায় না সরকার। যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহক বিদ্যুৎ পেতে পারে।

এস আলম, ওরিয়ন, সামিট, ইউনাইটেডসহ সকল সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি ক্রয় থেকে শুরু করে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে এই ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা পেয়েছে। অর্থাৎ সরকারি যে নিয়ম রয়েছে, সে অনুসারেই এস আলম শুল্ক ছাড়াই সুবিধা পাচ্ছে। তাই এই সুবিধা পেতে কেন ১৫০০ কোটি টাকা দিতে হবে?

নর্থইস্ট নিউজ নামে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটা ইংরেজি পোর্টাল আছে। সেই পোর্টাল গত বছরের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে। তাদের মূল কাজ স্থানীয় সংবাদ ছাপানো, ‘Local is Vocal হলো তাদের স্লোগান। এমন একটি ভুঁইফোড় পোর্টালে চন্দন নন্দি ৪টি আর্টিকেল লিখেছেন ৬ দিনে। ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে ৯ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত এই কলামগুলো লিখেছেন তিনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই ৪টি কলামের ২টি শেখ হাসিনার পুত্র জয়কে নিয়ে লেখা, একটি বিএনপিকে নিয়ে এবং অপরটি আওয়ামী লীগকে নিয়ে। একটি ভুঁইফোড় পোর্টাল থেকে গুজব ছড়ানো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু নেই।

আরও পড়ুন : দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকেও থেমে নেই বিএনপি-জামায়াতের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, গুজব ও অপপ্রচার

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই পোর্টালসহ আরও কয়েকটি গুজবি পোর্টালের সাথে জড়িত রয়েছেন বাংলাদেশি এক নাগরিক। যিনি দেশ ছেড়ে ২০১৩-১৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন নাম-ধর্ম-পরিচয় বদলে এবং বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থান করছেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি যার বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন, সেখান থেকে তারা কয়েকটি নিউজপোর্টাল চালু করেন, যাতে বাংলাদেশ সরকার নিয়ে নানাসময় গুজব ও অপপ্রচার চালানো হয়। এর আগেও তারা শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবার নিয়ে মিথ্যা ও অপপ্রচার চালিয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসএসএফ বাহিনীকে বিতর্কিত করে বছরখানেক আগে একটি গুজব ছড়ায় এই গোষ্ঠী।

unknown personঅনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চন্দন নন্দি নামটি তার প্রকৃত নাম নয়। এই ছদ্মনামসহ আরও কয়েকটি নামে তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবং উক্ত বাংলাদেশি নাগরিক জার্মানি থেকে এসব ভুঁইফোড় পোর্টাল চালান। তাদের মালিকানায় বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে। একইসাথে ওয়েবহোস্টিংসহ সম্পূরক কয়েকটি ব্যবসায় জড়িত এই চক্রটি।

বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করে পালিয়ে যাবার পর ভারতে গ্রেপ্তারকৃত পিকে হালদার বর্তমানে ভারতে কারাবন্দী। সেই পিকে হালদারের জবানিতে চন্দন নন্দি এমন এক অদ্ভূত দাবি করেছেন, যা তিনি ছাড়া আর কেউ শোনেননি। ভারতীয় কোনো শীর্ষ গণমাধ্যম বা টিভি চ্যানেলেও এমন তথ্য প্রকাশিত-প্রচারিত হয়নি। একমাত্র চন্দন নন্দির ‘ট্রাস্ট মি ব্রো’ সূত্রে এই তথ্য উঠে এসেছে। পিকে হালদারের ভাষ্যে চন্দন নন্দির দাবি, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয় নাকি এস আলমের কাছ থেকে ১৫০০ কোটি টাকা নিয়েছেন, বিনিময়ে তাদের ট্যাক্স ফ্রি করে দিয়েছেন!

আরও পড়ুন : গয়েশ্বরের কূটবুদ্ধিতে দেশের অমূল্য খনিজ গ্যাস সম্পদ ধ্বংস, বিএনপির ভয়ঙ্কর চক্রান্ত ফাঁস!

অথচ প্রকৃত তথ্য হলো, এনবিআর ২০১৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি এস আলমকে ট্যাক্স ফ্রি করে গেজেট প্রকাশ করেছে। চন্দন নন্দির দাবি অনুসারে, টাকা লেনদেন হয়েছে নাকি ২০১৪ সালে! তাহলে সেই ট্যাক্স মওকুফ হতে এত বছর লেগেছে? ১৫০০ কোটি টাকা দিয়ে ৫ বছর হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিল এস আলম? বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনের এত বছর পর তার যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হলো এস আলমকে? এমনই গোঁজামিলে ভরপুর এই গুজব সংবাদ। বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ভারতীয় কোনো গণমাধ্যমে পিকে হালদারের এমন জবানবন্দি, বয়ান, তথ্য প্রদান সংক্রান্ত কোনো সংবাদ আজ অব্দি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, সরকারি ও বেসরকারি সকল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা দেয়া হয় জাতীয় স্বার্থেই। যেন গ্রাহককে বিদ্যুৎ পেতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে না হয়। ১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প আইনের ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী এই ছাড় মেলে। তবে দেশের স্বার্থেই সেই পুরনো আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর স্ট্যাম্প ডিউটি যাই আরোপযোগ্য হোক না কেন, এর পরিমাণ কোনভাবেই ১০ কোটি টাকার বেশি হবে না। অর্থাৎ ১০ কোটি টাকার বেশি ট্যাক্স ছাড় পায় না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, মোট ১৫টি খাত ট্যাক্স মওকুফের সুবিধা পায়। যার অর্থের পরিমাণ ক্ষেত্র বিশেষে কম-বেশি হয়। সবচেয়ে বেশি ১৯৯ কোটি টাকা ট্যাক্স মওকুফ করা হয় মেরিন বিমা খাতে। এ ছাড়া ভূমি ভাড়া, বিমা, নিরাপত্তা, শেয়ারের চুক্তি, বিদ্যুৎ বিতরণ চুক্তি ইত্যাদি খাতেও সরকার জনস্বার্থে অর্থ মওকুফ করে।

এ বছরের শুরুতে প্রথম আলো পত্রিকায় এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে দাবি করা হয়, হাজার কোটি টাকা শুল্ক ছাড় পেল বরিশালের বিদ্যুৎ কোম্পানি- বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিঃ (বিইপিসিএল)। অথচ খোঁজ নিয়ে পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্য। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব সুরাইয়া পারভীন বলেন, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে বড় বড় প্রকল্পে বিদ্যুৎ বিভাগের অনুরোধে আমরা স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ করি। বিইপিসিএল আবেদনটি ২০২২ সালের আগে করায় সেই অনুযায়ী তাদের শুল্ক মওকুফ করা হয়। তাই মওকুফকৃত স্ট্যাম্প ডিউটির অঙ্ক অনেক বড় মনে হলেও আসলে সরকার মওকুফ করেছে মাত্র ১০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন : দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত এবং কিছু পত্রিকা পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে

শুধু যন্ত্রপাতির ওপর ট্যাক্স নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত বিদেশিদের জন্য যদি মদও আমদানি করা হয় সেক্ষেত্রেও তার ট্যাক্স দিতে হয় না। যেমন, পটুয়াখালির পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনারা কাজ করছেন, তাদের জন্য বিদেশ থেকে কয়েক কোটি টাকার মদ আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। সেই মদের ওপরেও ট্যাক্স আরোপ করা হয়নি।

[ফ্যাক্ট যাচাই – সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে ভুয়া পোর্টাল থেকে ছড়ানো গুজব এবং এর সত্যতা]

অথচ গুজব পোর্টাল থেকে ছড়ানো হচ্ছে এস আলমের ট্যাক্স মওকুফের জন্য নাকি ১৫০০ কোটি টাকা নিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়! অথচ উপরোক্ত যৌক্তিক আলোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এর পুরোটাই ভুয়া ও গুজব।

আরও পড়ুন :