
বাঙালির ইতিহাস ভুলে যাবার প্রবণতাকে অনেকেই গোল্ডফিশ মেমোরি আখ্যা দেন। তাই মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, ২০০৭ সালে ড. ইউনূস তার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মূল কারণ হিসেবে কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে যোগ দিতে চাই কারণ এদেশের রাজনীতিবিদরা কখনই বাংলাদেশকে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে বের হতে দিবে না। তারা অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায়। তাই আমি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য রাজনীতিতে আসতে চাই।’
ড. ইউনূস ভেবেছিলেন ব্যাংকিং ও অর্থনীতিতে তার অর্জিত জ্ঞান ছাড়া বুঝি বাংলাদেশের উত্তরণ সম্ভব নয়। তার ধারণা পুরোপুরি অমূলক ছিল না সেসময়কার বাস্তবতায়। কারণ বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বাংলাদেশকে এলডিসি তালিকাভুক্ত রাখাকেই নিরাপদ বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ড. ইউনূসসহ দেশি-বিদেশি অনেক বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকের নানারকম গবেষণা, প্রক্ষেপনকে ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করতে সমর্থ হন।
মিথ্যা ও গুজব যাদের একমাত্র অবলম্বন, তারা সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাময়িক বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, কিন্তু সফলতার দেখা তারা পায় না। রিজার্ভ খালি হয়ে গেছে, ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে, ১০ই ডিসেম্বর সরকারের পতন ঘটবে, আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়া যাবে না, বিশ্বব্যাংক সরকারকে চাপে ফেলছে, অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ, মোদিবাহিনী বাংলাদেশের প্রশাসনে কাজ করছে, মোদি সরকার শেখ হাসিনার পক্ষে নেই- এমন হাজারো উদ্ভট গালগল্পের পাশাপাশি হাস্যকর সব ভবিষ্যদ্বাণী করে তথাকথিত অজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু এসব অপপ্রচারের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নীরবে-নিভৃতে যা অর্জন করেছে এবং যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তা সত্যিই অভাবনীয়। সাম্প্রতিক কিছু ইস্যুর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যের অতি সামান্য কিছু নমুনা-
১. ব্রিকসের সদস্য না হওয়াকে অনেকেই বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা দাবি করছে, কেউ আবার ভারতকে দোষারোপ করছে। তাদের দাবি, বাংলাদেশের রিজার্ভ খালি হয়ে গেছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ব্রিকস বাংলাদেশকে সদস্য করেনি। অথচ মাত্র ৫ দিন আগেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বব্যাংক ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশকে। অথচ এ নিয়ে কেউ সরকারকে কৃতিত্ব দেয়নি। প্রসঙ্গটা তুললে তারা হয়ত বলবে, ঋণ দিলে কী হয়েছে, টাকা তো ফেরত দিতে হবে। নিশ্চয় তা দেবে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফেরত দেয়ার সামর্থ না থাকলে কি ঋণ পেত বাংলাদেশ?
আরও কথা আছে। মাত্র দু’মাস আগে, জুন মাসে জলবায়ু, সহনশীল কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও সড়কে নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে ৮৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দেশের অর্থনীতি যদি দুর্বল এবং ভঙ্গুর হতো, রিজার্ভ যদি ফাঁকা হয়ে যেত, এভাবে একের পর এক ঋণ পেত বাংলাদেশ? ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বেশি, এটা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ভালো করেই জানে।
২. ২০২৬ সালে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। এতে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হওয়ার কথা। যা নিয়ে প্রতিনিয়ত দেশের কয়েকটি চিহ্নিত পত্রিকা ভাড়াটে কলামিস্টদের নিয়ে নানারকম উদ্ভট ও মনগড়া সাহিত্য রচনা করছে। সেখানে অর্থনীতি, রপ্তানি বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে বাংলাদেশ কীভাবে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে- এমন গল্প তুলে ধরা হচ্ছে। যারা এসব লিখছে, তারা সর্ববিষয়ে জ্ঞানী। যখন যে ইস্যু, তারা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দেন।
অথচ তারা এটা জানেন না, শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল রাখার স্বার্থে সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে বন্ধু দেশগুলোর আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। যার প্রমাণ, যুক্তরাজ্য ঘোষিত নতুন বাণিজ্য নীতিতে ২০২৬ সালের পরও ৯৮ ভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এছাড়া সহজতর রপ্তানি সুবিধাও থাকবে। এছাড়া ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম প্রধান বাজার কানাডা, সেদেশের সরকার অন্যদের ছাড়িয়ে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
[শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অর্জন]
৩. জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য নিয়ে দেশবিরোধীরা অনেক জলঘোলা করেছিল। পাশাপাশি ভাড়াটে ইউটিউমাররাও নানারকম গুজব ছড়িয়ে দাবি করেছিল, জাপান নাকি শেখ হাসিনা সরকারের পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, জাপানের সাথে সম্পর্ক আরও অনেক দৃঢ় হয়েছে বাংলাদেশের। দেশটির সাথে কৃষিখাত, শুল্ক বিষয়ক, প্রতিরক্ষা, আইসিটি ও সাইবার-নিরাপত্তা, শিল্পোন্নয়ন, বুদ্ধিবৃত্তিক (মেধা) সম্পদ, জাহাজ পুনর্ব্যবহার ও মেট্রোরেল বিষয়ে ৮টি পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে জাপানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে অধিক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের সমীক্ষা বলছে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাপানি জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, জাপানের চেয়ে বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদনের খরচ অর্ধেক এবং মুনাফা বেশি। তাছাড়া সরকারও বিনিয়োগবান্ধব। এজন্য ৭২ শতাংশ কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসার পরিধি আগামী ১-২ বছরের মধ্যে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে।
৪. অনেক বছর ধরে ষড়যন্ত্র চলছিল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার লালদিয়ার চরের বিস্তীর্ণ জায়গা নিয়ে। জায়গাটির মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। লালদিয়ার চরের সেই ৫৩ একর জমি উদ্ধার করেছে সরকার। সেই নিচু জলাভূমি কেন সরকারের কাছে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, এ নিয়ে দেশবিরোধীরা ব্যাপক গুজব ছড়িয়েছিল। অবশেষে জানা গেল, এখানে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় ডেনমার্ক ভিত্তিক গ্লোবাল শিপিং জায়ান্ট মার্স্ক লাইন। একইসাথে অপেক্ষমান তালিকায় রয়েছে সিঙ্গাপুর এবং আরব আমিরাতও। তারাও চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহী।
এভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে ভারত, রাশিয়া ও চীনের বিনিয়োগের প্রসঙ্গগুলো টেনে আনলে সেই তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ হবে। এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব, দক্ষ কূটনীতি, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দৃঢ়তার সাথে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ধরে রাখার মত বলিষ্ঠ অবস্থানের ফলে। কোনো সফলতাই আকাশ থেকে টুপ করে খসে পড়েনি। বিশ্বনেতাদের মাঝে তাই শেখ হাসিনা আজ একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তাঁর দেশ বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। সবকিছুর কারিগর শুধুমাত্র শেখ হাসিনা।
[বাংলাদেশ কিছু চেয়ে পাবে না, সেদিন আর নাই]
যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে আসা যাক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকের কাছে ধোঁয়াশাপূর্ণ। তাই কিছুটা বিশ্লেষণ জরুরি।
২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে। এটা ছিল দেশবিরোধী বিভিন্ন পক্ষের এক বড় বিজয়। অথচ সেই জিএসপি সুবিধা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। তবুও দুই দেশের বিদ্যমান কূটনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম, ইউটিউব আর পত্রপত্রিকায় তথাকথিত কলামিস্টদের নানারকম উদ্ভট লেখালেখিতে ভরপুর। অথচ এই তথাকথিত বিশ্লেষকরা যে মার্কিন নীতি ও কৌশলের মৌলিক বিষয়গুলো অবগত নয়, যার প্রমাণ বারবার পাওয়া যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারনী তিনটি পক্ষ হচ্ছে- রাজনৈতিক শক্তি পরিচালিত স্টেট ডিপার্টমেন্ট, পেন্টাগন তথা ডিফেন্স বিভাগ এবং অলিখিতভাবে প্রভাব বিস্তারকারী পক্ষ হচ্ছে ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিগণ।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, পেন্টাগন এ যাবত যত সিদ্ধান্ত দিয়েছে তার দেশটির স্বার্থে সবসময় সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ভিয়েতনাম, কিউবা, ইরাক, আফগানিস্তান এবং সর্বশেষ ইউক্রেন যুদ্ধ- সবক্ষেত্রে পেন্টাগনের বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব শক্তিশালী বলে বাধ্যবাধকতা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এসব যুদ্ধে জড়িয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা এ নিয়মে পরিবর্তন এসেছে। সামরিক খাতের ব্যয় ও অনুদানসহ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিফেন্স বিভাগে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুক্ত না হওয়ার কারণ এটাই। শুধু তা-ই নয়, স্যাংশন থাকা সত্ত্বেও র্যাবের তৎকালীন প্রধান বেনজীর আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেয়েছেন ঠিক একই সমীকরণে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির পুরোধা যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে রাজনীতি সেখানে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ পেতে যাচ্ছে মার্কিন জায়ান্ট এক্সনমোবিল। এক্ষেত্রে বিশাল একটি বিনিয়োগ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন যে মূলত দুই দেশের বাণিজ্যিক দর কষাকষি, সেটা স্পষ্ট। ২০০৯-এর বিশ্বমন্দার সময় কিংবা করোনা মহামারী হয়ে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া দেশটির নাম বাংলাদেশ। এটি ২০০৬ পূর্ববর্তী বাংলাদেশ নয়। শেখ হাসিনা সেজন্যই বলেছেন, বাংলাদেশ কিছু চাইবে আর বিশ্ব দিবে না, সে দিন আর নাই। জনগণও জানে, শেখ হাসিনা কোনো কিছু টার্গেট করলে বাংলাদেশ তা পাবেই। তাই যতদিন শেখ হাসিনার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
আরও পড়ুনঃ
- দোষী সাব্যস্ত হবেন জেনেই বিদেশীদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন ড. ইউনূস
- ইউনুসের নোবেল কেন রাজনৈতিক? কেন অর্থনীতিতে নয় শান্তিতে?
- বিশ্বনেতাদের মাত্রাতিরিক্ত ইউনূসপ্রীতি দেখে বাংলার এই প্রবাদটা মনে পড়ে যায় – ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’!