
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপর হয়ে ওঠার মধ্যেই ১৬ই আগস্ট বুধবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো রাখঢাক ছাড়াই সোজাসাপ্টা এমন একটা কথা বললেন, যা নিয়ে বেশ গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হওয়ার যে তাগিদ দিচ্ছে, মানবাধিকার নিয়ে যে কথা বলছে, তা ছল মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র মূলত বাংলাদেশকে ব্যবহার করে বঙ্গোসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। আর তা হলে এই অঞ্চল হয়ে উঠবে অস্থিতিশীল।
মার্কিনদের চক্রান্ত নিয়ে গত মে মাসে যুক্তরাজ্য সফরে শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান যুক্তরাষ্ট্র হয়ত তাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এছাড়া কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাম দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও সংসদে বলেছিলেন ঢাকাকে বাগে আনতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ওয়াশিংটন। তারা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ চায়, কোয়াডে বাংলাদেশকে চায়।
তবে বুধবারের এই সভায় শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি আরও বলেছেন, আমেরিকার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে নির্বাচন না, ওদের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র না। আমাদের গণতন্ত্রের নাম দিয়ে, নির্বাচনের নাম দিয়ে, নানা নাম দিয়ে এদেশে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়, যাতে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগরের জায়গাটা ব্যবহার করতে পারে। এটা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করা এবং দেশগুলোকে ধ্বংস করা, এটাই হচ্ছে কারও কারও উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের এত টালবাহানা। এই এলাকাটাকে নিয়ে নানাভাবে খেলার চক্রান্ত চলছে।
আরও পড়ুন : গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করায় ৪ দেশের ৩৯ জনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, নেক্সট কি বিএনপি?
তবে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা চাপে ফেলতে এমন কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন, নাকি এর পেছনে আসলেই কোনো কিছু আছে। এ বিষয়ে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু ফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলতে হয়। মার্কিনিদের অতীত ইতিহাস, বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, আন্তর্জাতিক জোটের রাজনীতি ও আঞ্চলিক প্রভাব- ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় আমলে নিতে হবে। তারই আলোকে এই বিশ্লেষণ।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে যে আগবাড়ানো অতি আগ্রহ দেখাচ্ছে তার পেছনে রয়েছে মূলত ব্যবসা। একাধিক মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু এসব ব্যবসা তারা বাংলাদেশের আইন ও বিধি মোতাবেক করার সুযোগ পাচ্ছে না দেখে তারা এজন্য মার্কিন রাজনীতিকে ব্যবহার করছে। কূটনীতির আড়ালে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহের প্রধান কারণ- সেন্টমার্টিন। তারা নানা কারণে এই উপমহাদেশে তাদের সামরিক উপস্থিতি তৈরি করতে চায়। যেজন্য বহুদিন ধরে তারা অপেক্ষায়। এজন্যই তাদের দরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সব ধরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভূখণ্ড কোনভাবেই বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। মার্কিনিদের সাথে ভারত ও শ্রীলঙ্কার বেশ ভালো সম্পর্ক থাকলেও স্ট্র্যাটেজিক কারণে সেখানকার জলসীমায় সেন্টমার্টিনের মত এমন উপযুক্ত স্থান নেই। তাছাড়া সেন্টমার্টিন থেকে একইসাথে অনেকগুলো দিক তারা কাভার করা সম্ভব। এজন্যই সেন্টমার্টিনের প্রতি তাদের প্রবল আগ্রহ।
এমনিতে আফগানিস্তানে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় উপমহাদেশে তেমন সুবিধা করতে পারছে না। ভারতের সাথে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা থাকায় মার্কিনিদের তারা অতটা ছাড় দিবে না এই অঞ্চলে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে ভারত একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও সম্পর্ক রেখেছে, রাশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্য অব্যহত রেখেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, ভারতকে দিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল হবে না এই অঞ্চলে। পাকিস্তান এখন দেউলিয়া। সেখানে চীনের প্রভাব বেড়েছে। পাকিস্থান ঋণ পাচ্ছে চীন থেকে। সেখানেও মার্কিনিদের সুবিধা হবে না, আগের সেই প্রভাবও নেই।
সবচেয়ে বড় দিক হলো, উপমহাদেশের অন্য দেশগুলো সামরিক কৌশলগত দিক থেকে ততাটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বাংলাদেশ যতটা। তাই বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিনিদের এত আগ্রহ। চাপ প্রয়োগ করে তারা বাংলাদেশে পুতুল সরকার আনতে চায়, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলগত আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করবে।
সেন্টমার্টিন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক আগ্রহ এখানে তীব্র। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে। আর এ কারণেই তারা মনে করছে বাংলাদেশে যদি মার্কিনিদের পুতুল সরকার না থাকে তাহলে বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা আস্তে আস্তে কমে যাবে বা গুটিয়ে নিতে হবে। সবল অর্থনীতি ও সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশে চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ মার্কিন বিরোধী ব্লকের উন্নত দেশগুলো এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার সুযোগ খুঁজছে এই অঞ্চলে। উন্নত অবকাঠামো, ব্যবসাবান্ধব সরকার ও দক্ষ জনশক্তির দেশ হওয়ায় বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করা। এই অঞ্চলে যে পরাশক্তি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তারাই এগিয়ে যাবে- এই লক্ষ্যে মার্কিনিদের শকুন দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের ওপর।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশকে নিয়ে বিদেশী মোড়লদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা: ব্যর্থ বিএনপির সাথে মাঠে নামানো হচ্ছে জামাতকেও
সম্প্রতি মার্কিন কোম্পানি লিন্ডেন এনার্জিকে বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের বড় ব্যবসা পাইয়ে দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। কোম্পানিটিকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধায় শুল্কমুক্ত কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম শুল্কে এলএনজি সরবরাহের সুযোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই কোম্পানিটি চিঠি দিয়ে বলেছে, তারা যদি ব্যবসাটি পায় বিনিময়ে তারা মার্কিন রাজনীতিবিদদের সে দেশের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পক্ষে অবস্থান নেবেন।
এমনকি এও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বাণিজ্য সুবিধা পেলে র্যাবের স্যাংশন তুলে নেওয়ার জন্য তারা কাজ করবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকার পায় সে বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। শুধু তাই নয়, লিন্ডেন এনার্জির আগ্রহপত্রে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও স্বাক্ষর করবেন বলে জানানো হয়েছে। মাইক পম্পেওর শেয়ার রয়েছে লিন্ডেন এনার্জিতে। তবে এটাও উল্লেখ করা জরুরি, পম্পেও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক চিফ ছিলেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লিন্ডেন এনার্জির কাঁধে বন্দুক রেখে বাংলাদেশকে নানারূপ লোভনীয় প্রস্তাব দেয়ার আড়ালে খোদ সিআইএ এবং পেন্টাগন নোংরা খেলা খেলছে কি না- এ নিয়ে ভাবার যথেস্ট কারণ রয়েছে। কারণ বিভিন্ন দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে না পারলে এভাবে সুকৌশলে বিভিন্ন ছদ্মবেশে সুঁই হয়ে ঢোকার বহু অতীত রেকর্ড রয়েছে মার্কিনিদের। তাছাড়া মাইক পম্পেওর রেকর্ডও এই প্রক্ষেপণে ২+২=৪ মিলিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন : আমেরিকা জামায়াতকে দিয়ে বাংলাদেশকে সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তানের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে চায়
তবে শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়নি কখনই, ভবিষ্যতেও নেবে না- এটা যারা আওয়ামী লীগ করেন না, তারাও জানেন এবং বিশ্বাস করেন। আর সরকারও মার্কিনিদের এসব লোভনীয় কিন্তু অন্যায় দাবিকে আমলে নিতে রাজি নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারা যোগ্য এবং দেশের জন্য যেটি লাভজনক বাংলাদেশ সেটি করবে। এটা মার্কিনিদের ঠেকিয়ে রাখার একটা ভদ্রোচিত কৌশল বটে।
[বঙ্গোপসাগর কব্জা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র – প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টস]
তবে মার্কিনিরা সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। তারাও নানারকম ছল-চাতুরির চেষ্টা করছে। দুদিন পর পর বিভিন্ন প্রাশাসনিক কর্মকর্তাকে পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে, নানারকম সবক দেয়ার চেষ্টা করছে। দূতাবাসের লোকজন প্রায়শ আগাছা শ্রেণির গণমাধ্যম অফিসে যাওয়া-আসা করছেন, একে-তাকে দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন রাষ্ট্রদূত। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বলা যায় মার্কিনিদের তৎপরতা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। বাংলাদেশে যেন তারা এন্টি আওয়ামী লীগ ঘরানার নয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সবকিছুর মূলে রয়েছে একটা পুতুল সরকার বসিয়ে এই অঞ্চল ও জলসীমাকে কব্জা করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা সেই সুযোগ তাদের দেবেন না- জনগণ সেটাই বিশ্বাস করে।
আরও পড়ুন :
- নির্বাচনের আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ছোটাছুটি কীসের আলামত?
- সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যান্টি আওয়ামী রাজনীতিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে
- যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কঠোর অবস্থানে শেখ হাসিনা