তারবার্তা

২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগকে সমূলে নিশ্চিহ্নের উদ্দেশ্যে যে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রক্ষমতা চিরকালের জন্য কুক্ষিগত করতে বিরোধীদলকে এভাবে দিনে-দুপুরে সমরাস্ত্র ব্যবহারে নিশ্চিহ্নের চেষ্টা করতে পারে, তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয় আজও।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্ঞাতসারেই তার কুলাঙ্গার পুত্র তারেক রহমান, অনুগত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্য, মন্ত্রীর ভাই ও শীর্ষ জঙ্গি সংগঠনের প্রধান নেতা ও তার সহচরবৃন্দ, দেশের সর্বোচ্চ দুটি নিরাপত্তা সংস্থার তৎকালীন প্রধান ব্যক্তিবর্গ- যারা তারেক রহমানের অনুগত, বিএনপির দোসর পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার অন্যতম কুশীলব পলাতক খুনিসহ একটি বড় চক্রের সম্মিলিত পরিকল্পনা ছিল এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। যাতে আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন, শারীরিকভাবে চিরতরে অক্ষম হন তিন শতাধিক, সবমিলিয়ে আহতের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।

শুধু হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বিএনপি সরকার, হতাহতদের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া, ঘটনাস্থলের সমস্ত আলামত বিনষ্ট করা, খুনিদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠানো, মিডিয়া সাইলেন্স করে দেয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিস্ক্রিয় করা, মামলা না নেয়া-ছাড়াও ঘটনার সাথে জড়িত দাবি করে নিরপরাধ কয়েকজনকে আটক করে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটায় খালেদা জিয়া সরকার। এমনকি সংসদে দাঁড়িয়ে এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনা নিয়ে বিদ্রুপও করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। শুধু তা-ই নয়, সেই ঘটনার দায়ভার ভারতের ওপর চাপানোর মত নোংরামিও করেছিল বিএনপি সরকার। যা মার্কিন গোপন তারবার্তায় উঠে এসেছে এবং উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া নথির বরাতে জানা যায়।

[মার্কিন গোপন তারবার্তা: বিএনপি সরকার ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় চাপিয়েছিল ভারতের ওপর]

তারবার্তা নং- ০৪, ঢাকা- ৩১৪৯; তারিখ- ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০০৪; সময়- ০২:২২ (পূর্বাহ্ন); শ্রেণি- কনফিডেনশিয়াল; বিষয়- পররাষ্ট্রসচিব মনে করেন ২১শে আগস্টের হামলার পেছনে ছিল ভারতীয়রা

১. (সি) উপসহকারী মন্ত্রী টরকেল প্যাটারসন ১৩ই সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাস ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাকে (নোট গ্রহণকারী) সঙ্গে নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ইতিমধ্যে আবার বৃষ্টি হয়েছে, গাছপালা পড়ে গেছে, রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। আগস্টের বন্যায় সৃষ্ট সমস্যাবলির কথা উল্লেখ করে প্যাটারসন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় সহযোগিতা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহের কথা শমসের চৌধুরীকে জানান। তারপর তিনি চৌধুরীর কাছে ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, তার এই সফরের উদ্দেশ্য ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র আটকের অব্যাখ্যাত ঘটনা এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলাসহ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ তুলে ধরা। উপসহকারী মন্ত্রী প্যাটারসন জোর দিয়ে বলেন, একটি সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক মতভেদ পাশে সরিয়ে রেখে এসব অপরাধের প্রতিকার করার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করার অনুরোধ জানান তিনি।

২. (সি) গ্রেনেড হামলার ঘটনা তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্যাটারসনের অনুরোধ শমসের চৌধুরী এড়িয়ে যান। ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে একমত হয়েও তিনি কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য দায়ী করেন আওয়ামী লীগকে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শেখ হাসিনার অসম্মতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতেই প্রমাণিত হয় যে আওয়ামী লীগ সরকারকে তদন্তকাজে সহযোগিতা করতে চায় না।’ ওই হামলার পেছনে বিএনপি সরকার দায়ী- আওয়ামী লীগের এই ধারণা তিনি হেসে উড়িয়ে দেন।

‘কোনো সরকার এত বোকা নয় যে এটার দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নেবে।’ ভবিষ্যতের যেকোনো সমস্যার জন্য তিনি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলেন, সরকারকে দোষারোপ করার রাজনীতি ‘অবশ্যই একটা কিছুকে প্রকট করে তোলে।’ আর খোদ গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ছিল একটা ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’, যার পরিণতিতে এটা ঘটেছে; এবং তিনি বলেন এ ধরনের ঘটনা থেকে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও সুরক্ষিত নয়।

৩ (সি) ঘটনাটি কে ঘটিয়ে থাকতে পারে, এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেন, কেউ ‘প্রতিবেশি বেছে নিতে পারে না’। তিনি ‘বিদেশের কিছু প্রতিক্রিয়ার’ কথা উল্লেখ করেন এবং ভারতীয় কিছু লোকের বাংলাদেশে গ্রেনেড পাচার করার ঘটনা সম্পর্কে সম্প্রতি প্রাপ্ত তথ্যের কথা বলেন। তিনি বাগ্মিতার সঙ্গে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ‘এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে কার স্বার্থ উদ্ধার হয়?’

[মার্কিন গোপন তারবার্তা: বিএনপি সরকার ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় চাপিয়েছিল ভারতের ওপর]

৪. (সি) রাষ্ট্রদূত টমাস অভিযোগগুলোর কথা উল্লেখ করে শমসের চৌধুরীর কাছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ও ভারতের কর্মকর্তাদের উত্তপ্ত মন্তব্যগুলোর ইস্যুটি উত্থাপন করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে এসব বাগাড়ম্বর থামবে। উত্তরে চৌধুরী বলেন যে তিনি ‘আগামীকালই’ ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে কথা বলবেন, তাকে জানাবেন যে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে তিনি আলোচনা করতে চান ‘সংবাদমাধ্যমের মারফতে নয়, বরং এক টেবিলে বসে’। তা সত্ত্বেও চৌধুরী নিরাপত্তা-পরিস্থিতির জন্য দোষারোপ করেন সেই সব লোকদের, যারা নিজেদের অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, যাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ আছে, ভাবাদর্শ আছে এবং ই-মেইল ঠিকানা আছে।

৫. (সি) মন্তব্য: ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার কেন একটি পুলিশি তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারছে না, এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সরকার নানা ধরনের কথাবার্তা বলছে, অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে। হামলার জন্য তারা আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করছে, ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’র কথা বলছে এবং ভারতীয়দের দোষারোপ করছে। যদিও এসব অভিযোগের পক্ষে তারা কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যেহেতু বাংলাদেশের ভালোভাবে জানা আছে, তাই এখন তাদের জিজ্ঞাসা করার উৎকৃষ্ট সময় যে, তদন্তের ফলাফল বিষয়ে একটি উপসংহারমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে কি না। মন্তব্য শেষ।

৬. (ইউ) এই তারবার্তা উপসহকারী মন্ত্রী প্যাটারসন কর্তৃক অনুমোদিত।

হ্যারি কে. টমাস

আরও পড়ুনঃ