
অনেকেরই মনে থাকবে, ২০২২ সালের ২৮শে জুলাই সর্বশেষ দলের আয়-ব্যয়ের হিসেব নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দিয়েছিল বিএনপি। তাতে দেখানো হয়েছে, ২০২১ সালে দলের আয় হয়েছে ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৪৪৪ টাকা। সদস্যদের মাসিক চাঁদা, মনোনয়ন ফরম বিক্রি, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান ও এফডিআর থেকে এ টাকা আয় হয়েছে। একই সময়ে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৪৭ হাজার ১৭১ টাকা। কর্মচারীদের বেতন-বোনাস, ক্রোড়পত্র বিল, অফিস খরচসহ বিভিন্ন খাতে এ অর্থ ব্যয় হয়েছে। হিসেব অনুযায়ী, বিএনপির আয়ের চেয়ে ১ কোটি ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭২৭ টাকা বেশি ব্যয় করেছে।
অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট, বিএনপি অর্থ সংকটে রয়েছে। অথচ সেই দলটিই একেকটি কর্মসূচির পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। প্রচার-প্রচারনার কাজে ব্যানার-ফেস্টুন, লোক ভাড়া করা, সমাবেশের মঞ্চ তৈরি, সারাদেশ থেকে আসা নেতা-কর্মীদের থাকা-খাওয়ার খরচ- সব মিলে এক দিনের একটি কর্মসূচিতেই ব্যয় ন্যূনতম ৮-১০ কোটি টাকা। কর্মসূচির কলেবার বৃদ্ধি পেলে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক গুণ।
সম্প্রতি বিএনপি সারাদেশে পদযাত্রাসহ তারুণ্যের সমাবেশ করছে। এসব সমাবেশের পেছনে দলের পক্ষ থেকে শত শত কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। আগামী ২৭শে জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। সেখানে সারাদেশ থেকে লোক এনে সমাগম করা হবে বলে জানা গেছে। আর এজন্য দলের পক্ষ থেকে আলাদা বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেকোনোভাবে হোক ঢাকা শহরে হাজার হাজার লোক এনে হাজির করত হবে সমাবেশকে সফল করে তুলতে। আর্থিক সংকট নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই, দলের পক্ষ থেকেই খরচ চালানো হবে।
ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য অনুসারে, আর্থিক সংকটে থাকা একটি দলের কর্মসূচির পেছনে এত বিপুল অর্থ সংকুলান হচ্ছে কীভাবে? এসব নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। বিএনপির তহবিলে হঠাৎ বিপুল অর্থ ঢুকছে, এর উৎস কী? কোটি টাকা ঘাটতিতে থাকা দলটি এত টাকা কোত্থেকে পাচ্ছে? এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মাঝে উঠেছে।
আরও পড়ুন : চাঁদাবাজি-ই হচ্ছে তারেক রহমানের আয়ের উৎস!
জানতে চাইলে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল দপ্তর কর্মকর্তার দাবি, দলীয় কর্মসূচি নির্বিঘ্নে পালন করতে যে অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে তার সিংহভাগ আসছে লন্ডন থেকে। তারেক রহমান নিজেই এই অর্থের সংকুলান করছেন বলে দাবি ওই কর্মকর্তার। কিন্তু আবার সেই একই প্রশ্ন উঠছে- তারেক রহমানের এই বিপুল অর্থের উৎস আসলে কী? দৃশ্যমান কোনো উপার্জন না করেও তারেক রহমান লন্ডনে বসে এই অর্থের সংকুলান করছেন কীভাবে?
যেখানে ব্রিটেন এখন স্মরণকালের অন্যতম বড় ধরণের আর্থিক মন্দায় পড়েছে, সাধারণ মানুষ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, প্রতিনিয়ত ছাঁটাই চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সেখানে তারেক রহমান কীভাবে রমরমা অবস্থায় রয়েছেন? নিজের বিলাসী জীবন-যাপন ছাড়াও দলের কর্মসূচির জন্য এত অর্থ পাঠাচ্ছেন, কে যোগাচ্ছে এই অর্থ? ভূত নিশ্চয় নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারেকের অর্থের উৎস মূলত বাংলাদেশ। এখান থেকেই বিভিন্ন পথে লল্ডনে তার কাছে অর্থ যায় এবং পরে সেই অর্থ কর্মসূচির নামে দলের অ্যাকাউন্টে ঢুকছে। কিন্তু তারেককে কে বা কারা অর্থ পাঠাচ্ছেন, সেটি আরেক প্রশ্ন। সূত্র বলছে, তারেকের অর্থের যোগানদাতা হলো বাংলাদেশি একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, তারা লন্ডনে টাকা পাঠান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সদস্য এমন একটি ব্যবসায়ী শ্রেণি রয়েছে, যারা বিএনপি-জামায়াতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। মূলত তারাই লন্ডনে তারেক রহমানকে অর্থের যোগান দিচ্ছেন বলে সূত্রের দাবি।
তারা সরাসরি বিএনপির কর্মসূচিতে অনুদান দিতে পারছেন না প্রশাসনের নজরে পড়ে যাওয়া কিংবা সরকারের ব্ল্যাকলিস্টে নাম ওঠার শঙ্কা থেকে। তাই তারা আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন বাইরে। সেই কালো টাকার একটা অংশ তারেক রহমান ক্যাসিনোতে ঘুরিয়ে সাদা করে নিচ্ছেন। পরে সেটাই দেশে পাঠাচ্ছেন। এই ব্যবসায়ীরা অর্থের যোগান দিয়ে বিএনপির আন্দোলনকে বিস্তৃত করার পেছনে ভূমিকা রাখছে। বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও, নাশকতা, সন্ত্রাস, খুনের দায় তাদের ওপরেও বর্তাবে নিশ্চয়। তবুও বিএনপি-জামায়াতপন্থী এই ব্যবসায়ীরা মরিয়া বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে। সেজন্যই এই অর্থায়নকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখছেন তারা।
আরও পড়ুন : আবারও কর্মসূচি বিএনপির, নির্বাচনের আগে মরণকামড় দিতে মরিয়া সন্ত্রাসবাদী দলটি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক একজন অধ্যাপক বলেন, ব্যবসায়ীরা সাধারণত সরকারের অনুগত নয়। তারা আদর্শিকভাবে রাজনীতি করেন না। তারা বুঝেন স্বার্থ। এদের একটি অংশ রাজনীতিতে আসেন ব্যবসার স্বার্থ হাসিল করতে। নানা কৌশলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার আশায় সব সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কে বজায় রাখেন তারা। এর বড় উদাহরণ- লাল তীর সিড লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। যিনি এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি। বর্তমানে সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে না থাকলেও প্রভাব কমেনি। দেশের সব ব্যবসায়ী সংগঠনে তার অনুগত ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। কলকাঠি নাড়ান তাদের মাধ্যমে।
মিন্টুর সাথে প্রশাসনেরও সুসম্পর্ক রয়েছে। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যবসা করতে পারেননি, নানা অজুহাতে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া হতো। অথচ আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন। লাল তীর সিড দেশের অন্যতম শীর্ষ বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। দেশে-বিদেশে সুনামও অর্জন করছে। সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণেই তারা টিকে আছে। অথচ সুফল ভোগ করছে বিএনপি।
লাল তীর ছাড়াও বিএনপি-জামায়াতপন্থী মালিকানাধীন বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি রয়েছে, যারা এই সরকারের আমলে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছেন, সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থানের সুযোগ নিয়ে তারা ব্যবসার পরিধি বাড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ নয় বলেই তারা নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে ব্যবসা করছেন। অথচ তারা এই সরকারকে উৎখাত ও ষড়যন্ত্রের পেছনেও অর্থায়ন করছেন। এটাই আইরনি। এরা ওপরে ওপরে সরকার ও প্রশাসনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন, আর গোপনে তারেক রহমানকে অর্থের যোগান দিচ্ছেন।
[নেতৃত্বহীন ছন্নছাড়া দল বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিপুল অর্থের যোগান আসছে যেভাবে]
তবে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলো থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, খুন, অগ্নিসংযোগের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেসব নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে বিএনপির কর্মসূচিতে অর্থায়নে কারা জড়িত, সে সংক্রান্ত কিছু তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এসেছে। ইতিমধ্যেই কয়েকজন ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা গেছে বলে বিশেষ একটি সূত্র জানিয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের দাবি, কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসবাদের পেছনে যে ব্লাডমানি যোগান দেয়া হচ্ছে বিএনপিকে, তার উৎস বন্ধ না হলে বিএনপি নির্বাচন বানচাল ও দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তাই এখনই সময় তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আরও পড়ুন :
- দেশের ব্যাংকিং খাত পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল বিএনপি আমলে, জিয়া পরিবারের হাতে
- ভাঙা স্যুটকেস-ছেঁড়া গেঞ্জি থেকে শত কোটি টাকার মালিক জিয়া পরিবার
- তথ্য বিশ্লেষণঃ বিএনপি’র দুর্নীতির চ্যাম্পিয়নশিপ! আওয়ামী লীগের প্রোপাগাণ্ডার না বিএনপির কৃতকর্মের ফলাফল?