বাংলাদেশ

ঢাকায় চারদিনের সফর শেষ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল। এদিকে ইইউ প্রতিনিধি দল ২ সপ্তাহের সফরে ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করছে। নির্বাচনের আগে কূটনীতিকদের এই দৌড়ঝাঁপ নিয়ে চলছে আলোচনা। বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ নতুন কিছু না, আগে বাংলাদেশে কর্মরত ছোটখাট কূটনীতিকরাই এসব নিয়ে নাক গলাতেন, সবক দিতেন। এখন বিদেশ থেকে বড় কূটনীতিকরা আসেন। এদেশে কেউ কেউ বিদেশিদেরকে অধিক গুরুত্ব দেয়। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সবসময় বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। গণমাধ্যমও বিদেশিদের নিয়ে এমনভাবে সংবাদ করে, যেন তারা বাংলাদেশের প্রভু। তাতে বিদেশিরা ধরে নেয়, বাংলাদেশের কিসে ভালো হবে, সেটা তারা বাংলাদেশিদের চেয়ে এবং সরকারের চেয়েও বেশি বুঝে।

ইতিহাস সাক্ষী, বিদেশিরা কখনই বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতসহ বিভিন্ন ইস্যুর সমাধান করেনি। ৭৫ পরবর্তী সময়ে সামরিক জান্তা সরকারগুলোর আমলে গণতন্ত্র বলে কিছুই ছিল না। তবুও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, সঠিক পথে আনতে জনগণই লড়াই করেছে, আত্মত্যাগ করেছে। এটা স্পষ্ট, জনগণের ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। বিদেশিরা যে বাংলাদেশে আসেন, তারা কি আসলে বাংলাদেশের ভালো চেয়ে আসেন? তারা কি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন? তারা কি এদেশে স্বৈরশাসক দূর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন? বরং, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব খাদের কিনারায় নিয়ে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করায় জড়িত ছিল বিদেশিরা। তাহলে কোন হিসেবে তাদের ওপর আমাদের মেরুদন্ডহীন রাজনৈতিক দলগুলো ভরসা রাখতে চায়, কেন চায়?

বিএনপি-জামায়াতের আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগ এবং এক-এগারোর দখলদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায়ের পর দেশ স্থিতিশীল অবস্থায় আসে ২০০৮ সালে। সেক্যুলার ধারায় ফিরেছে দেশের রাজনীতি। আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে চমৎকার বিদেশনীতি গৃহীত হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ফলে দেশের অভ্যন্তরে ও প্রতিবেশিদের সাথে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে সঠিক নীতি ও কৌশলের সমন্বয়ে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে। প্রধান অপর রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো কখনই এমন নীতিতে বিশ্বাসী নয়। ফলে এ সরকার ক্ষমতায় না থাকলে দেশের স্থিতিশীলতা যে নষ্ট হবে, তা সহজেই বলা যায়। তাদের অতীত ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবিও করতে পারে না।

[বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভাববে জনগণ, বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ নাই]

যদি এমন কোন দল থাকত দেশে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে, যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে মানে, যারা ১৫ই আগস্ট বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার হীন চেষ্টা বলে বিশ্বাস করে, ২১শে আগস্টের নৃশংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ় তাদের অবস্থান, অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে একমত, তাহলে বোঝা যেত যে, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও উল্লেখিত বিষয়ে তারা নির্মোহ। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো বিকল্প রাজনৈতিক দল নেই। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে নানারকম প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসা বিদেশি কোনো গোষ্ঠী উল্লেখিত বিষয়ে নির্মোহ অবস্থান দেখায়নি। বরং, আজও বহু রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনিকে সেসব দেশ বহাল তবিয়তে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে। অথচ সেসব দেশে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলছে।

তাই এটা স্পষ্ট, বিদেশিদের নাক গলানোর পেছনে নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। মূলত ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক বা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থই প্রধান। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিদেশিদের তৎপরতা ছিল। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারাঙ্কো এসেছিলেন। কমনওয়েলথ কর্মকর্তারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিদেশিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। নানারকম প্রেসক্রিপশন, সবক নিয়ে হাজির হয়েছেন তারা। তবে এখন বড় পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর বড়সড় পরিবর্তন হয়েছে, যাতে বিদেশিরা স্বার্থ খুঁজে পাচ্ছেন। সরকারও বিভিন্ন দেশকে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানাবিধ সুযোগ দিচ্ছেন। ফলে বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশ এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী দেশ। তাই তাদের ভোল বদলেছে।

[বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভাববে জনগণ, বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ নাই]

বর্তমানে সফররত ইইউ’র প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের সংবিধানের বাইরে গিয়ে অন্য কোনোভাবে নির্বাচনের কথা তোলেনি। তারা বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও আইনি ব্যবস্থার ভিত্তিতেই নির্বাচন দেখতে চায়। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে তারা আশ্বস্ত বলে জানিয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকেও সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান ও বিধি-বিধান অনুসারে আগামী নির্বাচন হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে। এখানে পার্লামেন্ট বিলুপ্তি বা সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভাবনা তো দূর কি বাত!

যেহেতু বাংলাদেশ সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়- নীতিতে চলে, তাই বাংলাদেশের এই স্থিতিশীলতা বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশের ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ নয়, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে বন্ধুবৎসল ও নিরাপদ রাষ্ট্র ভাবছে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতির কারণে। তাই বর্তমানে নাক গলানোর চেয়ে সৌহার্দ্যটাই বেড়েছে বাংলাদেশের প্রতি। এই অবস্থান কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি নিজস্ব কূটনৈতিক পেশাদারিত্বের জায়গায় শক্ত ও অনড় অবস্থান তৈরি করতে পারে, তাহলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, সুশাসন ইত্যাদি নিয়ে বিদেশিদের আলাপের সুযোগ থাকবে না। বাংলাদেশে যদি আভ্যন্তরীণ সমস্যা বা কোনো ইস্যু থাকে, তা সমধান করবে জনগণ, সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ, বাস্তবায়নে কাজ করবে সরকার। এখানে বিদেশি তৃতীয় পক্ষের নাক গলানোর অধিকারই নাই।

আরও পড়ুনঃ