সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় বিশ্বজুড়ে রাশান জুজুর পেছনে তাড়া করে বেড়িয়েছে। শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে টুকরো করে দিয়েছিল, যদি সারাবিশ্ব কমিউনিস্ট রাশিয়ার পদানত হয়ে যায়, সেই চিন্তা থেকে। বিশ্বের যেখানেই কমিউনিজমের চর্চা দেখেছে, সেখানেই তারা হানা দিয়েছে, সরকার উৎখাত করেছে, প্রয়োজনে হত্যা করেছে রাষ্ট্রনায়কদের। যেমন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রকে রাখা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের জেরে ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সর্বশক্তি বিনিয়োগ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কালক্রমে মার্কিনিদের কূটকৌশলে পরিবর্তন এসেছে।

আগে যেমন সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থীদের হঠাতে অস্ত্র ব্যবহার করত মার্কিনিরা, বিভিন্ন দেশে খুনি পাঠাতে হতো, এখন আর সে কাজটি করতে হয় না। বরং এখনকার রাজনীতি ভিন্ন। বামপন্থীদেরই উল্টো পুঁজিবাদী মার্কিনিরা লালন-পালন করছে, সেদেশে স্থায়ী নিবাসের সুযোগ দিচ্ছে, নগদ অর্থ দিচ্ছে, বিনিময়ে তাদের আদেশ মত কাজ করতে হচ্ছে। মার্কিনিদের এঁকে দেয়া ছক অনুসারে নিজ দেশে সমাজতন্ত্রের নাটক করতে হচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশি বামপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় না, মার্কিন কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে রাষ্ট্রের চুক্তি হলে তার বিরোধিতা করে না। বামরা তাদের বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়, যাদের অস্তিত্ব মার্কিনিদের স্বার্থের পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়। অর্থাৎ, বাম ও মার্কিনিদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। শুধু বামরাই নয়, উগ্র ডানপন্থী, মৌলবাদীরাও মার্কিনিদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। তাদেরও কমন শত্রু ক্ষমতাসীন সরকার। বিভিন্ন দেশে উগ্রবাদ ছড়িয়ে দিতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিষ্ঠায় মার্কিনিদের হাত রয়েছে, তা উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিপত্রেই প্রমাণ রয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের স্পৃক্ততা ফাঁস হয় এভাবেই।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশকে নিয়ে বিদেশী মোড়লদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা: ব্যর্থ বিএনপির সাথে মাঠে নামানো হচ্ছে জামাতকেও

মার্কিনিরা নিজেদের স্বার্থেই বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে চীন ও রাশিয়ার দৃঢ় সম্পর্কের কারণে মার্কিনিরা হন্যে হয়ে উঠেপড়ে লেগেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাদের নজর সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর বহু বছর ধরেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আশপাশে ও অভ্যন্তরে মার্কিনিরা নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে মার্কিনিরা চীনের নাকের ডগায় নিজস্ব ঘাঁটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বিবেচনা করে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে। আর সেটা বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্টমার্টিনকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছেন কয়েক বছর আগে। দ্বীপটির আশপাশের নির্দিষ্ট সামুদ্রিক এলাকা পর্যন্ত কোনো নৌঘাঁটি কিংবা স্থাপনা তৈরি করা নিষিদ্ধ করা হয় ‘পরিবেশের স্বার্থে’। এমন কৌশল স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনিরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি।

USAবাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুইভাগে বিভক্ত- আওয়ামী লীগ এবং অ্যান্টি আওয়ামী লীগে। দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোও তাই আবর্তিত হয় এই দুই বলয় কেন্দ্র করে। একসময় বামরা প্রগতিশীল রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে তারা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিলে একই ঘরানার রাজনীতি করছে। তাদের লক্ষ্য একটাই, আওয়ামী লীগ সরকারকে হঠিয়ে প্রভুদের ক্ষমতায় বসানো। আর সেই প্রভু বিএনপি বা যে কেউ হতে পারে, শুধু মার্কিনিদের পাদুকা লেহন করলেই হলো। এমন পুতুল সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে, যারা মার্কিনিদের স্বার্থে কাজ করছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদেরকে মার্কিনিদের পক্ষ নিতে হয়, ভোট দিতে হয়, মার্কিনিদের সুরে গাইতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার মার্কিনিদের হীন স্বার্থে বাগড়া দিয়েছেন, বাংলাদেশকে মার্কিনিদের হাতের পুতুল হওয়া থেকে, বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া থেকে ঠেকিয়ে রেখেছেন। তাই মার্কিনিরা এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ইন্ধন যোগাচ্ছে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ গোষ্ঠীকে। আর সেজন্য বাম-ডান, উগ্র ডান সবাই এক কাতারে মিলেছে।

একসময় বাংলাদেশি বামদের সম্পর্কে একটি প্রবাদ ও কৌতুক প্রচলিত ছিল, পিকিংয়ে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশি বামরা ছাতা ধরতো। এখন এই প্রবাদটি অন্যভাবে অ্যান্টি আওয়ামী পক্ষ তথা বিএনপি ও বাকিদের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে। তাদের রাজনীতি এখন পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর হয়ে গেছে। মার্কিনিরা আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দেবে, তাতে সরকার বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আব্দার মেনে নিবে আর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে মার্কিন লেজুড়রা ক্ষমতায় আসবে, এমন একটি দিবাস্বপ্নের হিসেব-নিকে নিয়ে বিএনপি এক ঘোরের মধ্যে আছে। বিএনপির রাজনীতিতে তাই মার্কিন নির্ভরতা স্পষ্ট।

মির্জা-ফখরুল-ইসলাম-আলমগীর-1-300x228নির্লজ্জের মত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলছেন- মার্কিনিদের কাছে আমরা যাই না, তারা আমাদের ডাকে। তার এমন বক্তব্যে তো এটাই স্পষ্ট, কে মনিব, কে ভৃত্য। ডাকিবা মাত্রই জিভ বের করে দৌড়ে হাজির হওয়াতেই তা স্পষ্ট। শোনা যাচ্ছে, গত নির্বাচনপূর্ব সময়ের মত এবারও মার্কিন প্রভাবশালী লবিস্ট ফার্ম ব্লু স্টারকে নিয়োগ করেছে বিএনপি। বিএনপির যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নেতা আব্দুস সাত্তার জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয় সেজন্য যেন যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রাখে তা নিশ্চিত করার জন্যই ব্লু স্টারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির নেতারা এখন প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে নালিশ করছেন। গত ২৪শে মে যখন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, ঘোষণার পরপরই বিএনপি নেতাদের মধ্যে উচ্ছাস ও বাঁধভাঙা আনন্দ লক্ষ্য করা গেছে। তাদের উল্লাসে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে গেল আর বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিল মার্কিনিরা। তারা সেই ভিসা নীতি নিয়ে আবেগপ্রবণও হয়ে প্রচুর বক্তব্য বিবৃতি দিতে শুরু করলেন। এই নীতির ফলে তারা যেন ক্ষমতায় বসার পথের আধাআধি এসে পড়েছেন! বিএনপির নেতারা এখন প্রকাশ্যেই বলেন, তাদের কিছুই করতে হবে না, চুপচাপ বসে থাকবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারকে একতরফা নির্বাচন করতে দেবে না।

আরও পড়ুন : আমেরিকা জামায়াতকে দিয়ে বাংলাদেশকে সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তানের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে চায়

বিএনপির নেতারা এও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির ফলে নাকি এই সরকারের কাঁপুনি শুরু হয়েছে। বিএনপির পাশাপাশি বামেরাও বেশ উল্লসিত। যে বামরা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একদা স্লোগান দিত, যে ইসলামপন্থী দলগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিত, তারা সবাই এখন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে মার্কিন দালালের তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। এমনকি ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতারা নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে আসা-যাওয়া করেন, বাম নেতারাও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি গাড়ির মালিক হয়েছেন, অনেকের ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের সাথে।

অথচ একযুগ আগেও এমন দৃশ্য দেখা যেত না। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, মার্কিন বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আসছে অ্যান্টি আওয়ামীপন্থী বিভিন্ন দলের বড় বড় নেতাদের কাছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রধান শক্তি হলো দেশের জনগণ। কিন্তু বিএনপি ও অ্যান্টি আওয়ামীপন্থীদের ভিত্তি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশিশক্তি।

war৬ মাসের কম সময়ে রয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। বিএনপি প্রতিদিনই একদফা আন্দোলন কিংবা ১০ দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিচ্ছে। এমনকি সরকারকে উৎখাতের ডাক দিচ্ছে প্রকাশ্যে, যা একটা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধও। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনকে হত্যার হুমকিও দিচ্ছে। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা হবে, গণআন্দোলন গড়ে তুলবে ইত্যাদি। যদিও সেভাবে তাদেরকে রাজপথে জোরালো কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে ভোটে জিতিয়ে দেবে কিংবা হলিউডি সিনেমার মত বড় বড় রণতরী নিয়ে এগিয়ে আসবে মার্কিন সামরিক বাহিনী, তারপর তাদের স্পেশাল ফোর্স এসে একটা কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিবে এবং সরকারের পতন ঘটবে। এমন অপেক্ষায় ইয়া নফসি ইয়া নফসি করে দিন গুণছে বিএনপি!

বিএনপির অনেক নেতা প্রকাশ্যেই যেন নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশে ২০১৪ বা ২০১৮ এর মতো নির্বাচন হবে না। এও বলছেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায় তাহলে সেই নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র নাকি স্বীকৃতি দেবে না। আর বিএনপিও সেরকম নির্বাচন হতে দেবে না। কিন্তু জনগণের প্রশ্ন, একটি রাজনৈতিক দল কি বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে নিজেদের দাবি আদায় করতে পারে? সে রকম বাস্তবতা কি বাংলাদেশে আছে? দেশের সাধারণ মানুষ কি এমন পশ্চিমা আগ্রাসন মেনে নেবে? দেশের স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে কি সাধারণ মানুষ বিদেশিদেরকে এদেশের ওপর ছড়ি ঘোরানো মেনে নেবে? বাংলাদেশের মিত্ররা কি চুপ করে থাকবে?

আরও পড়ুন : বিএনপি সাদা হাতিদের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন, বিশ্বের যে কোনো দেশই বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করতে পারে বন্ধুপ্রতিম চাওয়া থেকে। কিন্তু সেজন্য চাপ প্রয়োগ কিংবা বাধ্য করার তো প্রশ্নই আসে না। এটা তো আর মধ্যযুগ নয় যে জোর যার মুল্লুক তার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে কোনো কিছুতে বাধ্য করতে পারে না। বরং বিভক্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চাওয়া বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরও খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশেরও এমন অনেক মিত্ররাষ্ট্র রয়েছে, যারা মার্কিন চাপাচাপির বিপরীতে শক্ত প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এতে সরকারও যদি দেশের স্বার্থে কঠোর অবস্থানে গিয়ে নির্বাচন করে এবং আইন অনুসারেই বিদেশিদের সাথে হাত মেলানো দেশদ্রোহীদের বিচারের আওতায় আনে, তখন কিন্তু সরকারকে দোষ দেয়া যাবে না। কারণ, দেশের স্বার্থই সবার ওপরে।

[অ্যান্টি আওয়ামী রাজনীতিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র]

এখন বাম-ডান-উগ্রবাদী গোষ্ঠী এবং বিএনপির মত বিদেশিদর লেজুড় দলগুলো যদি সরকারকে নির্বাচনের দাবিতে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চায়, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই বিদেশি অপশক্তির সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে এবং জনগণকে নিজেদের দাবির সাথে একাত্ম করতে হবে। জনগণ যদি প্রভাবিত হয় তবেই তারা নিজেদের দাবির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে। নইলে তারা দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী মীরজাফর হিসেবেই চিহ্নিত হবে ইতিহাসে।

আরও পড়ুন :