শেখ হাসিনা

বিগত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের একটি শীতল সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। বিএনপি-জামাতের লবিস্ট ফার্মগুলোর মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মার্কিন স্যাংশন আরোপ, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য প্রদান, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের অধিকারসহ বেশ কিছু ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অযাচিত নাক গলানোর ঘটনায় বাংলাদেশ সরাসরি অসন্তুষ্টি জানিয়েছে। সেই সাথে মার্কিন প্রশাসনের এহেন আচরণের প্রতিবাদও জানিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আর হস্তক্ষেপ করবে না বলে সরাসরি হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়েছে; তবুও বাংলাদেশ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আচরণেই স্পষ্ট।

জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর করে দেশে ফেরার আগেই যুক্তরাজ্যে বিবিসিকে দেয়া সক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। যেখানে তিনি অনেক কঠোর বার্তা দিয়েছেন। এরপর দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনেও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, যেসব দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিবে তাদের কাছ থেকে কোনো পণ্য কেনা হবে না। আন্তর্জাতিক দরপত্রগুলোর নথিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে স্যাংশন দেওয়া দেশগুলো থেকে কোনো পণ্য কেনা হবে না। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন যে- আমার ভয় কিসের। এমনকি তিনি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্বৃতি দিয়ে বলেছেন, সেসময় মার্কিনিরা ৭ম নৌবহর পাঠিয়েও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে রোধ করতে পারেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ যে ৬টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা বাড়তি প্রটোকল পেতেন, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন থেকে তারা কোনো অতিরিক্ত প্রটোকল সুবিধা পাবেন না। যদি তাদের প্রটোকলের একান্তই প্রয়োজন হয় তবে তারা যথাযথ পেমেন্ট প্রদান করার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যদের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সুবিধা পেতে পারেন।

এসব ঘটনা রাজনীতিতে নতুন কূটনৈতিক উত্তাপ তৈরি করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে চলে গেল? প্রশ্ন ওঠার বড় কারণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন এবং বিভিন্ন মন্তব্যের কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি হয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই বার্তাই দিতে চাচ্ছেন যে, বাংলাদেশ আগের মত দরিদ্র ও বিদেশি দান-নির্ভর দেশ নয় যে সবাইকে তোয়াজ করে চলতে হবে। এই বাংলাদেশ এখন স্বাবলম্বী এবং দৃঢ় মেরুদন্ডবিশিষ্ট দেশ, কারও উস্কানিতে বা হুমকিতে ভয় পায় না। পুরোপুরি হার্ডলাইনে না হলেও প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা কৌশলগত সমঝোতার চেষ্টা করছেন বা চাপের বিপরীতে পাল্টা চাপ প্রয়োগ করছেন।

[যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কঠোর অবস্থানে শেখ হাসিনা]

উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে অত্যাধুনিক ৪টি যাত্রীবাহী বিমান ক্রয়ের চুক্তি হয়। যা ইতিমধ্যে সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্পতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিমান সংগ্রহের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও বোয়িং বা অন্য কোনো মার্কিন সংস্থা থেকে আর বিমান কিনছে না বাংলাদেশ। বরং সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন তিনি ১০টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে বিমানগুলো কেনা হবে ফরাসি বিশ্বখ্যাত কোম্পানি এয়ারবাস থেকে। অর্থাৎ এখানেও একটি রাজনৈতিক চাল রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বড় ধরণের চাপে পড়ে গেছে মার্কিন মিত্র ফ্রান্স। ফলে সম্প্রতি ফ্রান্সও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে। জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে ফরাসি সরকারও মার্কিনতোষণ নীতি থেকে সরে আসছে। সেই ফ্রান্সের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোর প্রধান স্বার্থ হল ব্যবসা-বাণিজ্য। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের দ্বীপগুলোতে তাদের সামরিক ঘাঁটি করতে চায়। এ নিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের আগ্রহ। আর এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা চাপ দিয়ে একটি কঠোর অবস্থান নিতে চাইছেন। এই ইস্যুগুলো এখন রাজনৈতিক ও কূটনীতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। একদিকে যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়ে ইতিবাচক কথাবার্তা বলছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রশাসনের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের বক্তব্যে বরং শোনা যাচ্ছে নরম সুর।

গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসন ও মানবাধিকার নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছিলো, তা যে বাংলাদেশ সরকারকে এক ধরনের চাপে ফেলার কৌশল ছিল, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম থেকে সরকার এসব বক্তব্যকে কথাগুলোকে মাথা গরম না করে সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ততই ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী লীগ সরকার আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নেমেছে। বিশেষ করে গত দুইমাস আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিনিদের মোড়লগিরি দেখিয়ে স্যাংশন দেয়াসহ বিভিন্ন নীতির কঠোর সমালোচনা করে যাচ্ছেন। এবার তো বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সরাসরি তিনি বলেই দিয়েছেন, মার্কিনিরা চাইছে তাঁকে উৎখাত করতে। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মার্কিনিদের হস্তক্ষেপের কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন শেখ হাসিনা।

[যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কঠোর অবস্থানে শেখ হাসিনা]

এর আগে জাতীয় সংসদ অধিবেশনেও তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সরকারকে উলট-পালট করে দিতে পারে কিন্তু আমি এসবে ভয় পাই না। দেশে ফিরে আহ্বান করা সংবাদ সম্মেলনেও তিনি সুস্পষ্টভাবে তাঁর সাহস ও অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এতে একটি বিষয়ে প্রমাণিত, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু হবেন না। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। একারণেই যুক্তরাষ্ট্রের অযৌক্তিক বক্তব্যগুলোর সমালোচনা করছেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন এবং সরাসরি বলতেন, তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেষ হাসিনাও তদ্রুপ কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের, দেশের ও জাতির মাথা উঁচুতে রাখার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছেন।

আরও পড়ুনঃ