
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পালা বদল মূলত আওয়ামী লীগ এবং এন্টি-আওয়ামী লীগ কেন্দ্রিক। এসময় যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে, তা এই দুটো পক্ষে বিভক্ত। সেই হিসেবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাও এই দুই বলয়ের অংশ। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির মেয়াদকাল শেষে সাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছেন মো. আবদুল হামিদ। তার বিদায়ের পর নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতাদের অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং স্বভাবজাত বাগাড়ম্বর দেখা গেছে। নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে বিএনপির কোনো প্রত্যাশা নেই, প্রধানমন্ত্রীর এককভাবে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ থেকে বোঝা যায়, সরকারের ইচ্ছা- যেভাবে হোক, রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখতে চায়… এমন নানারকম উদ্ভট কথা বলেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল।
ফখরুল আরেকটি হাস্যকর মন্তব্য করেছেন; বলেছেন- ‘আমরা কিছুটা হতাশ যে, যাঁকে চিনি না, যাঁকে জাতি জানে না- এ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলতেও পারব না। এ ধরনের একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়ে আসা – এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। অতীতে যাঁদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, অভিজ্ঞ অথবা বিচক্ষণতাসম্পন্ন প্রধান বিচারপতি, গ্রহণযোগ্য অধ্যাপক, উপাচার্য- এমন বরেণ্য ব্যক্তিরা; যাঁদের গোটা দেশের মানুষ শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন। পত্রপত্রিকায় তাঁর যে ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেছি, এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে বা দলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন রাখিনি। রাষ্ট্রপতি নিয়ে আমাদের আগ্রহ কম।’
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান ব্যক্তির মন্তব্য দেখলে দলটি কত নিম্নস্তরে অবস্থান করছে, সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের শাস্তির দাবিতে ও প্রতিবাদের কারণে জিয়ার নির্দেশে কারাবরণ করা একজন রাজনৈতিক নেতা এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা একজন ব্যক্তি মো. সাহাবুদ্দিনকে চেনেন না বলে অবজ্ঞা করেছেন ফখরুল। শুধু তা-ই নয়, পত্রিকায় তার রাজনৈতিক ইতিহাস পড়ার পরেও তাকে অরাজনৈতিক বলে দাবিও করেছেন ফখরুল। কারণ কী? মো. সাহাবুদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলেই কি ৭১০নং রাজাকারপুত্র ফখরুলের এমন গাত্রদাহ?
আবদুর রহমান বিশ্বাস : তালিকাভুক্ত কুখ্যাত রাজাকার যখন রাষ্ট্রপতি
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা পুনরায় চালু হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির পদ অনেকটাই অলংকারিক হয়ে পড়ে। জিয়া যেমন স্বাধীনতাবিরোধী কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, তেমনি তার স্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি করেন একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে। যা ছিল রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদাকে অপমানিত করার দৃষ্টান্ত। তার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা হঠাৎ গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল না। আবদুর রহমান ১৯৭৯-৮০ সময়ে জিয়ার মন্ত্রিসভায় পাটমন্ত্রী ছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮১-৮২ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি সাত্তারের মন্ত্রিসভায় ধর্মমন্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি জিয়ার পাকিস্থানি ভাবাদর্শ বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। তারই পুরস্কার হিসেবে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে তাকে রাষ্ট্রপতি করেন।
আবদুর রহমান বিশ্বাস প্রকাশ্যেই পাকিস্থানের পক্ষে ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। একাত্তরের খুনি-ধর্ষক-রাজাকারদের বাংলার মাটিতে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেন জিয়ার স্ত্রী খালেদা। স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজাকারদের পদায়ন অব্যাহত রাখেন তিনি। আবদুর রহমান বিশ্বাস ছিলেন বরিশাল জেলা কমিটি মুসলীম লীগের সহ-সভাপতি। জুলাই মাসে তিনি শান্তি কমিটির সভায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন। এই সংবাদটি সেসময় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও ট্রেজারার নিয়োগ দান করেন। রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে যখন রাষ্ট্রপতি করা হয়, তখন দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়।
কুখ্যাত রাজাকার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ পদে বসবেন, এটা মেনে নিতে পারেননি শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগণ। সেসময় সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তীব্র প্রতিবাদ, মিছিল, সমাবেশ হয়। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির ব্যতীত ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো ক্লাস বর্জন করাসহ নানা কর্মসূচি দেয়। বিএনপি সরকার পুলিশ ও ছাত্রদল-শিবিরের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছিল এসব কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে। ছাত্র সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস অনেকটাই নীরবে আজ্ঞাবহ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। গণমাধ্যমে তার খবর তেমন আসত না।
বদরুদ্দোজা চৌধুরী যখন রাষ্ট্রপতি:
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। জিয়ার শাসনামলে তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অর্থাৎ, জিয়ার প্রধানমন্ত্রী কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজের ডেপুটি ছিলেন বদরুদ্দোজা। মাত্র ৭ মাস ৭ দিন ছিল তার ক্ষমতা। এরমধ্যে নিজ দল থেকেই পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ২০০২ সালের ২০শে জুন দেশের সব পত্রিকায় লিড নিউজ- রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর আস্থা নেই তার দল বিএনপির সাংসদদের।
ঘটনা হলো, আগেরদিন বিএনপির এমপিদের বৈঠক শুরু হয় খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে, তাতে অনেক এমপি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগের দাবী তোলেন। অন্যথায় তাকে ইমপিচ (গলাধাক্কা) করার হুমকিও দেন তারা। তৎকালীন স্থানীয় সরকার উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এই আলোচনার সূত্রপাত করেন তারেক জিয়ার নির্দেশে। তৎকালীন চিফ হুইপ খন্দকার দেলোয়ারের স্বাক্ষরিত চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, “১৯ এবং ২০শে জুন দলের সভায় বিস্তারিত আলোচনার পরে এই মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বিএনপি সংসদীয় দল মাননীয় প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর আস্থা হারিয়েছে বিধায় তাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহবান জানানো হচ্ছে।”
মাত্র ৭ মাস ৭ দিনের রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজাকে কেন বিদায় নিতে হয়েছিল, তার নানাবিধ কারণ উল্লেখ করে তখন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যেসব কারণের কথা ওইসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে :
* জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন না করা।
* রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
* বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সিগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ।
* রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ব্যবহার না করা, কারণ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’র বিপরীতে ‘পাকিস্থান জিন্দাবাদ’ এর আদলে ভিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠিত করতে বিএনপি শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফতাব আহমদকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর না করা। আফতাব আহমদের নাম খালেদা জিয়ার দপ্তর অনুমোদন করেছিল। রাষ্ট্রপতি সেই ফাইলে স্বাক্ষর না করায় পরবর্তীতে আফতাব আহমদকে বাদ দিয়ে অধ্যাপক জিন্নাতুন্নেসা তাহমিদা বেগমকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
* রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনে’ রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেশি সময় পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তোলেন বিএনপির কিছু নেতা। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কাভারেজ টাইম কমিয়ে দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিটিভিকে বলা হয়েছিল- এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।
* তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য এক মাস যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে দেশে ফিরে আসার পর তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি কোন খোঁজ-খবর নেননি।
* দলের মনোনীত হয়েও রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়া।
* রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যয় বাড়ানো।
* সেনাবাহিনীসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেন রাষ্ট্রপতি।
* রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরে অধিক সংখ্যক জাতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া। যার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রীদেরকে কোলে বসিয়ে ফটোসেশন করার মত রসালো ঘটনাও রয়েছে।
* বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে সরকারের একটি মহল থেকে আপত্তি এলে তা পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তোলে।
২০০৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, “আমি রাষ্ট্রপতি হবার পরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে আবেদন জানালো আমি যেন চ্যান্সেলর হিসেবে সেখানে ডিগ্রিগুলো দিতে যাই। আমি সেগুলো করেছি কিছুদিন পরে, একজন মন্ত্রী আমার কাছে এলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে বললেন যে আমি যেন এত বেশি এক্সপোজড না হই অর্থাৎ এ ধরনের অনুষ্ঠান যেন আমি না করি।”
বদরুদ্দোজাকে বরখাস্ত করার পেছনে জিয়ার মাজারে না যাওয়ার চেয়ে বড় কারণ তখন আলোচিত ছিল পুত্র মাহীর সঙ্গে তারেক রহমানের লুটপাটের টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব। নিজ যোগ্যতায় মাহী খুব দ্রুত মিডিয়া ও শোবিজ জগতের দখল নিয়েছিলেন, সাথে ছিলেন তার সুন্দরী স্ত্রী আশফাহ হক লোপা। যার ওপর তারেকের কুনজর ছিল অনেকদিন ধরে। গণমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম ও বিনোদন জগতের একচেটিয়া ব্যবসা মাহীর কব্জায় চলে আসে। বিষয়টি তারেক রহমানের গোচরে আনেন দলের তরুণ নেতারা।
একদিকে লোপা, আরেকদিকে মাহীর মিডিয়া কাভারেজ- সবমিলে তারেকের মাথায় আগুন ধরে যায়। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন তিনি। মাহীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার মওকা খোঁজেন। সে মওকা পেয়েও যান। জিয়ার মাজারে না যাওয়া ইস্যু কেন্দ্র করে তারেক রহমানের ইঙ্গিতে দলের তরুণ এমপিরা বিদ্রোহ করেন। নেতৃত্ব দেন দুলু। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরেক দিকে রাষ্ট্রপতির পুত্র। অনেকে মনে করেন, এই দ্বন্দ্বেই বদরুদ্দোজাকে হারাতে হয়েছিল রাষ্ট্রপতির পদ। মাহী ও তার স্ত্রী লোপা একসঙ্গে মিলে তখন বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করতেন। তাদের স্বামী-স্ত্রীকে ঐ অনুষ্ঠান আর করতে দেওয়া হয়নি, বের করে দেওয়া হয় বিটিভি থেকে। বন্ধ হয়ে যায় সেই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি।
রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিএনপিকে ত্যাগ করে বদরুদ্দোজা ও পুত্র মাহী এবং বিএনপির সংস্কারপন্থী কয়েকজনকে নিয়ে ২০০৪ সালে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলে বিএনপি বুঝতে পারে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য বদরুদ্দোজার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই বিএনপি ছাড়তে পারেন। রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে বদরুদ্দোজা ‘বিকল্পধারা’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন এবং সেটাই তার জন্য কাল হয়েছিল। দল গঠনের আগেই তাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার। বাড়িতে হামলা, হাসপাতালে হামলা, দেশের কোথাও সমবেত হতে পুলিশের অনুমোদন না দেয়া, মান্নান ভুঁইয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর চলতে থাকে।
আরও পড়ুন : দেশে কামাল-বি চৌধুরী, বিদেশে লবিংয়ে ইউনুস নেপথ্যে আইএসআই ও জামাতী ফান্ড
বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ অপপ্রয়োগ করল বদরুদ্দোজাকে ঠেকাতে। পুলিশ ছাড়াও ছাত্রদল ও যুবদলের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয়া হয় তার ওপর। মিছিলে বিএনপি কর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালায়। ঢাকায় বদরুদ্দোজার বাসভবনে আগুন দেয়া হয়। পুলিশ দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর গাড়িবহর আটকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। সহিংসতায় আহত হন অনেকেই। বিএনপির কর্মীরা মহাখালী রেললাইনের পাশে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর হামলা চালালে পিতা-পুত্র প্রাণ বাঁচাতে রেললাইন ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এত লাঞ্ছনার পরেও পরবর্তীতে সেই বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপিকে পাশে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এমনই চরিত্র তার! এটাই সার্কাস।
রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বা ইয়েসউদ্দিন : হীরক রাজার দেশ
বদরুদ্দোজার পদত্যাগের পর তৎকালীন স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আসেন এক হীরক রাজা। ২০০৬ সালের ২৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন অদ্ভুত এক লোক। তাকে বলা যায় এ যুগের হীরক রাজা, তিনি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। বদরুদ্দোজার পর বিএনপি-জামায়াত জোট এমন এক মোসাহেব খুঁজছিল, যে খালেদা ও তারেকের কথায় উঠবে-বসবে। তেমনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। তেলবাজি, হাত কচলানো, জি হুজুরি ও মোসাহেবির কারণে যাকে অনেকেই ‘ইয়েসউদ্দিন’ বলে ডাকতেন।
ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শুধুমাত্র খালেদা-তারেকের মনোরঞ্জনই করেননি, তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে চিরতরে কলুষিত করে। খালেদা সরকার সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ করে শুধুমাত্র বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও জাসাস নেতা বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার নীলনকশা প্রণয়ন করতে। এর প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।
২৮শে অক্টোবর ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার শেষ দিন। ওইদিন খালেদা জিয়ার বিদায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু সারাদেশে গণবিস্ফোরণের মুখে বিচারপতি কেএম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এসময় সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হলে মাহমুদুল আমিন চৌধুরী অথবা পরবর্তী প্রধান বিচারপতিকে এই পদের জন্য প্রস্তাব দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সমস্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা করেন, তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান।
ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেকগুলো কৌতুক আর গল্প চালু হয়। সবচেয়ে মজার ঘটনাটি তার উপদেষ্টাদের কাছ থেকে প্রচারিত। তা হলো, উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠক ডেকে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। এমনকি প্রফেশনাল ডেকোরাম উপেক্ষা করে লুঙ্গি পরেও তিনি উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠকে হাজির হতেন। যখন উপদেষ্টা কমিটির উপদেষ্টারা তাকে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলছিলেন তখন তিনি জানিয়েছিলেন যে, আমি একটু ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে নিই।
এই ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপতি- উভয় পদ দখল করেছিলেন। কিন্তু এই পদ দুটি মূলত চালাতেন তার তৎকালীন প্রেস সচিব মোখলেসুর রহমান চৌধুরী। মোখলেস ছিলেন অঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান এবং তিনি যা বলতেন ইয়াজউদ্দিন তা-ই করতেন। মোখলেসের কাছে নির্দেশ আসত হাওয়া ভবন থেকে। এক উপদেষ্টা বলেছেন, সেসময় আমরা যদি কোনো সিদ্ধান্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তিনি উঠে ভেতরে যেতেন এবং ফোন করতেন খালেদা জিয়া বা তারেককে। কথা বলে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতেন। এ রকম অবস্থায় বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন গোঁ ধরে থাকেন, তিনি যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করবেনই।
[রাষ্ট্রপতি পদটিই বিএনপির কাছে অর্থহীন কেন?]
২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন সাধারণ নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে সংকট ঘনীভূত হয়। এই প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি ইয়াজউদ্দিনকে সমর্থন করে সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অনির্বাচিত সরকারের অধীনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে। এজন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতার লালসা। বিএনপির বেসামাল উন্মত্ত আচরণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোকে শুধু অকার্যকর করেনি, এর কফিনেও শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে।
নীলনকশা অনুসারে বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীরা অনেকেই একাধিক স্থানের ভোটার হন। ভুয়া নাম-পরিচয় দিয়ে ১ কোটি ২৩ লাখ ভোটারের তালিকা তৈরি করা হয়। বহু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি বানানো হয় এই সুযোগে। বেছে বেছে আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাদ দেয়া হয় তালিকা থেকে। ভুয়া ভোটারদের ভোটগুলো দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা কাস্ট করে অবৈধভাবে বিএনপিকে ক্ষমতায় নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। এজন্য রাষ্ট্রপতি পদে থাকা ইয়াজউদ্দিনকে সংবিধান উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টার পদে বসায় তারা।
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুমোদিত তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার জন্য দলীয় সমর্থনপুষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ইয়াজউদ্দিন এরপর নির্বাচন কমিশনারকে পাশ কাটিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করে সচিবদের রদবদল ও রিটার্নিং কর্মকতাদের বদল করেন। সংবিধান অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন ছাড়া এমন হস্তক্ষেপের অধিকার আর কারো এখতিয়ারে থাকে না। এরপর তারেক রহমানের নির্দেশে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ সমর্থকদের গণগ্রেপ্তার ও আতঙ্কময় পরিবেশ সৃষ্টি করে পুলিশ। গ্রেপ্তার এড়াতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াবেন এবং নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়াবেন।
ফলে দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের তালিকা অনুসারে জাল ভোটের চক্রান্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন হবে, এমনই ছিল পরিকল্পনা। তবে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল অবস্থানের কারণে ভুয়া ভোটারের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সাজানো ও সহিংস নির্বাচনের বিরোধিতা করে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ১১ই জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন ইয়াজউদ্দিন। এরপর ছবিসহ ভোটার তালিকা ও স্বচ্ছ ব্যালটবাক্সে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের দাবিতে সোচ্চার হয় আওয়ামী লীগসহ অপর দলগুলো। জনগণের চাপ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়ায় ভুয়া ভোটারের বিষয়টি স্বীকার করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হন ইয়াজউদ্দিন। বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা দিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন : খুনি স্বৈরাচার জিয়ার দল বিএনপির নির্লজ্জ নেতৃবৃন্দ || ইতিহাস
মোসাহেবদেরও দিন ফুরায়। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদের মুখে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইয়াজউদ্দিনের একক কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। আসে আরেক ষড়যন্ত্রী চক্র। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্য। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। মাইনাস ফর্মুলার নামে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়। ১৬ই জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। মিথ্যা মামলায় ২০০৭ সালে শেখ হাসিনাকে জেলে ঢোকানোর পর একের পর এক মোট ১৩টি মামলা সাজানো হয় তাঁর নামে। ২৪শে জুলাই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।
জেলে বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিন স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়। তাঁর চিকিৎসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। গ্রেনেড হামলায় আহত কান ও চোখ চিকিৎসার অভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁকে স্লো-পয়জনিং করা হয়। একপর্যায়ে তাঁর অসুস্থতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেলে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা টানা ২০ দিন চিকিৎসার পর তাঁকে আপাত স্বাভাবিক করে তোলেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এসময় ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে গদিতে আসীন ছিলেন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। তার রাজত্বকালে বাংলাদেশ হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়েছিল। তিনি যা বলতেন এবং করতেন তা সবার কাছে ছিল হাস্যকর কৌতুক। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এমন ভাঁড়ামো দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছিল। বিএনপি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও ক্ষমতা ধরে রাখতে এমন ভাঁড়কে রাষ্ট্রপতি করেছিল। যদিও সেই ইয়াজউদ্দিনই বিশ্বাসঘাতকতা করেন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে। ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সময় নিজের গদি অক্ষত রাখতে এই হীরক রাজা কোনো প্রতিবাদ করেননি। বরং বঙ্গভবনের আরামদায়ক জীবন-যাপনের স্বার্থে তিনি সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতে এমন ভাঁড়ের চরিত্রের দেখা মিলেছে বিএনপির কল্যাণে।
আরও পড়ুন :
- ইতিহাসঃ জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ বলে সাব্যস্ত করেছিলেন মির্জা ফখরুল
- বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করলো কারা?
- জিয়াউর রহমানের শাসনামল: কেমন ছিলো বাংলাদেশ