
নিজেদের স্বার্থ হাসিল এবং আধিপাত্য জাহির করার জন্য আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচিত সরকারকে অসাংবিধানিক উপায়ে সরিয়ে নিজেদের তাঁবেদার সরকার গঠনের প্রচেষ্টা সবসময়ই করে থাকে। সেই ধারাবাহিকতাতেই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করছে একাধিক মার্কিন সংস্থা। আর ঐতিহাসিকভাবেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী আমেরিকা সবসময়ই এই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের পক্ষ নিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল আমেরিকা। পরবর্তীতে পাকিস্তানপন্থী উগ্রবাদী জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে তারা। একারণে এখনো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতার জন্য দেশের ভেতরে সুশীল সমাজের ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী অপপ্রচার ছড়িয়ে যাচ্ছে মার্কিন সংস্থা।
আরও পড়ুন : ঢাকার আমেরিকান এমব্যাসি কি ডানপন্থী জঙ্গিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলো?
তৎকালীন পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিনিরা যেসব বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল, তাতে করে পূর্ব বাংলার মানুষরা আরো শোষিত হচ্ছিলো, আর ফুলে ফেঁপে উঠছিল পশ্চিম পাকিস্তান, কারণ আমেরিকার সব বিনিয়োগই ছিল পশ্চিম পাকিন্তানে। তাই আমেরিকার ভয় ছিল যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের অনেক চুক্তিই বাতিল করে দিতে পারে। এজন্য তারা ১৯৭১ এর পূর্বে আমেরিকা চরমভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, পাকিস্তানিরা গণহারে বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণসব সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রাখলেও, আমেরিকা কোনো প্রতিবাদ না করে বরং পাকিস্তানি জান্তাদেরই সমর্থন দিতে থাকে।
এমনকি ১৯৭১ সালের শেষ দিকে বাঙালির বিজয় যখন নিশ্চিত, তখন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর উধ্যোগ নেয় আমেরিকা। আপনারা জেনে থাকবেন, আমেরিকার সেভেন্থ ফ্লিট বা সপ্তম নৌ-বহরের কাজ কী। এটি মূলত যুদ্ধবিমান বহনকারী, এটির ওপর একসঙ্গ কয়েকটি বিমান ল্যান্ড করতে পারে এবং এখান থেকেই একগুচ্ছ বিমান উড্ডয়ন করে নির্দিষ্ট দূরত্বে হামলা চালাতে পারে। ফলে এই সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে বাংলাদেশের ওপর ব্যাপক বোমা বর্ষণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল আমেরিকা, বাংলাদেশের নিশ্চিত স্বাধীনতা বোমায় গুড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীতে বিজয়ী করার সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছিল তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সেই অপচেষ্টাও ব্যর্থ হয় এবং বিশ্বের বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
একে তো যুদ্ধে পরাজয়, তারওপর আবার আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের কাছে পাত্তা না পাওয়া-সব মিলিয়ে আরো বেশি বাংলাদেশবিরোধিতায় লিপ্ত হয় আমেরিকা। তাদের এই বাংলাদেশ বিরোধিতার মূল জায়গাটা ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়। আর এই দ্বন্দ্বের অন্যতম রূপকার ছিল মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া কানের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের জন্য তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে রাজি করান। এমনকি যুদ্ধের শেষ দিকে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্যও নিক্সনকে রাজি করিয়েছিল সে। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এবং সেই দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘৃণা করতে থাকে এই মার্কিন কূটনীতিক।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া শুরু করলে, আওয়ামী লীগ প্রধান ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতিও বিদ্বেষমূলক আচরণ অব্যাহত রাখে আমেরিকা। কারণ ততদিনে আমেরিকার প্রভাববলয়ে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে হিলারী ক্লিনটন, যার প্রিয় ব্যক্তিত্ব আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং আওয়ামী লীগের প্রতি ঘৃণাপোষণকারী হেনরি কিসিঞ্জার। বিভিন্ন বক্তব্যে কিসিঞ্জারের নীতি অনুসরণের কথা সবসময় উল্লেখ করেন হিলারী। একারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তার কৌশলি এবং কঠোর অবস্থান উত্তরাধিকার সূত্রেই চলমান থাকে।
এই বাংলাদেশ বিরোধী এবং আওয়ামী লীগের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে ঘৃণাপোষণকারী হিলারী ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবার বাংলাদেশের ড. মোহাম্মদ ইউনুস। হিলারীর গুরু কিসিঞ্জার যেমন হিয়াহিয়া খানের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর নারকীয় নির্যাতন চালাতে পাকিস্তানিদের সমর্থন দিয়েছেন, তেমনি হিলারীও তার বন্ধু ইউনুসকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে এবং করছে। একারণে ড. ইউনুসকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক টলায়মান অবস্থায় নোবেল পুরস্কার দেয় তারা।
ক্ষুদ্র ঋণের প্রচলন ঘটিয়ে অর্থনীতিতে ইউনুসের ভূমিকা থাকতে পারে, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারেন। তবে এতে গরিব আরো গরিব হয়। ফলে শান্তিতে ড. ইউনুসের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু শান্তির নোবেল তো সবসময় বিশ্বরাজনীতির অংশ হিসেবেই দেওয়া হয়। আমেরিকা ঠিক সেভাবেই ড. ইউনুসকে নোবেল দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল। এসময় আমেরিকা এবং ইউনুসের হয়ে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে দেশের শীর্ষ দুই গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। কিন্তু আপামর জনগণ তাদের সেই নোংরা ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয় এবং শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রেখে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে।
ফলে আবারো বড় ধাক্কা খায় আমেরিকা। ফলে এই পরাজয়ের পর বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষোভ আরো বৃদ্দি পায় কিসিঞ্জারের ব্রেন চাইল্ড হিলারী ক্লিনটনের। আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. ইউনুসও দেশের সুশীল সমাজের মুখোশ পরিহিত কয়েকটি গণমাধ্যমের সম্পাদককে নিয়ে নিয়মিত আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী জনমত গঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এখন আপনারাই বলুন, আমেরিকা কী কখনো বাংলাদেশের ভালো চেয়েছিল? নাকি যখনই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তখনই তারা কখনো নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, কখনো জিএসপি বাতিল করে, কখনো বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর সেই পালে নিয়মিত হাওয়া দিয়েছে ড. ইউনুস এবং মার্কিন সংস্থার দালাল হিসেবে পরিচিত দুই পত্রিকার সম্পাদক।
আরও পড়ুন : বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিনষ্টের নয়া মিশন বিএনপির!
কিন্তু এই চক্রের কোনো অপচেষ্টা বাঙালি সফল হতে দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না। বারবার তারা যেভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে আমাদের, আর আমরাও যেভাবে বারবার আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের রক্ষা করেছি, তেমনি ভবিষ্যতেও এই চক্রের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকতে হবে। তারা এতোটাই জঘন্য যে, করোনার মতো মহামারিকেও সুযোগ হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি করেছিল। আপনারা বলতে পারেন যে, তারা কিছু ভ্যাক্সিন দিয়েছে। এটি সত্য। তবে এটি আমেরিকা কিন্তু শুরুতেও দেয়নি আবার ফ্রিও দেয়নি। জাতিসংঘের কিছু নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে তারা তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে কিছু ভ্যাক্সিন দিতে বাধ্য হয়েছে এবং অবশ্যই তা অনেক বেশি দামে। করোনার মহামারিকে কাজে লাগিয়েও বাঙালিদের পকেট কেটেছে এই ড. ইউনুসের আমেরিকান বন্ধুরা।
[আমেরিকার বাংলাদেশবিরোধিতার ঐতিহাসিকতা : কিসিঞ্জার-ইয়াহিয়ার মুজিব বিদ্বেষ থেকে হিলারী-ইউনুস চক্রের আওয়ামী সরকার বিরোধিতা]
তাই- বাতাসে কান রাখুন। যখনই কিছু পত্রিকা বা সামাজিক মাধ্যমে কিছূ বিতর্কিত মানুষের বাড়াবাড়ি রকমের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চোখে পড়বে, তখনই আমেরিকান হাওয়ার আভাস পাবেন; সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হোন, এদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে তা প্রতিরোধে সক্রিয় হোন। সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রতিটি নাগরিককেই সচেতন হতে হবে।
আরও পড়ুন :
- রাজনৈতিক সংগঠনের মতো তৎপর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস
- যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত করেছিল তাদের মিত্র ইউনূসের জন্যই!
- অনুসন্ধানঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আমেরিকার ভূমিকা! যে ইতিহাস সবসময় আড়ালে থেকে যায়।