
দীর্ঘদিন ধরেই প্রথম আলো ট্রাস্টের নামে আর্থিক অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের অভিযোগের পাহাড় জমেছে। কোত্থেকে কীভাবে আসছে অর্থ, কীভাবে কতটা ব্যয় হচ্ছে, তার কোনো হদিস নেই। যার ফলে মানি লন্ডারিং হচ্ছে বলেও বিশেষজ্ঞদের মত। প্রথম আলোর ওয়েবসাইট থেকে ট্রাস্টের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা যায়। তারা যেসব বিষয়ে কাজ করছেন, তা হলো- অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল গঠন, মাদকবিরোধী আন্দোলন জোরদার করা, অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি, ত্রাণ তহবিল, অদম্য মেধাবী তহবিল, আলোর পাঠশালা, সাভার রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সহায়ক তহবিল ও সাদত স্মৃতি পল্লী।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম খুঁজে বিগত এক দশকে অ্যাসিড ভিক্টিমের তেমন কোনো সংবাদ চোখে পড়ে না। যদিও কেউ অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন, তারা সরকারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা পাচ্ছেন। মাদকাসক্ত মাহমুদুর রহমান শাসার পিতা মতিউর রহমান নিজেরর সন্তানেরই মাদকাসক্তি দূর করতে পারেননি। প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন কবে কোথায় করেছে, তা তারা নিজেরাও জানেন না। কার মাদকাসক্তি দূর করেছে তারা? উল্টো তাদের ওটিটি প্ল্যাটফরম চরকিতে মদ ও মাদককে উৎসাহিত করা কনটেন্ট নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি বা মেধা তহবিলের কোনো উদ্যোগের খবরও অজানা। সরকারি বিদ্যালয়ে শিশুরা প্রায় বিনামূল্যে পড়ছে, ইউনিফর্ম, শিক্ষা উপকরণ, বই ইত্যাদি বিনামূল্যে পাচ্ছে, পাচ্ছে শিক্ষাবৃত্তিও। তাহলে প্রথম আলো কাদের পেছনে এসব তহবিল খরচ করে? উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পেছনে? সাভারের রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, ভিক্টিমরা নিজেরাই দাবি করেন তাদের কথা কেউ ভাবে না। অথচ প্রথম আলো এই ক্ষতিগ্রস্তদের নামে কোটি কোটি টাকা সাহায্য তুলেছে, সেসবের কোনো হদিস নাই। গত ১০ বছর ধরে এখনো তারা এই প্রকল্প চালু রেখেছে মূলত কাদের স্বার্থ? প্রথম আলো ট্রাস্ট আসলে ট্রাস্টেড (বিশ্বস্ত) কোনো কার্যক্রম নয়।
[প্রথম আলো ট্রাস্ট দুর্নীতিঃ দুস্থদের নামে সংগৃহীত অর্থের নেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা]
বেশ কয়েক বছর আগে বাংলানিউজ পত্রিকা প্রথম আলো ট্রাস্টের দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিল। যার প্রেক্ষিতে উঠে আসে অনেক অনিয়মের খবর। আসুন, দেখা যাক-
নীলফামারীর মাদ্রাসা শিক্ষক রঞ্জিত কুমার রায়। তার জীবন সংগ্রামের কথা পড়ে প্রথম আলো ট্রাস্টে সহায়তা দিতে দেশ-বিদেশ থেকে এগিয়ে আসেন মানবহিতৈষী ব্যক্তিরা। তার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্টের তহবিলে জমা পড়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা। এখনো সেই তহবিলে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু রঞ্জিতের মাদ্রাসা ও ঘর তৈরির কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এতে ব্যয় হয় ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা। তার নামে জমা পড়া বাকি টাকার কথা রঞ্জিত নিজেও জানেন না। অর্থাৎ বাকি প্রায় ৪ লাখ টাকা রঞ্জিতের নামে প্রথম আলো ট্রাস্টে জমা হলেও তার কোনো সুফল তিনি পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নীলফামারীর সেই শিক্ষক রঞ্জিত বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রথম আলো কতো টাকা সংগ্রহ করেছে, আমি তা জানি না। তহবিলে টাকা-পয়সা জমা আছে কি না তাও আমাকে প্রথম আলো জানায়নি। ২০১১ সালের জুলাইয়ের পর আমার সঙ্গে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের আর যোগাযোগ হয়নি। তারা আমাকে দুটি ঘর করে দিয়ে দিয়েছে। তাই আমি জানতে চাইনি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম আলো ট্রাস্ট এভাবে প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশ থেকে আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করে থাকে বিভিন্ন জনকল্যাণের কথা বলে। কিন্তু তার সঠিক ব্যবহার না হওয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যাপকভাবে। প্রমাণও মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে তহবিল তসরূপেরও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যেমনটি করা হয়েছে ওই শিক্ষক রঞ্জিতের নামে জমা হওয়া অর্থের বেলায়।
বিধান অনুযায়ী, ট্রাস্টের আর্থিক প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করার কথা থাকলেও প্রথম আলো তা করে না। ফলে যে বা যারা এই তহবিলে অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন, তারা কিছুই জানতে পারছেন না। ফলে অভিযোগ রয়েছে, প্রথম আলো ট্রাস্ট তহবিলের ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতার। নেই কোনো জবাবদিহিতাও। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রচারণা জোরালো থাকে। কিন্তু সংগৃহীত অর্থ কোন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে তা স্পষ্ট করে দাতাদের জানানো হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে দু’একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করে তার ব্যাপক প্রচারণা চালায় প্রতিষ্ঠানটি। এর পেছনে মূল কারণ, যেন একই খাতে পরে আরো অর্থ জমা হয় তহবিলে এবং তা খরচ না করে আত্মসাৎ করা যায়। রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গড়া তহবিল এর একটা উদাহরণ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথম আলো ট্রাস্টের অধীনস্ত এসিডদ্বগ্ধ নারীদের সাহায্যার্থে সহায়তা তহবিল, মাদকবিরোধী আন্দোলন, ত্রাণ তহবিল, অদম্য মেধাবী তহবিল এবং নির্যাতিত সাংবাদিক তহবিলসহ অন্যান্য কার্যক্রমে অর্থ সংগ্রহ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনারও অভিযোগ।
ট্রাস্টের একাধিক দাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা শুধু সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোন খাতে কীভাবে তার ব্যবহার করা হচ্ছে, তা প্রথম আলো তাদের জানায় না। ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোও সরল বিশ্বাসে জানতে চায় না। প্রথম আলোও বিষয়টি সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। দান করার পর তার খরচের খাত সম্পর্কে খোঁজ নেয়াটা দাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য অস্বস্তিকর, এর অবৈধ সুবিধাটা নিচ্ছে প্রথম আলো।
[প্রথম আলো ট্রাস্ট দুর্নীতিঃ দুস্থদের নামে সংগৃহীত অর্থের নেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা]
এসিডদগ্ধ নারীদের সহায়তা ফান্ড সম্পর্কে প্রথম আলো সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রথম আলো ১৩২ জন এসিডদগ্ধ নারীকে সহায়তা দিয়েছে। তাদেরকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে এককালীন অনুদান দেওয়া হয়েছে। যদিও এই অনুদানপ্রাপ্তদের কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। কিন্তু গত এক দশকে অ্যাসিড ভিক্টিম হিসেবে বড় কোনো অপরাধের ঘটনায় তেমন কারো নাম পাওয়া যায়নি পত্রিকা ঘেঁটেও। তাহলে এই তহবিলে জমাকৃত টাকা কোথায় যাচ্ছে, কী হচ্ছে তা দাতারা জানেন না, প্রকাশও করা হয় না। অথচ তহবিল গড়ে উঠেছে সাধারণের সহায়তায়। বরং কিছু সভা-সিম্পোজিয়ামের নামে এসব অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে বলে মত অনেকের।
এছাড়াও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরাও জানেন না, অনুদানের কত টাকা জমা হলো, কীভাবে খরচ হচ্ছে। কোন খাতে কত খরচ, কত জমা- এসবের কোনো হিসাবও চাওয়া হয় না, ফলে জবাবদিহিতাও নাই।
জানা গেছে, পদাধিকার বলে ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যবস্থাপক থাকেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। গঠনতন্ত্রে কৌশলে এটি করেছেন প্রথম আলো সম্পাদক নিজেই। তাই তার ইচ্ছার বাইরে যেতে চান না অন্য সদস্যরা। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ১১ জন। যার মধ্যে প্রথম আলোরই তিনজন। সম্পাদক মতিউর রহমান এবং দুই সহযোগী সম্পাদক- আনিসুল হক ও আব্দুল কাইয়ুম। বাকিরা বিভিন্ন নামিদামি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি। তবে ট্রাস্টের কাজকর্ম সামাল দেন- মাহবুবা সুলতানা (সমন্বয়ক), মো. নাজিম উদ্দিন (সহকারী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক), গোলাম রব্বানী (সহকারী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক) ও শোয়েব মোহাম্মদ রেজা (নির্বাহী)।
বিধি অনুসারে ট্রাস্টের কিছু পদ ৩ বছরের জন্য নির্ধারিত থাকলেও এমনভাবে এই পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়েছে যে, বছরের পর বছর পদে রয়েছেন তারা। বিশেষ করে মতিউর রহমানের পদের কোনো পরির্বতন নেই। তিনি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি এর ব্যবস্থাপক। যা ট্রাস্ট ব্যবস্থাপনা আইনের লঙ্ঘন। এভাবে একজন তহবিল ব্যবস্থাপক থাকার বিধান নেই কোনো ট্রাস্টেই।
অন্য তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়ম মিলেছে অনুসন্ধানে। মাদকবিরোধী আন্দোলন, ত্রাণ তহবিল, অদম্য মেধাবী ও নির্যাতিত সাংবাদিক সহায়তা তহবিলসহ সব তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং অর্থ ব্যবহারেরও নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বাংলানিউজ।
[প্রথম আলো ট্রাস্ট দুর্নীতিঃ দুস্থদের নামে সংগৃহীত অর্থের নেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা]
এখানে মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, মহানবীকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশের ঘটনায় কার্টুনিস্ট আরিফকে নিজেদের কর্মীদের নয় বলে সরাসরি দাবি করেছিলেন প্রথম আলো এবং প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগ। প্রথম আলো তার দায়-দায়িত্ব নেয়নি, তিনি জেল খেটে বেরোনোর পর প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়েন। তার পাওনা বেতন এবং অন্যান্য ভাতার কিছুই পাননি। এমনকি তিনি আবেদন করেছিলেন তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসায় সহায়তার জন্য, সেটিও করা হয়নি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। বিনা চিকিৎসায় তার মা মারা যান বলে আরিফ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। তাহলে নির্যাতিত সাংবাদিকের তহবিলের কাজটা কী? ওই তহবিলের টাকা কি তবে শিশুদের ব্যবহার করে ভুয়া নিউজ তৈরির জন্য ব্যয় হয়?
দাতাদের অর্থ নিয়ে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা ছাড়াই প্রথম আলো এসব করছে। সভা-সেমিনারের নামে অর্থ খরচ করে সেটাকেই সমাজসেবার ব্যয় হিসেবে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা ছাড়া এভাবে একটি ট্রাস্ট চলতে পারে না। ট্রাস্টের একজন সদস্য জানান, ‘ট্রাস্টটি পরিচালনা করে মূলত প্রথম আলো। আমরা এর সদস্য হলেও সিদ্ধান্ত নেয় প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ তথা মতিউর রহমান নিজেই। আর সদস্যরা তা অনুমোদন করে দেন। এর বেশি কাজ নেই সদস্যদের।’
এদিকে প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে প্রথম আলো ট্রাস্টের যে সাইট রয়েছে সেখানেও ট্রাস্টের সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রমের সচিত্র বিবরণী দেওয়া থাকলেও নেই এসব কার্যক্রমসহ ট্রাস্টের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব বিবরণী। অথচ আজকাল যে কোনো ট্রাস্ট বা এনজিও’র হিসাব বিবরণী তুলে ধরতে বলা হয়, এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে সবাই তা দেন। সাইটটিতে ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের তালিকা পদবীসহ তুলে ধরা হয়েছে নানা তথ্য। অথচ তাদের বা ট্রাস্টের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ফোন নম্বর বা মাধ্যম না দিয়ে প্রথম আলো্রই যাবতীয় যোগোযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বরগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে।
এমন ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের রহস্য উন্মোচন হওয়া জরুরি।
আরও পড়ুনঃ
- ইতিহাসঃ জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ বলে সাব্যস্ত করেছিলেন মির্জা ফখরুল
- সন্ত্রাসী তকমা ঢাকতে গিয়ে ধর্ষক তকমা পেলো বিএনপি
- আর্থ ফাউন্ডেশন দুর্নীতি: প্রথম আলোর প্রভাব খাটিয়ে মতি পুত্রের কেলেঙ্কারি ধামাচাপা