দেশে

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকের কথা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকমাস আগে দেশে রাজনৈতিক আবহ অনেকটা গরম। সেসময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং বর্তমান বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনীতির অন্যতম রূপকার প্রয়াত ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি সভায় বোমা ফাটালেন। তিনি সরাসরি কথা বলা মানুষ হিসেবে সাংবাদিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। গ্রামীণব্যাংকের শেয়ারের ডিভিডেন্ড প্রদান অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সামনেই বললেন, ড. ইউনূসের কারণই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোটামুক্ত জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত করেছে। উৎসুক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী তাঁর সেই বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন সেদিন।

তিনি বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এমডি হিসেবে গ্রামীণব্যাংকে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখনও বাংলাদেশকে কোটামুক্ত জিএসপি সুবিধা দেয়নি। তবে এরপরেও আমরা এগিয়ে গিয়েছি। গ্রামীণব্যাংকও এখন ভালো চলছে। এ নিয়ে কোনও সমস্যা নাই।’ সচিবালয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত।

গ্রামীণব্যাংক – ড. ইউনূস – হিলারি ক্লিনটন এবং বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ- সবই একসূত্রে গাঁথা। কেন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের আইন ও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইউনূসকে গ্রামীণব্যাংকের পদে বহাল রাখার জন্য এত ব্যতিব্যস্ত ছিল? আসুন উত্তরগুলো খোঁজা যাক।

আরও পড়ুনঃ সাফাই গাইতে গিয়ে উল্টো ইউনূসের বস্ত্রহরণ!

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে, দেশের সকল ব্যাংকের এমডি পদে যারা নিয়োগ পাবেন, তাদের বয়সসীমা যেন সর্বোচ্চ ৬০ বছর হয়। দেশের সকল ব্যাংকের জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য। দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণব্যাংকের এমডি পদটি বিধি-বহির্ভূতভাবে দখল করে রাখায় আদালত নির্দেশ দেন ড. ইউনূসকে পদ থেকে অপসারণ করতে। আর এমন নির্দেশ পেয়েই ক্ষেপে উঠলেন ইউনূস। এ নিয়ে ইউনূস সেন্টার এবং গ্রামীণ কর্তৃপক্ষ অনেক গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক তোড়জোর শুরু করে। তাদের ভাবখানা এমন যে, নোবেল লরিয়েট হওয়ায় ইউনূসের জন্য ৭ খুন মাফ।

তাদের দাবিতে যে কারো মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, গ্রামীণব্যাংক যেন স্পেসশিপে চড়ে ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আগত কোনো প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের নিয়মনীতি, আইন-কানুন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলবে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি দেশের সব ব্যাংক মানতে বাধ্য হলেও গ্রামীণব্যাংক যেন সেসব মানতে বাধ্য নয়। তারা জনগণের টাকা ইচ্ছেমত নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখবে কিন্তু পরিচালিত হবে নিজেদের বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী। বিষয়টা পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে না? একই কাজতো ডেসটিনি-ইভ্যালি-ইঅরেঞ্জের মত প্রতিষ্ঠানগুলোও করতো। গ্রামীণব্যাংককে ছাড় দিলে ডেসটিনি, ইভ্যালি, যুবকসহ এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন জালিয়াত বলা হবে? তাদের বিরুদ্ধে এত ব্যবস্থা কেন! সরকার আদালতের নির্দেশ মেনেই গ্রামীণব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, কারণ তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি।

ইউনূস গংদের দাবি মেনে নিলে প্রশ্ন আসবে, গ্রামীণব্যাংকের জন্য কেন আলাদা নিয়ম হবে? দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যেই দেশিয় প্রতিষ্ঠান চলবে। ওদের দাবি অনুসারে ব্যাংকের এমডি থাকতে ৬০ বছর বয়সসীমার নিয়মনীতি নাকি গ্রামীণের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, তাদের পরিচালকরা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ড. ইউনূসই বারবার এমডি থাকবেন। গ্রামীণ ব্যাংক চালানোর জন্য নাকি আর কোনো যোগ্য লোক নাই! এমন অদ্ভূত দাবির পক্ষে আইনি লড়াইতে নেমেও গো-হারা হারলেন ইউনূস। ড. কামাল হোসেনের মত জাঁদরেল আইনজীবীরাও তার পক্ষে ছিলেন। গ্রামীণব্যাংকের এমডির পদ থেকে ইউনূসকে অপসারণ করা হলে তিনি আদালত পর্যন্ত যান। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সুপ্রিমকোর্ট, সব আদালতেই তিনি হেরেছেন। সরকারি ব্যাংক সংক্রান্ত আইনেই আছে এমডির বয়স ৬০ বছরে বেশি হবে না। অথচ ইউনূসের বয়স তখন ৭০-এর বেশি! মামলায় হেরে ইউনূস দেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার প্রস্তুতি নিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনূসের বন্ধু ডেমোক্রেট নেতা হিলারি ক্লিনটন, চেরী ব্লেয়ারসহ অনেককে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করান। হিলারী ফোন করেছেন দেখলে অন্য কেউ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে যেত। কিন্তু শেখ হাসিনা ঠান্ডা মাথায় তাকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইন সম্পর্কে বোঝান। হিলারীর কাছে শেখ হাসিনা জানতে চেয়েছিলেন, মার্কিন প্রশাসনের কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের নাক গলানো কি মার্কিনিরা মেনে নেবে? যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যাংক কি বাংলাদেশের আইন মেনে চলতে বাধ্য? কিংবা সেদেশের একটা ব্যাংকের এমডি কে হবেন, সেটা কি বাংলাদেশের মাথাব্যথা? কোনো কথার জবাব দিতে না পেরে হিলারী রাগে গজগজ করতে করতে ফোন রেখে দেন।

ইউনূস সেন্টারের দাবি, গ্রামীণব্যাংকে নাকি আর যোগ্য লোক নেই! অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে এমডি পথে থাকা নিষ্কন্টক করতে গ্রামীণব্যাংকের বহু ডিএমডিকে হেনস্তা করে ব্যাংক থেকে বিদায় করা হয়েছে ইতিপূর্বে। যারা গ্রামীণব্যাংকের শুরু থেকে জড়িত ছিলেন, যাদের অক্লান্ত শ্রমে গ্রামীণব্যাংক প্রতিষ্ঠিত, ডিএমডি হবার পরপরই কোনো না কোনো অভিযোগ এনে হেনস্তা করে তাদের বিদায় করে দেওয়া হতো। কারণ নিয়মানুযায়ী তারাই ব্যাংকের পরবর্তী এমডি পদের দাবিদার ছিলেন। এই কাজটি করত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। যার পরিচালনা পর্ষদ নিজের ইচ্ছায় বানাতেন ইউনূস। পরিচালনা পর্ষদের লোকজন তার কথায় উঠত-বসত।

আরও পড়ুনঃ  “গোপন তথ্য ফাঁস” হিলারির তদবিরেই ইউনূস নোবেল পান

পত্র-পত্রিকার কল্যাণে সবাই জানেন, দেশের প্রতিটি দুর্যোগ বা ক্রাইসিস মোমেন্টে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সহায়তার হাত নিয়ে এগিয়ে আসে। বিভিন্ন সময় ব্যাংক মালিকরা শত শত কোটি টাকার চেক নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ডোনেশন আকারে জমা দেন। হতদরিদ্র মানুষের বিভিন্ন দুর্বিপাক, সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুর্ঘটনা কবলিতদের চিকিৎসার খরচ, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ভুক্তভোগীদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যে সহায়তা দেয়া হয়, তাতে প্রতিষ্ঠানগুলোরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি, দেশের কোনো দুর্যোগে ড. ইউনূস জনগণের পাশে ছিলেন কি না! অথচ সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’কে তিনি ২০১১ সালে ১ কোটি ৩র লাখ ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছেন। আর এই তথ্যটি ফাঁস হলে ইউনূস সেন্টার পুরোপুরি অস্বীকার করেছিল।

আগ্রহীদের জন্য সূত্রটি দেওয়া যাক- https://dailycaller.com/2016/04/17/exclusive-disgraced-clinton-donor-got-13m-in-state-dept-grants-under-hillary

২০১৬ সালের ১৭ই এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ডেইলি কলার’ ক্লিনটন ওয়েবসাইটের বরাতে জানিয়েছিল ড. ইউনূস কীভাবে সেখানে এই বিপুল অর্থ অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। সেই সংবাদের প্রতিবাদ কিন্তু সেসময় কিংবা পরবর্তী সময়ে ড. ইউনূস বা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের কেউই করেননি। কারণ এটা ছিল সেদেশে ওপেন সিক্রেট। এত বিপুল অঙ্কের অর্থ যদি দেশের হতদরিদ্র মানুষের দারিদ্র দূরীকরণে ব্যয় হতো, বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত দেশ হতো অনেক আগেই। এই হিলারি ক্লিনটনই সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যারা একাত্তরে পাকিস্থানের পক্ষে ছিল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। যারা পিএল ৪৮০ প্যাক্টের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ৭৪-এর মানবসৃষ্ট খাদ্যভাব ঘটানোর জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।

[যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত করেছিল তাদের মিত্র ইউনূসের জন্যই!]

যারা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে পুনরায় ধ্বংস করতে দুর্বৃত্তদের গোপনে অর্থায়ন করেছিল। যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। সেই হিলারি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য শেখ হাসিনাকে ফোন করে চাপ দিয়েছিল। যার প্রশাসন বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা প্রদান করতে চায় না নিজেদের স্বার্থে। সেই হিলারি তথা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী গোষ্ঠীর সাথে এতটাই গভীর সম্পর্ক ইউনূসের। শেখ হাসিনার কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় হিলারির বন্ধু ইউনূস ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ স্পৃহায় ঘুরছেন এখনও।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের তোয়াক্কা করেনি ড. ইউনূসের গ্রামীণব্যাংক। তাদের সুদের হার ছিল সবার চেয়ে অনেক বেশি- ২০ থেকে ২৭ শতাংশ। এই উচ্চ সুদ টানতে কত শত পরিবার যে নিঃস্ব হয়েছে, এর হিসাব নেই। পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যেত ছবি- সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষকের গরু-ছাগল টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের লোকজন, গৃহস্থালী সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে, দেনার দায় শোধ করতে ব্যর্থ কৃষক গলায় ফাঁস দিয়েছেন গাছের ডালে… এমন ভুরি ভুরি ঘটনার সাক্ষী বাংলার জনগণ।

প্রবাদ আছে, যেখানে মোরগ ডাকে না সেখানেও সকাল হয়। ড. ইউনূস ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক কিন্তু আজ এক দশক ধরে ভালোভাবেই চলছে। কোনো আওয়াজ আছে? কোনো হৈ চৈ আছে?

আরও পড়ুনঃ