
স্বাধীনতাবিরোধীরা নিজেদের পরিচয় আড়াল করতে বহু আগে থেকেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আশ্রয় নিয়েছেন নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আস্তিনের নিচে। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে তারা এই নোবেলজয়ীর উদাহরণ টানেন, বিশ্ব মোড়ল রাষ্ট্রগুলোতে ইউনূসের মিত্রদের নাম নিয়ে গর্বে সিনা টানটান করে ফেলেন। ইউনূস যেন বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিরাট অবদান রেখেছেন! কিন্তু একজন অর্থনীতিবিদ নিজের দক্ষতা এবং পেশাগত গন্ডির বাইরে গিয়ে শান্তিতে নোবেল জয় করলেন কীভাবে- এর উত্তর ইউনূসের মুরিদদের কাছে কখনো পাওয়া যায় না। কী এমন বিশ্বশান্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন যে, তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছে এর হিসাব মেলেনি অনেকদিন যাবৎ। যদিও ক্রমে সব কিছু পরিষ্কার হয়েছে। পাঠকদের কাছে সেই গোমর ফাঁস করা যাক।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। নরওয়েজিয়ান পালার্মেন্টই এই নোবেল কমিটির একমাত্র মনোনয়ন দেয়। আবার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল ফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের মূল মালিকও নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর, যা আবার নরওয়ে সরকারের মালিকানাধীন। বিশ্বের অনেক দেশে তাদের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা আর বিনিয়োগ রয়েছে। এখন আসা যাক গ্রামীণফোনের বিষয়ে। শান্তিতে নোবেলদাতা দেশ নরওয়ের সরকারি সংস্থা টেলিনর-এর সাথে ইউনূসের ব্যবসার মধ্যে আভ্যন্তরীণ কী গোমর ছিল, সেটা অনেকদিন ধরেই একটা ধাঁধা। যার সমাধান করা হবে একটু পরেই। তার আগে আরও কিছু বিষয় পাঠকদের মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ব্যবসার শুরুতে গ্রামীণফোনের সুন্দর একটি ”দেশিয় লোগো” ছিল। গ্রামীণ কৃষক-কৃষাণিরা অ্যান্টেনাযুক্ত একটি মোবাইল ফোন কানে দিয়ে কথা বলছেন। লাল-সবুজ রঙের সেই লোগো। বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও বোঝানো হচ্ছিল এটা বাংলাদেশি ফোন। বাঙালি বড্ড আবেগী জাতি। লোগো আর বিজ্ঞাপনে ধরেই নিয়েছে কোম্পানির মালিকানা গ্রামীণ জনগণের, যারা গ্রামীণব্যাংকের দরিদ্র সদস্য। সবাই তাই সিটসেলের পর নতুন কোম্পানি দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাতে গ্রামীণফোনও একচেটিয়া ব্যবসা করে গেল। লোকাল কল প্রতি মিনিটে ১০ টাকা করে চার্জ কাটে, ইনকামিং-আউটগোয়িং দুদিকেই কাটত টাকা। ৩০০ টাকার, ৬০০ টাকার কার্ড রিচার্জ করে কথা বলতে না বলতেই ফুড়ুৎ!
[গোমর ফাঁস: অর্থনীতিবিদ ইউনূসের শান্তিতে নোবেল জয়! বিশ্ব শান্তি রক্ষায় তার অবদান কী ছিল?]
তবুও জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কারণ, সবার ধারনা- এর লভ্যাংশের মালিক তো তৃণমূল জনগণ। আর গ্রামীণফোনের মালিক হলো গ্রামীণ টেলিকম, যে ‘গ্রামীণ’ ব্র্যান্ডনেম-এর কপিরাইট গ্রামীণব্যাংকের। অর্থাৎ গ্রামীণব্যাংকের মতো তাদের সিস্টার কনসার্ন গ্ৰুপ গ্রামীণ টেলিকম। যেমন আছে- গ্রামীণ চেক, গ্রামীণ শক্তি ইত্যাদি। যার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বিদেশিদের একান্ত আস্থাভাজন ড. ইউনূস। এনজিও ও গ্রামীণব্যাংকের নামের আবেগ ব্যবহার করে লাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরী করাও বড় রকমের প্রতারণা। ভাবখানা এমন, এসবের লভ্যাংশ পাচ্ছে গ্রামীণব্যাংকের তৃণমূলের সদস্যরা। মূলত পাচ্ছেন শুধু ড. ইউনূস একা, আর কেউ নয়।
এমনই ছিল সাধারণ মানুষের প্রচলিত ধারণা। সাধারণ জনগণকে এভাবেই বোঝানো হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার ৮ বছর পর গ্রামীণফোনের লোগো হঠাৎ এক রাতেই বদলে গেল! লাল-সবুজের ফোন হয়ে গেলো নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির ফোন। অর্থাৎ টেলিনর কোম্পানির লোগো বসে গেল গ্রামীণফোনের সবকিছুতে। যে নরওয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়, সেই নরওয়ের সরকারের কোম্পানি এই টেলিনর; যার নাম দুদিন আগেও শোনেনি বাঙালি। ২০০৬ সালের ১৮ই নভেম্বর এক রাতেই লোগো বদলে গেল এবং ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন এর ঠিক ২২ দিন পর, অর্থাৎ ১০ই ডিসেম্বর ২০০৬। কী বুঝলেন? হিসাব মিলেছে?
যদিও ইউনূস সেন্টার এর আগে তাদের বিবৃতিতে গ্রামীণফোনের সাথে ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ-এর সম্পর্ককে অস্বীকার করেছিল। যদিও পরবর্তীতে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব ও পাওনা না দেয়ার এক জঘন্য কুকর্মের দরুণ ফাঁস হয়ে যায় উভয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের কথা। আসুন, ড. ইউনূস এবং গ্রামীণফোনের সম্পর্কটা কী, সেই রহস্যটাও ফাঁস করি।
নরওয়ের টেলিনর-এর মালিকানাধীন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন-এর ৩৪.২০ শতাংশের মালিক ড. ইউনূসের মালিনাকাধীন গ্রামীণ টেলিকম। গ্রামীণফোনের কাছ থেকে প্রতিবছর গ্রামীণ টেলিকম ডিভিডেন্ট পায় হাজার কোটি টাকার ওপরে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই তাদের ডিভিডেন্ট এসেছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যার ৫% শ্রমিক কল্যাণ খাতে দেওয়ার শর্ত থাকলেও ১ টাকাও পরিশোধ করেনি গ্রামীণ টেলিকম। আর এভাবে ২০০৬ সাল থেকে জমতে জমতে ২০২২ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। ফলে ক্ষুব্ধ কর্মীরা বকেয়া পাওনা চেয়ে ১০৭টি মামলা দায়ের করেছেন।
সেই মামলার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর টনক নড়ে ইউনূস গং-এর। ৩০০ কোটি টাকা পাওনা আদায়ের জন্য ঢাকার শ্রম আদালতে শ্রমিকদের দায়েরকৃত সেই ১০৭টি মামলা থেকে বাঁচতে প্রায় ১৪ কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দেয় গ্রামীণ টেলিকম। যে কোনোভাবেই হোক এই মামলা জিতিয়ে দিতে চুক্তি সই করে গ্রামীণ কল্যাণ আর ঢাকা লজিস্টিক সার্ভিসেস অ্যান্ড সলিউশন। আর, সেই চুক্তির অনুমোদন দেন খোদ ড. ইউনূস।
[গোমর ফাঁস: অর্থনীতিবিদ ইউনূসের শান্তিতে নোবেল জয়! বিশ্ব শান্তি রক্ষায় তার অবদান কী ছিল?]
২০২১ সালের ১৪ই জুন পরিচালনা পর্ষদের ভার্চুয়াল সভায় মামলাগুলো জিততে ঢাকা লজিস্টিকের সঙ্গে চুক্তিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। চুক্তিতে ঢাকা লজিস্টিক মামলাগুলোর রায় গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষে আনতে প্রশাসনের বিভিন্ন পক্ষের সাথে ‘এনগেইজ’ করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘সন্তুষ্ট’ করার কথাও বলা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলা, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং শ্রমিক নেতাদেরও সন্তুষ্ট করার জন্য নির্দেশনা দেন ইউনূস। পুরো কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১৪ কোটি টাকা। বোর্ড সভায় এহেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমোদন দেন ইউনূস স্বয়ং।
এর আগেও আরও কয়েকটি ঘটনায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শোষিত হয়ে মামলা করার অপরাধে ৯৯ জন ভুক্তভোগী কর্মীকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরাসরি ছাঁটাই করেছিল গ্রামীণ টেলিকম। সেই মামলা জিততেও গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আদালতে ঘুষ দেয় ইউনূস গং। আর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন নিষ্ঠুর ও ন্যাক্কারজনক ব্যবস্থা গ্রহণের সেই পুরনো উদাহরণটিও উল্লেখ করা হয় ঢাকা লজিস্টিকের সাথে করা চুক্তিপত্রে। কীভাবে মামলার রায় নিজেদের অনুকূলে আনতে হবে, সেজন্য পুরনো উদাহরণগুলো ব্যবহার করেন ইউনূস। পরবর্তীতে মামলার রায় ম্যানিপুলেশন করার অপচেষ্টায় বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের খবরও ফাঁস হয়। সেই মামলায় ইউনূস গংয়ের আইনজীবী এবং তার পক্ষের শ্রমিক নেতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক বড় অঙ্কের অস্বাভাবিক লেনদেন ও ঘুষ আদান-প্রদানের খবর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের খবরে উঠে আসে।
এমনই শান্তির পায়রা আমাদের এই ইউনূস। তিনি বিশ্বজুড়ে কোন শান্তির বারতা দিতে চান, তা জনগণের সামনে তুলে ধরা হলো। অর্থনীতিবিদিন হিসেবে তার যোগ্যতা যা-ই হোক, সেটা দিয়ে তিনি নোবেল বাগাতে পারেননি। তবে কূটকৌশল এবং লুটপাটের মাধ্যমে বিদেশিদের পকেটে দেশের মানুষের ঘামে-শ্রমে কষ্টার্জিত অর্থ তুলে দেয়ার জন্য যে শান্তিপূর্ণ তরিকা আবিষ্কার করেছেন, বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেয়ার যে পাইপলাইন তৈরি করেছেন, তাতে নরওয়ে সরকার ইউনূসের ঝোলায় আরও দু-চারটে নোবেল ছুড়ে দিলেও অবাক হবার কিছু থাকতো না।
আরও পড়ুনঃ
- ড. ইউনূস এর কর ফাঁকি ও গ্রামীণের কর্মচারীদের দায়ের করা মামলা নিয়ে ইকোনমিস্ট এর মিডিয়া ট্রায়ালের অপচেষ্টা
- অনুসন্ধানঃ ৯টি বিদেশি ব্যাংকে ড. ইউনূসের ৭৫ কোটি টাকার সন্ধান
- জাতীয় নির্বাচন: ইউনূসের অর্থায়নে নাশকতার ছক বিএনপির নেতাদের