ব্যাংকিং খাত

ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কেলেঙ্কারি:

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ব্যবসায়িক অংশীদার ও সকল অপকর্ম-দুর্নীতির দোসর গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে অবৈধভাবে এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে শর্তহীন প্রক্রিয়ায় বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল ওরিয়েন্টাল ব্যাংক (সাবেক আল-বারাকা ব্যাংক)। সেই সময় ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকপক্ষ ছিলেন তারেক রহমানের মাফিয়া সাম্রাজ্য হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই এটা সহজেই অনুমেয়, উভয়পক্ষের কারসাজিতেই এই আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছিল।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে ৫৯৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার তাদরে বিচারের মুখোমুখি করে। অভিযোগ প্রমাণের প্রেক্ষিতে তাদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়। অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্তদের তালিকায় ছিলেন ব্যাংক মালিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। জাল দলিল, ভুয়া একাউন্ট, ভাউচারের মাধ্যমে ব্যাংকটির কারওয়ান বাজার, নবাবপুর, মতিঝিল ও অন্য দুটি শাখায় এই অর্থ কেলেঙ্কারি ঘটে। যা দেশের ইতিহাসে প্রথম বড় অর্থ কেলেঙ্কারি। জড়িতরা বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ মদদে এই কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন আল মামুন বিভিন্ন মামলার সাজা খাটলেও তার দোসর তারেক রহমান রয়েছেন পলাতক।

২০০৬ সালের ১৯শে জুন ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আসলে তদন্তের সময় কেলেঙ্কারির বিষয়টি উন্মোচিত হয়। এরপর ২০০৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় অর্থ আত্মসাতের মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলার অভিযোগ, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় আন্তঃশাখা লেনদেনের ভুয়া ভাউচার, ভুয়া একাউন্ট, কৃত্রিম উৎস এবং আমানত দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এরপর ঐ বছর ২৭শে আগস্ট ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুদক।

ব্যাংকের মালিকসহ অভিযুক্ত বাকিরা হলেন- ব্যাংকের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট শাহ মহাম্মদ হারুণ ও একেএম মাহমুদ উল্লাহ, সাবেক দুই সহকারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও এ কে এম নেয়ামতুল্লাহ এবং এক্সিকিউটিভ রাকিবুল ইসলাম। তারা সবাই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার একান্ত আস্থাভাজন। বিএনপির নেতাদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়মিত ঋণ অনুমোদনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করতেন। তারেক রহমানের খোয়াব ভবনে দেয়া রাতের রঙিন আসরের নিয়মিত অতিথি ছিলেন তারা।

২০০৭ সালের ২৭শে আগস্ট মামলার চার্জশিটে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে ৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা জমার অভিযোগ দেখানো হয়। এরপর ওই বছরই ৩১শে অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় দুদক। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে ওই বছরের ২৭শে ডিসেম্বর বিশেষ আদালতের রায়ে ব্যাংক মালিককে কারাদণ্ড ও ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে বাকি অভিযুক্তদের প্রত্যেককে ৫ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের তৎকালীন প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেংথেনিং প্রজেক্টের সাবেক মহাব্যবস্থাপক রফিউল আলম। তিনি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামের সাবেক নায়েবে আমির রাজাকার একেএম ইউসুফের পরিবারের সদস্য। রফিউল পরিচালক থাকা অবস্থায় এই আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে জানা যায়, তিনি পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালে পরিচালনা পর্ষদের মোট ২২টি সভা অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে ব্যাংকের এত বিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় কোনো আলোচনা হয়নি কখনই। সবসময় এই বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়েছে গণমাধ্যম, গ্রাহক, ব্যাংকের বিভিন্ন স্টেক হোল্ডার, ব্যবসায়িক পার্টনার, অংশীদার ও আমানত রাখা বাণিজ্যিক পক্ষের কাছ থেকে। বাজারে যেন ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, সেজন্য সভার এজেন্ডায় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা চেপে যাওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, যেসব জাল নথির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল, সেসব নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান ব্যাংকটির কারওয়ান বাজার শাখার ব্যবস্থাপক আশরাফ আলী। কিন্তু ওই নথিগুলর ফটোকপি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত থাকায় শেষমেশ জালিয়াতি ধরা পড়ে।

আত্মসাৎকৃত অর্থের সিংহভাগই খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের মালিকানাধীন ওয়ান ডেনিম মিলস অ্যান্ড ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের নামে নগদ করা হয়েছিলো। বেশিরভাগ সময়ে ওই জাল নথিগুলোতে স্বাক্ষর করেছেন ব্যাংকের মালিক- প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক শাখার দুই কর্মকর্তা নাজিয়া আক্তার ও সিদ্দিকা। তাদের স্বাক্ষরে অনেক পে-অর্ডার এবং নগদ টাকাও জমা ছিল। ওয়ান ডেনিম মিলস, ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট এবং অ্যাগ্রোবার্ডস-এর নামে জমা করা পে-অর্ডারগুলো পেত ওরিয়ন গ্রুপ। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকানা পায় হওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এরপরই কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে থাকে একে একে।

ব্যাংকটি ওরিয়ন গ্রুপের অধীনে আসার আগে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটু ব্যাংকটির মালিক ছিলেন। এই লিটু হলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিমের বোন জামাই। লিটুর মালিকানাধীন সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিলো ১৪৩ কোটি টাকা। ১৯৮৭ সালে আল-বারাকা নামে যাত্রা শুরু করেছিল এই ওরিয়েন্টাল ব্যাংক।

গিয়াস উদ্দিন আল মামুন
গিয়াস উদ্দিন আল মামুন

খালেদা জিয়া যখন প্রথমবার ক্ষমতায় বসেন, তখন থেকে ব্যাংকটির গতি নিম্নমুখী হয়। ১৯৯৪ সালে ‘ত্রুটিপূর্ণ ব্যাংক’ হিসাবে চিহ্নিত করা হলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং সহযোগীরা সংস্থাগুলি ব্যাংকের ৮৩ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। যার মধ্যে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালুও রয়েছেন। যার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অনেকগুলো মামলা চলমান। শুধু একটি মামলার অভিযোগই আছে দুবাইতে ২০০ কোটি টাকা পাচারের। ২০০৪ সালে আল-বারাকা নামটি বদলে ওরিয়েন্টাল নামে তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসাবে চালু হয় ব্যাংকটি।

২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ব্যাংকটির অর্থ কেলেঙ্কারি ধরা পড়লে ব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের হস্তক্ষেপে গ্রাহকদের কথা বিবেচনা রেখে ব্যাংকটি বন্ধ করা হয়নি। পরবর্তীতে ব্যাংকটির শেয়ার মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিলে ২০০৯ সালে আইসিবি নামে আত্মপ্রকাশ করে আবার। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাংকটিতে অনেক সংস্কার আনা হয়। ক্রমে অনেকখানি রিকভার করতে সক্ষম হয়।

মূলত বিএনপি আমলেই ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মালিকানা গ্রহণ করা শিল্প গ্রুপ ওরিয়নের প্রসার ঘটে এবং ওই সময়ই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটটি। লিটু গং সে সময় নিয়মিত হাওয়া ভবনে যাতায়াত করতেন এবং তারেক রহমানেরও বেশ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

বিএনপির আরেক নেতা- হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হারিছ চৌধুরীর সঙ্গেও ওই সময় তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে তিনি সরকারি অনেকগুলো কাজের বড় ধরনের টেন্ডার বাগিয়ে নেন। আর এভাবেই তিনি তার ব্যবসার প্রসার ঘটান। সরকার পরিবর্তন হলেও সেই সিন্ডিকেট টিকে আছে এখনও। সম্প্রতি বিএনপির আন্দোলনে অর্থের যোগানদাতা হিসেবে বেশকিছু ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা মিলেছে। যারা গোপনে অর্থায়ন করছেন এবং লন্ডনে অর্থ পাচার করছেন। যাদের মধ্যে এই সিন্ডিকেটটিও রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।

ব্যাংকলুটে জিয়া পরিবারের সদস্যদের কৃতিত্ব:

প্রায়শ ব্যাংকিং খাত নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গলাবাজি করেন। কিন্তু তিনি নিজ দলের ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ী নেতা এবং ব্যাংক লুটেরাদের তথ্য আড়াল করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, খালেদা জিয়া, তার পুত্রবধূ সৈয়দা শর্মিলা রহমান, তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার ও তার স্ত্রীসহ বেশ ক’জন নেতা- যারা জিয়ার পরিবারের অংশ, তারা প্রত্যেকেই ঋণ খেলাপি। এদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলাও আছে। যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

১৯৯১ সালে বিএনপি প্রথমবার ক্ষমতায় এসে প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক থেকে তারেক রহমানের প্রতিষ্ঠান ড্যান্ডি ডায়িংয়ের নামে বেশ বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিলেন। ড্যান্ডি ডায়িংয়ের সেই ঋণ এখনও পরিশোধ করা হয়নি। এটা বাজে ঋণ হিসেবে তালিকাভুক্ত। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই খেলাপি ঋণের অর্থ উদ্ধারের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলাও করেছে। যা ঝুলে আছে দীর্ঘদিন।

খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক জনতা ও অগ্রণী থেকে ঋণ নিয়েছিল ২০১২ সালে। সেই ঋণও পরিশোধ করা হয়নি। অর্থঋণ আদালতে টাকা উদ্ধারে মামলাও করা হয়েছে ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কোকোর মৃত্যুর পর ঐ অর্থের দায়-দায়িত্ব এখন খালেদা জিয়া ও পুত্রবধূ শর্মিলার নামে। খালেদা জিয়ার ভাই সাইদ এস্কান্দারও ঋণ খেলাপি অবস্থায় মারা গেছেন।

শামীম এস্কান্দার-তারেক-মির্জা ফখরুল
শামীম এস্কান্দার-তারেক রহমান-মির্জা ফখরুল

এছাড়াও বিএনপির অনেক নেতাই ব্যাংক ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেননি। বছরখানেক আগে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ব্যাংকিং খাত নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিবিদ এক সাক্ষাৎকারে ক্ষোভের সাথেই বলেছিলেন, ‘ব্যাংক লুটপাট শুরু হয়েছিল বিএনপি আমলেই।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আল-বারাকা ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালুর কারণে। বিএনপি নেতারা এখন কোন মুখে ব্যাংকি খাত নিয়ে কথা বলেন?” সেই অর্থনীতিবিদ আরও বলেছিলেন, ‘গোটা জিয়া পরিবারই তো ঋণ খেলাপি। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের অর্থ ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি তারা। সাবকে প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) এক ভাই ঋণ খেলাপি অবস্থাতেই মারা গেছেন। তারা রাষ্ট্রীয় পদে থেকে ব্যাংক লুট করেছেন। তাদেরকে বলা যায় ভিভিআইপি ব্যাংক ডাকাত।’

আরও পড়ুনঃ