মায়ের ডাক

মায়ের ডাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটির প্রচার বাড়ানোর জন্য মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির নেতৃবৃন্দ  কাজ করে। বিশেষত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সংগে।  এছাড়াও আন্তর্জাতিক  পর্যায়ে কাজ করে এমন মানবাধিকার সংস্থার হেড অফিসের সংগে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনও গড়ে উঠে।

২০১৩ সালে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির যাত্রা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার,  আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বর্তমান নির্বাহী পরিচালবক মো. নূর খান লিটন,  বিতর্কিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের আদিলুর রহমান শুভ্র, ব্যারিষ্টার সারা হোসেন,  শিরিন হক প্রমুখ।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে মূলত এই সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে ক্রসফায়ার পুলিশ নির্যাতন এবং গুম এসব বিষয় নিয়ে এগোতে থাকে। মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির কর্মসূচিগুলো নিয়মিত হতে থাকে প্রেস ক্লাব এলাকায়। সেখানে ধীরে ধীরে বিশেষ বক্তা হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি ও অন্যরা যুক্ত হতে থাকেন।

গুমের শিকার পরিবারগুলোকে  একটা প্লাটফর্মে আনার জন্য মৌলিক সুরক্ষা কমিটি কৌশলগত কাজ করতে থাকে।  অধিকার এবং আদিলুর রহমান শুভ্র এবং গুম খুন নিয়ে কাজ করেন এমন মানবাধিকার কর্মীরা সারাদেশ থেকে গুমের  অভিযোগ উথাপন করা পরিবারগুলোকে একত্রিত করে দেয়।

পরিবারগুলো শুরুতে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির ব্যানারে আলোচনা সভা করা শুরু করে।  এরপর  ঢাকার নাখালপাড়া এলাকা থেকে গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা সুমনের পরিবারের নেতৃত্বে মায়ের ডাক সংগঠন এর যাত্রা।  সুমনের মা শুরু থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

২০১৪ সালে সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি জেনেভায় যান সুমনের গুমের বিষয়ে। সেখানে অভিযোগ দায়ের করেন। তার যাওয়া এবং আনুসাঙ্গিক সহোগিতা করে মৌলিক অধিকার সুরক্ষার নেতৃবৃন্দ।

এরপর তুলি এবং তার বোন আঁখি মায়ের ডাকের দাপ্তরিক কাজ গুলে করা শুরু করেন। শুরুর দিকে গুমের শিকার ৮০ থেকে ৮২ টি পরিবার নিয়ে কর্মসূচি পালন করলেও মায়ের ডাক কিছুদিনের মধ্যেই শুধুমাত্র বিএনপি এবং জামায়াতের পরিবারগুলোর মধ্যে ১৯ টি পরিবারকে একত্রিত করে মায়ের ডাক পরিচালনা করে আসছে।

যেহেতু মায়ের ডাকের সানজিদা ইসলাম তুলিদের তুলনামূলক আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল অন্যদের তুলনায়, সে কারনে সংগঠনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত তাদের মতামতের প্রাধান্যতেই হয়ে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা মায়ের ডাকের সংগে একাত্নতা প্রকাশ করে। মায়ের ডাক সরাসরি কর্মসুচি ঘোষনা করে বিএনপি মহাসচিবের সংগে সাক্ষাত করে।

মায়ের ডাক নামটি আর্জেন্টিনায় ১৯৬০ এর দশকে নিরুদ্দেশ লোকজনের জন্য গড়ে একটা মুভমেন্টের নামের বাংলা অনুবাদ।  বাংলাদেশে মায়ের ডাক নামটি  আসিফ নজরুলের দেয়া। দীর্ঘ সময় ধরে সংগঠনটি তাদের কর্মসুচী  পালন করে আসছে।  তবে ১৯ টি পরিবারের বাইরে তাদের সংগে অন্য পরিবারগুলো সার্বিকভাবে যুক্ত থাকে না আর।

এখন এটি নিশ্চিত ‘মায়ের ডাক’ এখন মূলত ‘বিএনপি–জামায়াতের ডাক’ এ পরিণত হয়েছে।  একাত্তরের মানববতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর স্ত্রীকেও এখন মায়ের ডাকের অনুষ্ঠানে দেখতে পাওয়া যায়। আর বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এই নিবিড় ঘণিষ্ঠতার জন্যই অন্য পরিবারগুলো আর মায়ের ডাকের সঙ্গে নেই।  তারা এই মায়ের ডাকের অশুভ তৎপরতা সম্পর্কেও এখন সজাগ।  আর এ জন্য দূরত্ব রাখতে চান।

দেখা যায়, যখনই কোনো বিদেশি বাংলাদেশে আসে তখন মায়ের ডাক রাস্তায় নেমে পড়ে।  আর এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা কান্নাকাটি করে ও মানবিক কথা বলে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।

[মায়ের ডাক এর আড়ালে কি চলছে?]

মায়ের ডাক আঞ্চলিক পর্যায়ে মানবাধিকার প্লাটফর্ম  বিশেষত ফোরাম এশিয়া,  এফআইডিএইচ,  ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্স, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এদের সাপোর্ট নিচ্ছে।  এর পাশাপাশি জাতিসংঘের  বিশেষ রেপোর্টিয়ারের সংগে মায়ের ডাকেট সরসরি কাজের সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে  মায়ের ডাক ভাইব্রান্ট সিএসও হিসেবে কাজ করে।

মৌলিক সুরক্ষা কমিটি এ দেশে জঙ্গিবাদ এবং ২০১৪ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো মতামত ব্যক্ত করে নাই।  মূলত মৌলিক সুরক্ষা কমিটির ব্রেইন চাইল্ড মায়ের ডাক।

মো. সেলিম রেজা পিন্টু

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এবং পেশায় ব্যবসায়ী পিন্টুকে ঢাকা থেকে ২০১৪ সালে সাদা পোশাকের তিন ব্যক্তি এসে নিয়ে যায়। তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। যদিও জানা যায়, সরকারি কোনো বাহিনীই তাকে আটক করেনি। ২০১২-১৩ সালে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যা, নাশকতা, আগুন সন্ত্রাসসহ বেশ কিছু মামলাও ছিল।

মো. আসাদুজ্জামান রানা বাবু, আল–আমিন, সাজেদুল ইসলাম সুমন, মোহাম্মদ আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম

২০১৫ সালে ঢাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এই ৬ জনকে। এদের মধ্যে সাজেদুল ঢাকার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এবং তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা ছিল।তবে তাদের বিরুদ্ধে এমন কোনো গুরুতর অভিযোগ ছিল না যে, র্যাব গ্রেপ্তার করবে। র্যাবের কোনো টিম তাদেরকে নিয়ে গেছে, এমন তথ্য মেলেনি। তবে পরিবেরের দাবি আইন শৃঙ্খলা বাহিনি তাদের আটক করেছে।

মো. কাওসার হোসেন, এ এম আদনান চৌধুরী

RAB পরিচয় দিয়ে এই দুজনকে ২০১৩ সালে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়েছে। উপরোক্ত ৬ জনের সাথে এই দুজনের যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। সেই হিসেবে একটি সূত্র বলছে, বিএনপির স্থানীয় কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক কোন্দল এদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে দায়ী হতে পারে।

নুরুল আমিন

লক্ষ্মীপুর থেকে তাকে ২০১৫ সালের ২৯শে মার্চ পুলিশ ও আনসার পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না তিনি। তবে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে স্বজনদের সাথে দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা যায়। সেই দ্বন্দ্বের জেরে তাকে প্রতিপক্ষ কেউ গুম করে থাকতে পারে বলেও  ধারণা করেন অনেকে।

সোহেল রানা

২০১৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়। বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের হয়ে বিভিন্ন সময় সহিংসতা ও নাশকতায় অংশ নিয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তবে স্থানীয় গ্রুপিংয়ের দ্বন্দ্বে শিকার হয়ে ইতিপূর্বে তিনি বিবাদে জড়ান বিএনপির স্থানীয় এক নেতার সাথে। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এমন কোনো কারণ থাকতে পারে বলে রাজনৈতিক সহকর্মীদের  অনেকেই মনে করেন। তবে পরিবার দাবি করে- আইন শৃঙ্খলা বাহিনি তাকে আটক করেছে।

মো. হোসেন চঞ্চল, পারভেজ হোসেন, মাহফুজুর রহমান সোহেল,জহিরুল ইসলাম

বিএনপির এই কর্মীদের স্বজনদের দাবি, ঢাকা থেকে তাদেরকে ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। যদিও সরকারি কোনো সংস্থা তাদেরকে আটক করেনি বলে দাবি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সম্রাট মোল্লা, খালেদ হাসান

বিএনপির এই দুই কর্মী বিভিন্ন মামলায় ঢাকা কারাগারে কারাবরণ করছিলেন। ২০১৩ সালের ২৮শে নভেম্বর তারা যখন মুক্তি পান, কারাগারের গেটে দলের সদস্যরা তাদেরকে বরণ করার কথা ছিল। কিন্তু তারা জেল থেকে বেরিয়ে অজ্ঞাতনামা লোকজনকে দেখতে পান। ডিবি পরিচয়ে তাদেরকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়।

ইসমাইল হোসেন

ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন একসময় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের নেতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ছিল। যদিও তথ্য-প্রমাণের অভাবে তিনি পরবর্তীতে খালাস পান। ধারণা করা হয়, দ্বন্দ্বের কারণে তিনি ২০১৯ সালের ১৯শে জুন ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনি তাকে তুলে নিয়ে গাছে।

ইফতেখার আহমেদ দিনার, জুনায়েদ আহমেদ

২০১২ সালের ২রা এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ইফতেখার এবং জুনায়েদ। জুনায়েদ সিলেট মহানগর শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সংগঠন দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে তাদের আটক হওয়ার কোনো তথ্য মেলেনি। পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় তাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনি আটক করেছে।

আরও পড়ুনঃ