
❛পেঁচা রাষ্ট্র করে পেলে কোনো ছুতা, জানো না, আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা❜- পুরনো এই বাংলা প্রবাদের আদলে নতুন করে বলা যায়- বিএনপি ঢোল পেটায় পেলে কোনো ছুতা, জানো না, সরকারি দলের সাথে আমাদের জন্মশত্রুতা। যে কারণে প্রবাদটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা হলো- আওয়ামী লীগ বা এর কোনো অঙ্গসংগঠনের অতি ক্ষুদ্র কোনো পর্যায়ের সাধারণ নেতা-কর্মীর নামে যদি অপরাধের অভিযোগ ওঠে, তবে প্রমাণ হোক না হোক, বিএনপি সেটা নিয়ে ঢোল বাজিয়ে প্রচার-প্রচারণার চূড়ান্ত করে। অথচ, নিজেদের দলীয় নেতা-কর্মীদের বেলায় তাদের মুখে থাকে কুলুপ!
গতকাল একটি ভিডিও সারাদেশের মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছে, ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। একটি প্রাইভেট কারের নিচে দুর্ঘটনায় পতিত এক নারীর দেহকে টেনে-হিঁচড়ে এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে গেছে এক চালক। জনতার চিৎকার-চেঁচামেচি সত্ত্বেও তিনি গাড়ি থামাননি। পরে উত্তেজিত জনতা তাকে আটক করতে সমর্থ হয়। পৈশাচিক মনোবৃত্তির সেই গাড়িচালকের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক আজাহার জাফর শাহ। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হলো তিনি ঢাবির বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের প্যানেল ‘সাদা দল’-এর একজন নেতা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে রয়েছে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক।
আরও পড়ুনঃ একটি বিশেষ দূতাবাসের পরামর্শেই ইইউকে ধোঁকা দিতে বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছেদ নাটক!
আজহার জাফর শাহ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক ফেসবুকে লিখেছেন-
‘গতকাল (২ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যা ঘটল, তারপর থেকে স্তম্ভিত হয়ে আছি। একটা (অ) মানুষ কীভাবে গাড়িচাপা দেওয়া বডিকে এত দূর টেনে নিয়ে যেতে পারে? এই ঘাতক (অ) মানুষটির কথা শুনতাম মাঝে মাঝে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বন্ধু-সহকর্মীর কাছ থেকে। পারিবারিক সূত্রে ধনী (পুরোনো গাড়ির যে ছবি দেখা গেছে পত্রিকায়, তা কিন্তু অ্যানটিক হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন, নয়তো ক্যাম্পাসে স্পোর্টস কার নিয়ে আসতেও দেখা যেত তাকে)। অত্যন্ত অহংকারী তিনি, মানবিক গুণাবলির খুব অভাব, অন্যের সঙ্গে দুর্ব্যবহারে ওস্তাদ লোক। নম্বরপত্র নিয়ে অনিয়ম করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার চাকরি গেছে। অনেক শিক্ষার্থীর জীবন তার কলমের খোঁচায় এলোমেলো হয়েছে। অন্যের জীবনের মূল্য তার কাছে সামান্য। তাইতো চাপা দেওয়ার পরও ভিকটিমের বডিকে গাড়ির সঙ্গে টেনে নিয়ে মেরে ফেলতে পেরেছেন তিনি। শুনেছি, গণপিটুনি খেয়ে তিনিও হাসপাতালে। প্রত্যাশা করি, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন, তার বিরুদ্ধে করা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন এবং বিচারপ্রক্রিয়া সমাপ্ত হলে রায় তার বিরুদ্ধে যাক। বাকি জীবন আমি তাকে কারাগারে দেখতে চাই। তিনি আজহার জাফর শাহ!’
ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ফেসবুকে লিখেছেন-
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন হিসেবে আমি লজ্জিত যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চাকরিচ্যুত শিক্ষকের প্রাইভেট কারের নিচে টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই একজন নিহত হয়েছেন। গাড়িচালক ওই শিক্ষকের আচরণ ও কর্মকাণ্ড ভয়াবহ ও চরম নিন্দনীয়। এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। ক্যাম্পাসের ভেতরে এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। নিরাপদ ক্যাম্পাস আমাদের সকলের দাবি।’
জাফর শাহর ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘অনেকগুলো অনিয়মের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগের সঙ্গে ১০ বছরের বেশি সময় যোগাযোগ না রাখায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে বিস্তারিত অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৭ সালে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আজহার জাফর শাহের বিরুদ্ধে অশিক্ষকসুলভ এবং অপেশাদারিত্বমূলক আচরণ ও বিভিন্ন পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ায় পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ করা হয়। ক্ষোভের জেরে ৮০ জন শিক্ষার্থীকে শূন্য (০) নম্বর দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেই সময় বিভাগ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে বলা হলে তিনি তোয়াক্কা করেননি। তখন তাঁকে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে বারণ করে কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেননি জাফর শাহ। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম (সিন্ডিকেট) তাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তার পুরনো কলিগদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আজহার জাফর শাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের পদোন্নতি আটকে দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে নানারকম কাল্পনিক অভিযোগ তুলে হেয় প্রতিপন্ন করাসহ নানারকম হয়রানি করেছেন। বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ ফুরালে তিনি কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তবুও তার মতাদর্শের লোকজনের সাথে মিলে নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এছাড়াও পরীক্ষাপত্রে নম্বর কমিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ডিপার্টমেন্টের সুন্দরী ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে তার নামে বেশ কিছু অভিযোগও রয়েছে। প্রতিবাদকারীদের ওপর শোধ নিতেন তিনি পরীক্ষার খাতায়, জানান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। এমন এক বিকৃত মানসিকতার এই শিক্ষকের কঠোর বিচার দাবি করেন তারা।
জাফর শাহর গাড়িচাপায় নিহত রুবিনা আক্তার তার দেবর নূরুল আমিনের বাইকে করে যাচ্ছিলেন। জাফরের গাড়ি তাদের পেছনে ধাক্কা দেয়। এ সময় রুবিনা রাস্তায় ছিটকে পড়লে তার শাড়ির অংশ গাড়ির বাম্পারে আটকে যায়। সেই অবস্থাতেই তাকে টেনে-হিঁচড়ে নীলক্ষেতের দিকে দ্রুতবেগে চলে যেতে থাকেন জাফর। এ সময় নূরুল আমিন সামলে উঠে দাঁড়িয়ে দেখেন তার ভাবী গাড়ির নিচে আটকে আছেন এবং বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িটি। তিনিও গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকেন। একপর্যায়ে টিএসসিতে থাকা লোকজনও গাড়িটির পিছু নিয়ে থামানোর জন্য চিৎকার করতে থাকেন। তবুও চালক জাফর শাহ গাড়ি থামাননি।
এক কিলোমিটার এভাবে রুবিনাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি চালিয়ে নীলক্ষেত মোড় ঘুরে পলাশী অভিমুখী যাওয়ার সময় জনতা তাকে আটক করতে সক্ষম হয়। পথচারীরা যখন রুবিনার দেহটি উদ্ধার করেন, ততক্ষণে সেটি একদলা মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। এমনকি টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন জায়গায় তার দেহের খণ্ডিত অংশ পড়ে ছিল। এসব দেখে উত্তেজিত জনতা জাফরকে গণপিটুনি দিয়ে মারাত্মক আহত করে, গাড়িটিও ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে পুলিশ এসে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুলিশ এবং জনতা রুবিনার দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গণপিটুনিতে আহত বিএনপি নেতা জাফর শাহও একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
[নারীকে গাড়িতে পিষে দেয়া বিএনপির পেশাজীবী নেতার পৈশাচিকতা, দলের নেতাদের কেন মুখে কুলুপ?]
শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ জানান, নিহত ৪৫ বছর বয়সী নারী রুবিনা আক্তারের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। শনিবার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে শুক্রবার গভীর রাতে রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন। যাতে গাড়িচালক আজহার জাফর শাহকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এই নৃশংসতম ঘটনা নিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপি নেতাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতপন্থী বিভিন্ন পেজ থেকেও এই ঘটনা সম্পর্কে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করা হয়নি। এক আশ্চর্যজনক নীরবতা দেখা গেছে সর্বত্র। বিএনপি নেতা বলে কি খুনি আজহার জাফর শাহর বিচার চাওয়া যাবে না? প্রশ্ন রইল।
আরও পড়ুনঃ
- বিএনপি’র রাজনীতি না করার দরুণ অকারণে চাকরি হারাতেন পেশাজীবীরা
- গুজব ছড়ানো এখন বিএনপির প্রধান কাজ
- লন্ডনে তারেক জিয়া ও ভোঁতা মালেকের মাফিয়া সাম্রাজ্য এবং দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের গোমর ফাঁস