
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকে বিতর্কিত করার জন্য যেসব অপচেষ্টা করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো গণমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষের মনকে ডাইভার্ট করা। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে এভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত সরকার। এরই অংশ হিসেবে- বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের দায়ে আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও ফেরারি আসামি, আত্মস্বীকৃত খুনি, খন্দকার আব্দুর রশিদকে পর্যন্ত ইন্টারভিউ করে সম্প্রচার করা হয় টেলিভিশনে।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যখন মুক্তিযুদ্ধকালীন ধর্ষণ-হত্যা-লুটপাটসহ মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছিল। ঠিক এরকম একটি সময়ে একজন খুনির মুখ থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। আসুন দেখে নেই- এই ঘৃণ্য অপকর্মটি কখন করা হয়েছিল আর কারাই বা করেছিল!
সময়টা ২০০৮ সাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কাল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার জন্য গণমানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় আওয়ামী লীগ। তরুণপ্রজন্মের মধ্যে নবজাগরণ শুরু হয়, পূর্বপুরুষদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে স্লোগান তোলে তারা। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা তরুণপ্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কৌশলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারত-বিদ্ধেষ, বঙ্গবন্ধু-বিরোধী অপপ্রচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে শুরু করে।
আর তাদের এই নীলনকশা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন চ্যানেল আইয়ের টক-শো উপস্থাপক জিল্লুর রহমান।
[তৃতীয় মাত্রার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুর রশিদ: ভারত-বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকে জায়েজ করার ঘৃণ্য চেষ্টা!]
আপনারা নিশ্চই জানেন, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৩ সালের ১৭ জুলাই চ্যানেল আইতে শুরু হয় টক-শো অনুষ্ঠান ‘তৃতীয় মাত্রা’। প্রথম পর্বে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদে আলোচক হিসেবে নেন সঞ্চালক জিল্লুর রহমান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে নিয়েও বিশেষ এপিসোড করেন এই সঞ্চালক। সেই ধারাবাহিকতাতেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একজন খুনির ইন্টারভিউ নিতে পাকিস্তানে পৌঁছে যান জিল্লুর রহমান।
কী অবাক হচ্ছেন? বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার আব্দুর রশিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার মতো কোনো বিশেষ কারণ বা ইস্যুও ছিল না তখন। কিন্তু ভারত বিদ্বেষ, বঙ্গবন্ধু বিরোধী অপপ্রচার এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য একটা মুখ প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় এবং বিএনপি-জামায়াত শীর্ষ নেতাদের যোগসাজসে খুনি রশিদকে সেই মুখ হিসেবে টেলিভিশনে উপস্থাপন করেন চতুর জিল্লুর রহমান।
কিন্তু কীভাবে সেটা? এই প্রশ্নটাই তো সবার। একজন পলাতক ফেরারি খুনিকে কারা-কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলো? তার মুখ দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে কথা বলালো টেলিভিশন পর্দায়?
একজন সচেতন মানুষের মনে এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায়।
তাহলে শুনুন, বিএনপি-জামায়াতের অনুরোধে খুনি রশিদের সাথে সঞ্চালক জিল্লুর রহমানের পাকিস্তানে দেখা করা এবং অনুষ্ঠান রেকর্ড করার ব্যবস্থা করে দেয় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা। চারপাশে তৃতীয় মাত্রার লোগো এবং ছবি বসিয়ে স্থানটিকে চ্যানেল আইয়ের স্টুডিয়োর মতো করে সাজানো হয়। এরপর এজেন্ডা অনুসারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিএনপি-জামায়াতের মুখে ঘুরে বেড়ানো পুরনো কথাগুলোই প্রশ্ন হিসেবে করতে শুরু করেন জিল্লুর রহমান।
খুনি রশিদকে তিনি বলেন- যুদ্ধটা নয় মাসে শেষ হলো, মুক্তিযুদ্ধ, খুব স্বল্প সময়ে শেষ হলো। এখানে ভারতের ভূমিকা কী ভূমিকা ছিল? পাকিস্তান যে ভারতীয় একজন জেনারেলের কাছে আত্মসমর্পণ করলো, সেখানে আমাদের সেনাপতি ছিলেন না। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
জিল্লুরের সাথে তাল মিলিয়ে ভারত-বিদ্বেষী সেই পুরনো কথাগুলোই তোতাপাখির মতো বলতে থাকে খুনি রশিদ। মুক্তিযুদ্ধের পরপর জামায়াত এবং রাজাকাররাও একইভাবে ভারত-বিদ্বেষ ছড়িয়ে কিছু মানুষকে বিপদগামী করে তুলেছিল এবং প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা ছড়ানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরাধের বিচার, প্রভৃতি বিষয়ে টুইস্টেট কিছু অর্ধ সত্যকে সত্যের মতো করে প্রোপাগান্ডা হিসেবে ছড়িয়ে দিতো জামায়াত। পরবর্তীতে বিএনপিও একই পন্থা অবলম্বন করে।
[তৃতীয় মাত্রার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুর রশিদ: ভারত-বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকে জায়েজ করার ঘৃণ্য চেষ্টা!]
কথার একপর্যায়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ তোলেন তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমান। তিনি খুনি রশিদকে বলেন- মুক্তিযুদ্ধের পরে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, যারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন তাদের ক্ষমা করে দেওয়া বা যুদ্ধাপরাধী ছিলেন তাদের বিষয়ে তৎকালীন সরকারের যে সিদ্ধান্ত, এবং আজকেও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা হচ্ছে। এই ঘটনাগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এমনকি সত্যের মতো করে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে তিনি আরো বলেন- বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, আপনি কি মনে করেন- দ্যাট ওয়াজ রাইট ডিসিশন? জবাবে রশিদ জানায়- ইয়েস, হি ওয়াজ রাইট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে খুনি রশিদ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে বলে যে- এই ইস্যুটা.. বাংলাদেশের জনগণের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হবে না! এটা তো আগেই ক্ষমা হয়ে গেছে। এটা নিয়ে নতুন করে বিচারের প্রসঙ্গ তোলা ঠিক নয়।
এভাবেই পাকিস্তানের মাটিতে বসে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয় তৃতীয় মাত্রার ওই টকশোর মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে খাটো করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কিছু অর্ধসত্য আলোচনা করানোর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে জায়েজ করার সর্বোচ্চ অপচেষ্টা করা হয় সেই অনুষ্ঠানে। এরপর ফলাও করে সম্প্রচার করা হয়, যাতে ইতিহাস কম জানা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি থেকে মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। মানুষকে বিভ্রান্ত করা জন্য গণমাধ্যম এজেন্ডা সেট করে সমাজে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়, কিন্তু তা যদি আপনার দেশ-জাতির জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে সেইসব গণমাধ্যম ব্যক্তিদের থেকে সতর্ক থাকুন!
আরও পড়ুনঃ
- রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা; বঙ্গবন্ধু করেছিলেন বন্দি, জিয়া করেছিলেন অবমুক্ত
- ইতিহাসঃ জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ বলে সাব্যস্ত করেছিলেন মির্জা ফখরুল
- ইতিহাস: মির্জা ফখরুলের বাবা দালাল আইনে আটক চখা রাজাকারকে মুক্ত করেছিলেন জিয়া