
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের গুজবসেল কর্তৃক ছড়ানো মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত দেশের মানুষ। দেশের রিজার্ভ শেষ হয়ে যাচ্ছে, দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে- এমন অযৌক্তিক চিন্তায় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেলতে লাইনও ধরেছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন- দেশের রিজার্ভের আসলে পরিস্থিতি কী? রিজার্ভের অর্থ কোথায় যায়?
বৈদেশিক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের মাধ্যমে রিজার্ভ সঞ্চয় তৈরি হয়। তবে রিজার্ভের অর্থ খরচ হয় কীভাবে- এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষের কল্যাণে এবং তাদের ভালো-মন্দের জন্য রিজার্ভের টাকা খরচ হচ্ছে। রিজার্ভের টাকা তো সবসময় খরচ হতে থাকে, রোলিং করে। কারণ করোনাভাইরাসের সময় যোগাযোগ বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ, কেউ যেতেও পারেনা, আসতেও পারে না। কোনো আমদানি হয়নি। এই কারণেই কিন্তু রিজার্ভ জমা হয়। যখন করোনা শেষ হয়ে যায়, আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, ইন্ডাস্ট্রি তৈরির ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এমনকি চাষবাসের জন্য যন্ত্রপাতি কিনে নিয়ে আসা, এ জন্য ডলার খরচ হয়।
আরও পড়ুন: বিএনপির ২০০১ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ২০ ভাগই পূরণ করতে পারেনি
আমরা যে ভ্যাক্সিন কিনেছি, ভ্যাক্সিন নিয়ে যখন রিসার্চ হচ্ছিল, তখনি আমি ১২০০ কোটি টাকা জমা দিয়ে দিয়েছি, যাতে যেটাই সফল হয়, আমি আগে নেবো। আমার দেশের মানুষকে বাঁচাবো।‘ তবে ’শুধু ভ্যাক্সিন নিলেই তো হয় না। ভ্যাক্সিন দিতে সিরিঞ্জ লাগে, অনেক কিছুই লাগে। প্রয়োজনে প্লেন পাঠিয়ে পাঠিয়ে বিদেশ থেকে আমি জিনিসপত্র আনিয়েছি। তাতে টাকা খরচ হয়নি? টাকা তো খরচ করতে হয়েছে। এই টাকা ব্যবহার করেছি মানুষের কল্যাণে। করোনা যেতে না যেতে শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তারপর স্যাংশন। সব জিনিসের দাম সারা বিশ্বে বেড়ে গেছে। চাল, গম, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, গ্যাস – সব কিছু এমনভাবে বেড়েছে – শুধু জিনিসের দাম যে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে তা নয়, তার সঙ্গে পরিবহন খরচও বেড়েছে। ’২০০ ডলারে যে গম কিনতাম, সেটা ৫০০ ডলার। কিন্তু আমরা তো দেশের মানুষকে কষ্ট দিতে পারি না। সেই কারণে যত দামই লাগুক, আমরা কিনে নিয়ে আসছি, মানুষকে দিচ্ছি। ১ কোটি মানুষকে আমরা টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে খাবার সরবরাহ করছি।
রিজার্ভ থেকে কয়েকটি খাতে ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, আমরা ৮ বিলিয়ন ডলার আলাদাভাবে বিনিয়োগ করেছি। আমাদের বিমানের সব ঝরঝরে অবস্থা ছিল। সব থেকে আধুনিক বিমান আমরা ক্রয় করেছি কয়েকটা। এখানে আমরা আমাদের টাকা, রিজার্ভের টাকা দিয়েই করেছি। অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার নেইনি। সেখানে টাকা নিলেও সুদসহ শোধ দিতে হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়ে, এখন বিমান টাকা শোধ দিচ্ছে, ২ পার্সেন্ট ইন্টারেস্টসহ আমরা টাকা ফেরত পাচ্ছি। রপ্তানিতে প্রণোদনা দিচ্ছি, সেখানেও আমাদের লোকরাই লাভবান হচ্ছে। এভাবে ৮ বিলিয়ন আমরা খরচ করেছি। এখন যেমন অতি মূল্য দিয়ে খাদ্য কিনতে হচ্ছে, তেল-গ্যাস, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে, গম ভুট্টা-সবই আনতে হচ্ছে। এখানে আমি টাকা নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। আমার দেশের মানুষের জন্য খরচ করতে হবে। রিজার্ভ ব্যয় হয় এসব আমদানিতেও। পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজেও রিজার্ভের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
তিনি বলেন, রিজার্ভের টাকায় আমরা বিমান ক্রয় করেছি। নদী ড্রেজিংও আমরা রিজার্ভের টাকা দিয়ে করছি। কিছু কিছু বিনিয়োগ করছি এই কারণে, আমরা যদি অন্য দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নেই, সুদসহ সেটা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু আমাদের ডলার আমরা দেই, খরচা করি, তাহলে সুদসহ টাকাটা দেশেই থেকে যায়। সেটা লক্ষ্য করে ৮ বিলিয়নের মতো আমরা খরচা করেছি। এখান থেকে আমরা কিছু ডলার – আপনারা জানেন, যখন শ্রীলঙ্কা খুব অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে, তাদেরকেও কিছু টাকা আমরা ধার দিয়েছি। এখানে কিন্তু কোন পয়সা কেউ তুলে নিয়ে যায়নি। আগামী বছর এই সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো, রেমিট্যান্স বাড়ানো, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, খাদ্য মজুদ করা ও শুল্ক-কর সহজ করার মতো পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মিথ্যাচারের আরেকটি অংশ হলো, দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ‘পাচার’ হয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোতের মত। আসলে কী তাই? এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো, যা গুজবখোর জনতার মাথায় দূরে থাক, দেশের বড় বড় আঁতেলরাও ভাবে না।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পড়ালেখা করতে যান বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের সাথে শিক্ষাখাতে ব্যয়ের তুলনা করলে বিদেশে পড়ালেখার খরচ সমুদ্রসম। দিন দিন বিদেশে শিক্ষার্থীদের যাওয়ার হার বাড়ছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিগত শিক্ষাবর্ষের ১৪তম স্থান থেকে এখন ১৩তম স্থানে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ১০,৫৯৭ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষের ৩,৩১৪ জন থেকে বেড়ে ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ১০,৫৯৭ জন হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৪-১৯৭৫ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৮০ জন।
আরও পড়ুন: বিএনপি’র রাজনীতি না করার দরুণ অকারণে চাকরি হারাতেন পেশাজীবীরা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করতে যায় যারা, তাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেখানকার পড়ালেখা এবং থাকা-খাওয়ার খরচ বছরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার মত। বিশেষায়িত কোনো কোর্স হলে এই খরচ আরও অন্তত ৩-৪ গুণ বেশি হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশে পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে ব্যাংকে অন্তত ৩০-৪০ লাখ টাকা বা আরও বেশি পরিমাণ অর্থ জমা রাখার বিধান রয়েছে ভর্তির শর্ত অনুসারে। শিক্ষার্থী বিদেশে যদি তার শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংকুলান করতে না পারে সেখানে পার্টটাইম চাকরি করার মাধ্যমে, তবে যাবতীয় খরচ দেশ থেকেই ডলার আকারে বিদেশে পাঠাতে হয়।
[ফ্যাক্ট জানুন: কোথায় যায় বাংলাদেশের রিজার্ভের এত টাকা? কীভাবে যায়? কারা নিয়ে যায়?]
সাধারণত ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা এমন কোনো বড় কাজ করার সুযোগ পায় না, যাতে তার পড়ালেখার খরচ পুরোটাই নির্বাহ করতে পারে। তাছাড়া এসব দেশে চাকরির বাজারও অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। ফলে প্রায় পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাঠাতে হয়। এভাবে দেশ থেকে প্রতি মাসেই বিপুল ডলার চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
বিএনপি-জামায়াতের গুজবসেল-এর গান্ডুদের পরিবেশিত গুজব গলাধকরণ করার আগে নিজের মস্তিষ্কটাকে খাটানো জরুরি।
আরও পড়ুন:
- রিজার্ভ সংকটের অপচেষ্টা মূল হোতা বিএনপির ডোনার হুন্ডি ব্যবসায়ী সোনা আবু
- দেশের সংকট নিয়ে যে দল কথায় কথায় দেশকে শ্রীলঙ্কা বানাতে চায় সে দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণের বড় প্রশ্ন আসে
- বিএনপি আমলে নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য রাজপথে নেমেছে সাধারণ মানুষ