রিজার্ভ

বাংলাদেশের সাফল্যের মুকুটে একটি গর্ব হচ্ছে শক্তিশালী রিজার্ভ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই রিজার্ভ নিয়ে শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্র। বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের বিনিময়ে ডলারের সঞ্চয় থেকেই তিলে তিলে গড়ে ওঠে এই রিজার্ভ। প্রবাসীদের হাড়ভাঙা খাটুনির অর্থ যখন বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়, সেটা আসে মার্কিন ডলারে। প্রবাসীর স্বজনরা বাংলাদেশি মুদ্রায় সেই অর্থ তুলে নেন ব্যাংক থেকে। ডলারটা চলে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারিতে। এটাই হচ্ছে রিজার্ভের ভিত।

অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ দেশবিরোধী গোষ্ঠী প্রবাসীদের মাথায় বিষ ঢোকাচ্ছে, তাদেরকে বলা হচ্ছে সরকার নাকি তাদের অর্থ ‘লোপাট’ করে দিচ্ছে! বিএনপি-জামায়াতপন্থী প্রবাসী শ্রমিকরা মাথা খাটিয়ে এটা ভাবে না যে, তাদের পাঠানো টাকা তো স্বজনরা পাচ্ছেই, তবে সরকার ‘লোপাট’ করছে কী? পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, কনক সরওয়ারসহ বিএনপি-জামায়াতের গুজবসেল ইউটিউবাররা নিজেদের স্বার্থে প্রবাসীদের হালাল উপার্জনকে ‘কালো টাকায়’ পরিণত করছে। প্রবাসীরা মিথ্যা প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে বৈধ পথে অর্থ না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে হুমকিতে ফেলতে এই মিথ্যা প্ররোচনা দিয়ে প্রবাসীদের হালাল উপার্জনকে হারামে পরিণত করছেন। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দেশের ক্ষতি করতে বিএনপি-জামায়াত চক্র এই ষড়যন্ত্র করছে অনেকদিন ধরেই। যার ফলশ্রুতিতে অনেকদিন ধরেই গড়ে উঠেছে একটি হুন্ডি ব্যবসায়ী চক্র। এই চক্রটি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের কারবার করছে। চক্রটির নেটওয়ার্ক দেশের প্রতিটি অলিতে-গলিতে পৌঁছে গেছে। সাধারণ মুদি দোকান বা ছোটখাট মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ… ইত্যাদি) সেবাদাতা দোকান খুলে সেই ব্যবসার আড়ালে করছে হুন্ডির ব্যবসা। ছোটখাট দোকানী হওয়ায় সহজেই লোকচক্ষুর আড়ালে চক্রটি কাজ করছে। গত কয়েক বছর ধরে সরকারের কঠোর নজরদারিতে অনেক হুন্ডি ব্যবসায়ী আটক হয়েছে, পুলিশের জালে আটকা পড়েছে অনেক কারবারি। এরমধ্যে একজন আবু আহমেদ ওরফে গোল্ড আবু ওরফে হুন্ডি আবু ওরফে সোনা আবু। চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী বিএনপির অন্যতম বড় একজন অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত।

একসময় রাস্তায় ঝালমুড়ি আর পান-সিগারেট বিক্রি করতেন আবু। পরে জড়িয়ে পড়েন হুন্ডি ব্যবসায়। টাকা পাচার করতে করতে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে, হয়ে যান টাকার কুমির। আবু আহমেদ থেকে তিনি হয়ে যান ‘সোনা আবু’। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তার বিরুদ্ধে করা হয় মানি লন্ডারিং মামলা। সেই মামলায় তার জামিন বাতিল করেছেন আদালত। একইসঙ্গে জারি করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। রোববার (১৩ই নভেম্বর) চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঁঞার আদালত শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। চলতি বছরের ৭ই ফেব্রুয়ারি আবুকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া তার বিদেশযাত্রায়ও দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।

[রিজার্ভ সংকটের অপচেষ্টা মূল হোতা বিএনপির ডোনার হুন্ডি ব্যবসায়ী সোনা আবু]

জানা গেছে, হুন্ডি ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালানের অন্যতম গডফাদার চট্টগ্রামের আবু আহমেদের ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সম্পদের খোঁজ পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এ নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে আদালতে। স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় অভিযুক্ত আবু আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তার অবৈধ অর্থের খোঁজ পায়। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত মোট ২১ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি।

স্থায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফতেপুর গ্রামের ফয়েজ আহমেদ ওরফে বলি সওদাগরের ছেলে আবু দেশের চোরাচালান সাম্রাজ্যে রীতিমতো কিংবদন্তী। চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক হুন্ডি ও স্বর্ণ ব্যবসার অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত তিনি। এলাকায় তিনি গোল্ড আবু, হুন্ডি আবু বা সোনা আবু নামে পরিচিত। মূলত স্বর্ণ চোরাচালানের সহযোগী ব্যবসা হিসেবে হুন্ডি ব্যবসা করেন তিনি। রাস্তায় ঝালমুড়ি, পান-সিগারেট বেচার পর ফটিকছড়ির তৌকিরহাট এলাকায় মুড়ি ব্যবসা ধরেন আবু। পরে চট্টগ্রাম শহরে এসে জুতার ব্যবসাও করেন। পরবর্তীতে হুন্ডি, স্বর্ণ ও কাপড় চোরাকারবারির মাধ্যমে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রামের বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে সুপরিচিত রিয়াজউদ্দিন বাজার কেন্দ্রিক হুন্ডির কারবারের পুরো নিয়ন্ত্রণ তার হাতে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে উত্থান সোনা আবুর। নির্বিঘ্নে হুন্ডির ব্যবসা আর সোনা চোরাচালান চালিয়ে যেতে ফটিকছড়ি বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত হন। তারেক রহমানের বিশেষ আনুকূল্য আছে তার ওপর, তারেকের প্রভাব দেখিয়ে বিএনপি-জামায়াত আমলে রীতিমত রাজত্ব গড়ে তুলেছেন আবু। উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার, গত সংসদ নির্বাচনে ফটিকছড়ি আসনে বিএনপির প্রার্থী আজিম উল্লাহ বাহার, উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সারোয়ার আলমগীরসহ প্রভাবশালী নেতাদের সাথে আবুর ওঠা-বসা। বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থায়ন করে আসছেন তিনি। লন্ডন পর্যন্ত তার টাকার ভাগ পৌঁছে যায়। বিএনপি-জামায়াতের গুজবসেল এর অপপ্রচারে বিভ্রান্ত চট্টগ্রামের লোকজন আবুর মাধ্যমেই হুন্ডিতে লেনদেন করেন।

হুন্ডি আবুর ইতিহাস জানা যাক।

উত্থান এবং সরকারি খাতায় নাম ওঠে যেভাবেঃ

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় বসে যে বছর, সে বছরই শ্রমিক ভিসা নিয়ে দুবাই যান আবু। এর কয়েকবছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে তিনি আরব আমিরাত আর বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। সোনা চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসায় তাকে ‘গডফাদার’ হিসেবে গোণা হয়। বিএনপির আমল থেকেই স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়া আবু হুন্ডিসহ চোরাই মালের ব্যবসায়ও করিৎকর্মা। কিন্তু সবসময় তার নাম আড়ালেই থেকে গেছে। পত্র-পত্রিকায় তার নাম যেন না আসে, সেজন্য সবসময় কৌশলে গা ঢাকা দিয়ে চলেছেন।

২০১৩ সালের ৩রা আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর হিলভিউ আবাসিক এলাকার বাসার সামনে থেকে হঠাৎ অপহৃত হন আবু। তখনই প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ওঠে আসে আবু নামের রহস্যময় এক বিত্তশালীর নাম। প্রায় ১০ বছর আগের সেই অপহরণের ঘটনায় আবু ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান অজ্ঞাত একদল দুর্বৃত্তের হাত থেকে। তবে স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার হিসেবে তার নাম প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে। সেসময় ঢাকায় চোরাচালানের স্বর্ণ উদ্ধারের পর পর ৩টি ঘটনায় দৃশ্যপটে চলে আসেন আবু। এরমধ্যে ১০৫ কেজি ওজনের ৯০৪ পিস স্বর্ণের প্রথম চালান ধরা পড়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে। পরে একই বিমানবন্দরে ৫২৫ পিস সোনার বারসহ ধরা পড়ে বিপুল পরিমাণ সৌদি মুদ্রার অপর একটি চালান। ৬১ কেজি স্বর্ণ আরেকটি চালান ধরা পড়ে নয়াপল্টন থেকে। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ২৫শে জানুয়ারি চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট থেকে তৎকালীন নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে উদ্ধার করা হয় ৩ সিন্দুকভর্তি বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও নগদ টাকা। এর মধ্যে একটি সিন্দুক থেকে ২৫০টি স্বর্ণের বার এবং অপর সিন্দুকে পাওয়া যায় নগদ ৬০ লাখ টাকা। এই ঘটনায় আবু ও তার ম্যানেজার নাঈমকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা হয়। সেই মামলায় আবু গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু নাটকীয় কায়দায় মাত্র ৫ মাসেই কারাগার থেকে বের হয়ে যান আবু।

জানা যায়, গ্রেপ্তারের পর কিছুদিনের মধ্যেই হাইকোর্টের দুই বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার কার্যক্রম স্থগিত বিষয়ে একটি পিটিশন তৈরি করান আবু। ২০১৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি মিস শাখার মাধ্যমে সেই পিটিশনটি বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ভুয়া স্থগিতাদেশ তৈরি করে তথ্য গোপনের মাধ্যমে জামিন নিয়ে ওই বছরের আগস্টে তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে গা ঢাকা দেন। জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পর ২০১৬ সালের ২০শে নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাদি হয়ে শাহবাগ থানায় আবুসহ কয়েকজনের নামে মামলা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক

আবুর এত বিপুল সম্পদের নেপথ্যেঃ

সিআইডি জানিয়েছে, রিয়াজউদ্দীন বাজারের প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসাই আবুর একমাত্র বৈধ আয়ের উৎস। এর বাইরে দৃশ্যত তার আর কোনো ব্যবসা নেই। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, আবুর নেতৃত্বাধীন একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল টাকা আয় করেছে— যা মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে পড়ে। চক্রটি ব্যাংকের মাধ্যমেই শুধু শত শত কোটি টাকা লেনদেন করেছে। ফরহাদ ট্রেডিং, রিয়াল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রুপা টেলিকমিউনিকেশন, রিয়েল ট্রেডিং, এমএস ওয়ার্ল্ড সেন্টার, ফরহাদ ট্রেডিং, এবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেন আবু। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে বিভিন্নস্থান থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ফার্নিচার ব্যবসা, অটোমোবাইল, স্পাইস, গ্লাস, মোবাইলফোন এবং কয়লা ব্যবসার ভাউচার দিয়ে লেনদেন করে। অথচ সরেজমিন তদন্তে সিআইডি কর্মকর্তারা ফরহাদ ট্রেডিং ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফিজিক্যাল অস্তিত্ব পাননি।

আবুর দৃশ্যমান সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ফটিকছড়ির ধর্মপুর ও জাহানপুর এলাকায় ২৪টি দলিলমূলে কেনা বহু জমি। এছাড়া কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর প্লটে ১৬ কাঠার প্লট ছাড়াও পাঁচলাইশ হিলভিউ আবাসিকে পাঁচতলা ভবন এবং চান্দগাঁওয়ে ছয়তলা বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক বাড়ি রয়েছে তার। অন্যদিকে রাউজানের ফতেহনগর এলাকায় পল্লী কানন ও পল্লী শোভা কনভেনশন হল, ফটিকছড়ির ফতেহপুরে দৃষ্টিনন্দন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনতলা বাড়ি জাহানারা ম্যানশন, চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে দুটি, স্যানমার ওশান সিটিতে একটি দোকান ছাড়াও দুবাইয়ে অন্তত ৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলেছে।

তবে তার নিকটজনরা বলছেন, আবুর সম্পদের এই হিসাব সামান্যই। নিজের নামে ছাড়াও সহযোগীদের নামেও তিনি গড়েছেন সম্পদ। বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে তাদের মাধ্যমেও। যেমন আবুর ম্যানেজার নাঈমের নামে চট্টগ্রামে আবু গড়ে তুলেছেন অন্তত ৬টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

গত বছরের একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আবু চট্টগ্রামের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ব্র্যাক, যমুনা, ইসলামী ও দি সিটি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলেন ২০০৩-২০০৫ সালের মধ্যে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ওইসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৬৭ টাকা জমা হয়। বিপুল এই টাকার বৈধ কোনো উৎস তিনি দেখাতে পারেননি।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াড প্রায় ২ বছর অনুসন্ধান চালিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে আবু ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ১৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪০৯ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। সর্বশেষ ২ বছর আগে আবুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে জমা ছিল ২০৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর উত্তোলোন করা হয়েছে ২৪০ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০০৫ সালের ৩রা এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত নথিপত্র ঘেঁটে অন্তত আড়াইশ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। নগরীর স্টেশন রোড স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শাখার ৯টি অ্যাকাউন্ট, সিটি ব্যাংক জুবলী রোড শাখার ৪টি অ্যাকাউন্ট, যমুনা ব্যাংক জুবলি রোড শাখার ৩টি অ্যাকাউন্ট, ব্র্যাক ব্যাংক নিউমার্কেট শাখার ৭টি অ্যাকাউন্ট এবং ইস্টার্ন ব্যাংক নিউমার্কেট শাখার একটি অ্যাকাউন্ট সিআইডির আবেদনে স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত।

আবু ও তার কর্মচারীসহ ১৯ সহযোগীর বিরুদ্ধে ২৪০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে সিআইডি ২০২০ সালের ১৮ই মার্চ চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। যাদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। এদের মামলাগুলোও পরিচালনা করা হচ্ছে আবুর খরচে। আবুর বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলতে রাজি না। এই আনুগত্যের কারণে আবু তার সহযোগীদেরও খেয়াল রাখেন। ফটিকছড়িরর জাহানপুরের সাবেক ছাত্রদল নেতা নাঈম আবুর চোরাচালান সাম্রাজ্যের প্রধান সহযোগী। তার নামে চট্টগ্রামে আবু গড়ে তুলেছেন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে ফরহাদ ট্রেডিং, এমএস ওয়ার্ল্ড সেন্টার, রিয়েল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রুপা টেলিকমিউনিকেশন ও এবি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল।

[রিজার্ভ সংকটের অপচেষ্টা মূল হোতা বিএনপির ডোনার হুন্ডি ব্যবসায়ী সোনা আবু]

সিআইডির তদন্তে দেখা গেছে, চোরাচালান ও হুন্ডির কারবারে আবুর সহযোগী ফটিকছড়ির ফতেহপুরের শিবির নেতা ইকবাল আহমেদ ওরফে নিজামের ৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক যুগে জমা হয়েছে ৫২ কোটি ৪৯ লাখ ৫৭ হাজার ২০৭ টাকা। জাফরনগরের যুবদল কর্মী আবু রাশেদের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জমা হয়েছে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিদেশেও নিয়ে গেছেন এই রাশেদ। এ কাজে তিনি তার কর্মচারী হাবিবুর রহমান, মায়নুল হাসান রবি, সোলাইমান, পারভেজ মিয়া, সাহাবুদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, আবদুর রহিমকে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাদের মাধ্যমেই রাশেদ বিদেশে পাচার করেছেন ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আবুর আরেক সহযোগী আসিফুর রহমানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গত এক যুগে জমা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। একইভাবে চোরাচালান চক্রের সদস্য ফটিকছড়ির দক্ষিণ রোসাংগিরির ওবায়দুল আকবরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ফতেহপুরের রফিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০ লাখ ৯০ হাজার টাকা, জাহানপুরের জিয়াউদ্দিন বাবলুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ টাকা, চন্দনাইশের হাশিমপুরের ইমরানুল হক কফিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা এমতিয়াজ হোসেনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।

হুন্ডি কেন জনপ্রিয়ঃ

হুন্ডির লেনদেনকারী ইকবাল (ছদ্মনাম) জানান, এই ব্যবসা মূলত বিশ্বাসের ওপর। বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা লাখ লাখ টাকা গ্রাহককে পৌঁছে দিই। এখন আধুনিক যুগ। সবকিছু হাতের নাগালে। ব্যাংকে গিয়ে লাইন ধরে টাকা উত্তোলন অনেকে বিরক্তিবোধ করেন। এজন্য এটা একটি সহজ মাধ্যম। বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর বিষয়টি জানালে আমাদের এজেন্টের হাতে প্রবাসীর টাকা পৌঁছানোর আগেই শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপরেই আমরা গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসি। ব্যাংকে যেতে হয় না, আমাদেরকে এক্সট্রা চার্জ দিতে হয় না। ডলার রেটের একটা হিসাব করে আমরা টাকা দিয়ে দিই।

ব্যাংক কর্মকর্তা সৌভিক বড়ুয়া রনি জানান, হুন্ডির কারণে গ্রাহক অনেক কমে গেছে। সবকিছু জানার পরেও করার কিছু নেই। তিনি বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো অবৈধ ও ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে আইনি ঝামেলায় পড়তে হবে। বরং ব্যাংক হচ্ছে ঝামেলামুক্ত পদ্ধতি। প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকগুলোতে এখন আলাদা কাউন্টার করা হয়েছে। সেখানে কর্মকর্তারাই সব কিছুর বন্দোবস্ত করে দেন। সরকারি নির্দেশনা অনুসারে কোনো প্রশ্ন করা হয় না, চার্জ কাটা হয় না। উল্টো প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে রেমিট্যান্সের ওপর। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ নিরাপদে স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে ব্যাংকই বৈধ পন্থা। প্রবাসীদের উচিত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের পরিহার করা।

আরও পড়ুনঃ