জিয়ার

সততার উদাহরণ দিতে গিয়ে বিএনপি নেতারা প্রায়ই তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের একটি ভাঙা স্যুটকেস আর ব্যবহৃত ছেঁড়া গেঞ্জির গল্প শোনান। মৃত্যুর পর তিনি নাকি কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রেখে যাননি পরিবারের জন্য। কিন্ত বাস্তবে দেখা যায়, মৃত্যুর আগেই জিয়াউর রহমান বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। সাভার ও দিনাজপুরে জিয়ার নামে ৩২ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া যায়, যা এখনও খালেদা জিয়ার ভোগ-দখলে রয়েছে। জমিগুলোর বর্তমান মালিক খালেদা জিয়া। এছাড়া খালেদা জিয়াকে আরও অনেক কিছুই দিয়েছিল রাষ্ট্র, যা আলোচিত হবে এই নিবন্ধে। অথচ সেসময়ই খালেদা জিয়া দাবি করতেন, তিনি এবং তার পরিবার নিদারুণ অভাব-অনটনে চলেছেন।

সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়ার নাকি কান্না:

১৯৮১ সালের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কথা অনেকেরই মনে থাকবে। ফজলে লোহানী পরিচালিত ‘যদি কিছু মনে না করেন’ নামের একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া তাদের সাদামাটা জীবন-যাপনের কথা বলেছিলেন। জিয়া প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ❛… তিনি (জিয়া) বলতেন আমাদের দেশের লোক তো গরীব। দেশের লোকের অবস্থা যতদিন না পরিবর্তন হবে, ততদিন…. আমি নিজে অত বিলাসিতা পছন্দ করি না। আমার ছেলেদেরও কোনোসময় কোনোরকম বেশি কাপড়-চোপড় সে (জিয়া) পছন্দ করত না। তিনি বলতেন যে বাচ্চাদের এরকমভাবে ইয়ে করা ভালো না, বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যাবে। তারেক এবং কোকো উনার (জিয়া) শার্ট-প্যান্ট ছোট করে পরত…।❜

সেই সাক্ষাৎকারের একটি অংশে তারেক ও কোকোর বক্তব্য ছিল। সেখানে তারা দাবি করেন, তাদের বাবার পোশাক ছোট করে, কেটে দুই সন্তানকে পরতে হয়।

আরও পড়ুনঃ খালেদা জিয়ার বহুল আলোচিত ১০টি অমানবিকতার ইতিহাস

অথচ সেসময় অর্থাৎ জিয়ার মৃত্যুর পর রাষ্ট্র থেকে খালেদা জিয়াকে যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল, তা শোনার পর তাদের এই বক্তব্য মেলানো যায় না। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৬ নম্বর মইনুল রোডের ১৬৮ কাঠা চৌহদ্দির বাড়িটি খালেদা জিয়া কয়েক যুগ ধরে অবৈধভাবে নিজের দখলে রেখেছিলেন। এটি ছিল সেনাবাহিনীর উপ-প্রধানের রাষ্ট্রীয় বাসভবন। আইন অনুসারে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান অর্থাৎ জিয়ার মৃত্যুর পর উক্ত পদে নতুন কর্মকর্তার পাওয়ার কথা বাসভবনটির অ্যালটমেন্ট। তা না করে বাড়িটি মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে এবং বাৎসরিক ১ টাকা খাজনায় ‘লিজ’ দেওয়া হয় খালেদা জিয়াকে।

যদিও সেই আইন ডিঙানো লিজের আদেশ অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাধ্য হয়ে বাড়িটি ছাড়তে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। কিন্তু এই বাড়িটি জীবনের দীর্ঘতম সময় তার দখলে ছিল। ৩৮ বছর ধরে থাকতে থাকতে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন ১৬৮ কাঠার এই বাড়িটি আসলে জনগণের সম্পত্তি। সদ্য স্বামীহারা খালেদাকে তৎকালীন সরকার বাড়িটি দেন মাথা গোঁজার জন্য। একইসাথে তাকে লিজ দেওয়া হয়েছিল গুলশানের ৩২ কাঠার আরেকটি বাড়ি। সেসময়কার শাসকগোষ্ঠী আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধুমাত্র জনগণের আবেগকে পুঁজি করে দু-দুটো বাড়ি বরাদ্দ করেছিল এই পরিবারকে। শুধু তা-ই নয়, সেসময়কার ১০ লাখ টাকা জিয়া পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য ডিপোজিট করে দেওয়া হয়েছিল।

চেরাগের জ্বীন যেভাবে সব বদলে দিলো:

খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের মুখে অভাব-অনটনের কথাগুলো শুনে সেসময় অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন। কিন্তু এর কয়েকবছর পরই জিয়ার ভাঙা স্যুটকেস থেকে বের হলো যাদুর চেরাগ। আর চেরাগে ঘষা দিতেই ভেতর থেকে শক্তিশালী জ্বীন বেরিয়ে আসে। মূলত এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় বসার পরই আসে জিয়া পরিবারে বড় ধরণের পরিবর্তন। খালেদাপুত্র তারেক রহমানের ব্যবসায়িক জীবনের শুরু ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত নৌ পরিবহনের দুটি ব্যবসা ছাড়াও আরো অন্তত ৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

তবে ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে আয় দেখানো হয়। এই আয়ের উৎস কী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারেকের ব্যবসার অংশীদার ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুন। ১৯৯৪ সালে মামুনের ছদ্মনামে শিল্প ঋণ সংস্থার প্রতিষ্ঠিত নামমাত্র ১৬ কোটি টাকা মূল্যে তাজ ডিস্টিলারিজ ক্রয় করেন তারেক। এতে রাষ্ট্রের ১১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এভাবেই শুরু হয় জিয়া পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের উত্থান। একে দশটি লঞ্চ, ১১-১২টি টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে লোকসান দেখিয়ে নিলামে বিক্রি করা হয় অনেক কোম্পানি। সেসব কোম্পানি বেনামে কিনে নেয় জিয়া পরিবার।

খালেদা জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার ও পুত্র তারেক গড়ে তোলেন অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। রহমান শিপার্স থেকে ক্রমে প্রতিষ্ঠা হতে থাকে রহমান গ্রুপ, ওয়ান গ্রুপ, রহমান নেভিগেশন, চ্যানেল ওয়ান, ডান্ডি ডায়িং, ইউনিটেক্স এ্যাপারেলস, ক্রিমেন্টাইন লিমিটেড, ক্রোনোটেক্স লিমিটেড, তুরাগ ফিশারিজ, তাজ ডিস্টিলারিজ, দৈনিক দিনকালসহ নামে-বেনামে নানা প্রতিষ্ঠান।

জ্বীনের অপকর্মের দায় কেন নেবে জিয়া পরিবার:

দিনের আলোর মত সব কিছুর সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা আজও দাবি করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নিষ্পাপ। তাদের নাম ভাঙিয়ে নাকি একশ্রেণির লোকজন দুর্নীতি ও অপকর্ম করেছে। যদিও ‘একশ্রেণির’ বলে উড়িয়ে দিলেও এটা সেই চেরাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জ্বীনের কারবার ছিল নিশ্চয়, নইলে জিয়া পরিবারের অপকর্মের প্রমাণ থাকলেও স্বীকার করে না কেন তারা? জ্বীনের দৌরাত্মে কতটা ক্ষতি হয়েছিল জানেন? খালেদা জিয়া ও তার চেলাচামুণ্ডরা ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ৪ বছরে কমপক্ষে ১ লক্ষ ৯৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ জনসম্পদ লুট করে। দুর্নীতিবাজ নেতৃত্ব ও লুটেরাগোষ্ঠী দেশ থেকে হুণ্ডি, ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং এবং কার্ববাজার থেকে নগদে ১.৫ বিলিয়ন ডলার তুলে নিয়ে দেশের বাইরে পাচার করেছিল। [সূত্র: জোট সরকারের অর্থনৈতিক অথর্বতা, দৈনিক জনকণ্ঠ]

বিলাসের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না:

রাষ্ট্রীয় আইনের তোয়াক্কা না করে যে সরকারি বাড়িটি দীর্ঘদিন জবরদখল করে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া, সেই বাড়িটি ছিল তার নিজের মুখে দারিদ্রতার গল্পের বিপরীতে এক জ্বলজ্যান্ত উপহাস। ১৬৮ কাঠা জমিতে নির্মিত ৬ মইনুল রোডের এই বাড়িটি বৃক্ষছায়াপূর্ণ এক শান্তিপুর যেন। চারদিকে খোলা জায়গা, কার পার্কিং, সুইমিং পুল, পাথরের ল্যান্ডস্কেপিং, সীমানায় সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ এস্কান্দারের বাড়ি, প্রশস্ত লনসহ নানা আয়োজন দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ঢাকা শহরে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটির বেশি [বিএনপি আমলে]।

আরও পড়ুনঃ জিয়া পরিবার থেকে বের হতে চায় বিএনপি

অথচ এই বাড়িটি থেকে বছরের পর বছর পরিচালিত হয়েছে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। সেনানিবাসের স্পর্শকাতরতার কথা বাদ দিলেও এই প্রাচুর্য আর ভোগ-বিলাসই বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তার ছেলেদের মন ও মনন থেকে মুছে দিয়েছে দারিদ্রক্লিষ্ট জনতার কথা। এই বাড়ির লনেই ফারুক-রশিদের প্রস্তাব (১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা) নীরবে সমর্থন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এরপর ফারুক-রশিদকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পদোন্নতি পেয়েছিলেন তারা জিয়ার বদান্যতায়। রাষ্ট্রদূত হয়েছেন এবং সংসদ সদস্যও হয়েছেন, খালেদা জিয়ার অনুগ্রহও পেয়েছেন।

খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে বাধ্য হয়ে বাড়িটি ছাড়ার সময় দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা সেখানে প্রবেশ করেন। দেখেন, ৬ ইঞ্চি পুরু দামি কার্পেটে মোড়ানো বিলাসবহুল একটি কক্ষ। কর্মচারীরা বলেন, এটি খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ। তার বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে থাকার কথা ছিল কোনো সুস্থধারার বইপত্র, কিন্তু সেখানে পাওয়া যায় বেশ কিছু বিদেশি পর্ন ম্যাগাজিন। শয়নকক্ষ সংলগ্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল স্নানাগার। সেখানে থাকা ফ্রিজে পাওয়া যায় দামী বিদেশি মদসহ কিছু ‘উত্তেজক’ খাবার। স্নানাগারে ফ্রিজ- দেখেই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল সাংবাদিকদের।

একটি পরিবারের স্বচ্ছল জীবন-যাপনের জন্য কতটা বিত্তের প্রয়োজন? একটি বাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কতটি এসির প্রয়োজন? কিংবা সর্বসাকুল্যে দশজন মানুষের জন্য কতজন দাস-দাসীর প্রয়োজন? এটা কোনো গবেষণার বিষয় নয়। কিন্তু মইনুল রোডের এই বাড়িতে এসে সাংবাদিকদের ভুল ভেঙে যায়। এখানে এসির সংখ্যা ৬১টি, সোফাসেট ১০৪টি, টেলিভিশন ১৭টি, ফ্রিজ ১৭টি আর পরিচারকের সংখ্যা ছিল ৬৭ জন! হায়, সরল জীবন-যাপনের চিত্র জিয়া পরিবারের! যে দেশে রাজধানীতেই প্রায় তখন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন ছিল সেই গরিব রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবন-যাপন ছিল সম্রাজ্ঞীর মতো।

১৬৮ কাঠার এই বাড়িটিতে কক্ষের সংখ্যা ২২টি। এই বাড়ির এসব কক্ষ থেকেই কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজের পরামর্শে জিয়া ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের রাজনীতিতে এনেছিলেন। ঘৃণ্য ও সন্ত্রাসী হিসাবে আদালতের স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা সেই খুনিরা পদোন্নতি পেয়েছে, রাষ্ট্রদূত হয়েছে এমনকি সংসদ সদস্যও হয়েছে এ বাড়িতে বসে তৈরি করা ছক অনুসারে। বিএনপি ও জামায়াত তাদের দলের নামের সাথে ‘বাংলাদেশ’ লাগালেও কখনই বাঙালি মনের গহীনে জায়গা করে নিতে পারেনি।

[জিয়ার ভাঙা স্যুটকেস থেকে যাদুর চেরাগের জ্বীন বেরোনোর আগ পর্যন্ত কেমন ছিল তার পরিবার?]

বাড়িটির ভেতরে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল অনেকগুলো ড্রইংরুম, কনফারেন্স রুম, প্রশস্ত বারান্দাসহ বিলাসী পণ্যের সমাহার। কিন্ত অবাক করা ব্যাপার হলো, বাড়িটির কোথাও নেই জিয়াউর রহমানের স্মৃতিস্বরূপ কোনো ছবি। অথচ যাকে ঘিরে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতির অবকাঠামো; যার নামে সততার গালগল্প রচনা করে বিএনপি। এটাই হলো তাদের মুখোশের আড়ালে আসল চেহারা।

 

আরও পড়ুনঃ