ভারত

গত এক দশকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বারবার দেখা করার তদবির করেও তাদের সাক্ষাৎ পায়নি বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। নিজ দেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার, সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশকে অস্থিশীল করা, মনবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা- প্রভৃতি কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে ভারত। একারণেই এখন কথায় কথায় ভারতবিদ্বেষী অপপ্রচার ছড়াতে শুরু করেছে এই চক্রটি। অথচ বিএনপি-জামায়াত এর আগে কতোভাবে ভারতের মন পাওয়ার চেষ্টা করেছে, সেই ঘটনাগুলো কী আপনারা ভুলে গেছেন? ২০১৪ সালের পত্রিকাগুলো খুলে দেখুন। অবাক হয়ে যাবেন। কারণ, ওই সময় ভারতের নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করলেও বাংলাদেশে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে পল্টনে বিএনপির পার্টি অফিসে!

আরও পড়ুন: মোদিকে জামায়াতের অভিনন্দন

অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনা সত্য। ২০১৪ সালে ভারতের নির্বাচনে জয়ী হয় বিজেপি। আনুষ্ঠানিক সরকারmodi গঠনের আগেই সবধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে (১৭ মে) নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে আগাম শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে খালেদা জিয়ার অভিনন্দনপত্র নিয়ে উপস্থিত হন চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান। এরপর দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বিজেপিকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন, তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা করতালির মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। পরে বিকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও নেতা-কর্মীদের ভারতের নির্বাচনের ফল নিয়ে উত্ফুল্ল দেখা গেছে। এমনকি দলীয় কার্যালয়ে কেক কেটে মিষ্টি বিতরণও করেছেন বিএনপি নেতানেত্রীরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেই সংবাদ ফলাও করে প্রচারও হয়েছে।

পরবর্তীতে ডয়েচে ভেলের এক অনুষ্ঠানে সঞ্চালক খালেদ মহিউদ্দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিনা ফারহানার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান- বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে এই ধারণা কেনো হলো বিএনপির? পার্টি অফিসে মিষ্টি বিতরণের কারণ কী! এর কোনো জবাব দিতে পারেনি রুমিন ফারহানা। তিনি বারবার প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।

আরও পড়ুন: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

এরপর  ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেবার কোনো ভারব-বিরোধী কর্মসূচি বা স্লোগান দেয়নি বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত কেউই! উল্টো লম্বা লাইন দিয়ে তারা দেখা করেছেন মোদীর সাথে। যদিও কয়কেদিন পরেই ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করে যে, সেদিন ঢাকার সোনারগাঁ হোটেলে মূলত বাংলাদেশের সরকারের নামে মোদীর কাছে বিচার দিতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নালিশ শুনে খুবই বিব্রত হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এরপর জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে খালেদা জিয়াকে তিনটি প্রশ্ন করেন তিনি, যেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি খালেদা জিয়া। এরপর থেকে মোদী আর কখনোই দেখা করেনি বিএনপি-জামায়াতের সাথে।

বিএনপি ভেবেছিল, ভারতের ক্ষমতা থেকে ‘কংগ্রেস’ পরিবর্তন হয়ে ‘বিজেপি’ সরকার গঠনের পর তারা বাংলাদেশের সরকারকে বদলে দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কারণ নিজেদের শাসনামলে সামাজিক নৈরাজ্য, লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বোমা হামলা, বিরোধীদলীয় কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে হত্যার মাধ্যমে মানুষের মন থেকে বিতাড়িত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। মানুষ তাদের ভয় পায়। তাদের সীমাহীন অত্যাচার মাত্রা ছাড়ায় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়। এসময় তারা পেট্টোল দিয়ে গণহারে মানুষের গাড়ি-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, বিএনপি-জামায়াতের সেই আগুনে ঝলসে মারা যায় শত শত মানুষ। হাজার হাজার পরিবার পথে বসেছে তাদের নাশকতা ও অত্যাচারের কারণে।

তাই গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস করা বিএনপি-জামায়াতের দুর্বৃত্তরা। একারণেই তারা বিকল্প উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। কখনো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা, কখনো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে তারা।

আরও পড়ুন: প্রকাশ্যে ভারতবিরোধিতা আর আড়ালে তোষণ-বিএনপির নীতি

কিন্তু বিএনপি-জামায়াত আশা করে ছিল, ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যেহেতু স্বাধীনতার সময় থেকেই ভালো সম্পর্ক, শুধু সেই কারণেই বিজেপি হয়তো আওয়ামী লীগকে হঠিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। ব্যাপারটি হাস্যকর হলেও, বিএনপি-জামায়াতের চিন্তার ধরনটাই এরকম। কারণ এর আগেও তারা এভাবেই ক্ষমতায় থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের সহায়তায় অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ছিল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে পাকিস্তানি গোয়ৈন্দা সংস্থায় সাহায্যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উস্থান ঘটায় খালেদা জিয়া। এমনকি তারেক রহমান আরো একধাপ এগিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যার চেষ্টা করে। এটাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি। কিন্তু এই স্টাইলে তো আর পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশ চলে না, আর এসব সন্ত্রাসবাদকে কেউ সমর্থনও করে না।

ঠিক সেই কারণেই বিজেপিকে অনেক তোষণ করার পরেও তাদের কাছে পাত্তা পায়নি বিএনপি-জামায়াত। সারাদিন ভারত-বিদ্বেষ ছড়ানো জামায়াতও মোদীকে একাধিকবার শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছে। ভেতরে ভেতরে কয়েকবার দূত পাঠিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে বৈঠক বসার জন্য, কিন্তু বিএনপি-জাাময়াতের সেই আবেদনে সারাড় দেননি মোদী। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে আবারো ভারতের নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হলেও, তাই আগের মতো মিষ্টি তিবরণ করেনি বিএনপি। বিজেপির ২০১৪ সালের বিজয়ের পর বাংলাদেশে বিএনপি মিষ্টি বিতরণ করলেও, পরেরবার তাদের নীরবতার কারণ জানতে চাইলে সাংবাদিকদের কাছে বিএনপির থিংকট্যাংক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিজেপি আগ্রহ দেখায়নি।

আরও পড়ুন: মোদির জয়ে 'উচ্ছ্বাস' প্রকাশে এবার সংযত বিএনপি

এমনকি ২০১৪ সালে মোদীর সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক গড়ে তোলার অন্যতম প্রচেষ্টাকারী শমসের মোবিন চৌধুরীও দল থেকে পদত্যাগ করেন ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর। ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সীমাহীন নাশকতা, মানুষ পোড়ানো, ঘরে ঘরে আগুন দেওয়া, এসব সহ্য করতে না পেরে তার মতোই আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বিএনপি পরিত্যাগ করেছেন।

[ ভারত নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ ]

এদিকে ২০১৫ সালে এতিমের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাসহ বিভিন্ন বিচারকে কেন্দ্র করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে আটকে ছিলেন, তখন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ তাকে ফোন করেআমিত খোঁজখবর নিয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে সেই খবর পৌঁছে যায় অমিত শাহ এর কাছে। এর দুদিন পর অমিত শাহ নিজে এক বিবৃতিতে জানান, তিনি খালেদা জিয়াকে ফোন করেননি। এই ঘটনায় বিএনপিকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।

আরও পড়ুন: বিজেপির বিজয়ে বিএনপিতে উচ্ছ্বাস

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সাথে বৈঠকে বসতে ব্যর্থ হয়ে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গেও বৈঠকের চেষ্টা করে বিএনপি। ২০২০ সালের মার্চে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় এলেও বিএনপি-জামায়াতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেননি। তারপরেও নরেন্দ্র মোদীর সাথে দেখা করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তদবির করতে থাকে বিএনপি। কিন্তু মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এলেও, বিএনপি-জামায়াতের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাতে রাজি হয়নি।

মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আশায় ‘প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা, আড়ালে ভারত তোষণে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিএনপি’। ভেতরে ভেতরে তারা লবিস্ট নিয়োগ করে ভারতের মন জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে দেশজুড়ে ভারতবিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে এবং ধর্মীয় ট্রাম্পকার্ড খেলে রাজনীতির মাঠে নোংরাভাবে বাজিমাতের অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

আরও পড়ুন: