হেফাজতের যুগ্মমহাসচিব ও তথাকথিত মাওলানা মামুনুল হকের নারী কেলেংকারীর বিষয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে সংগঠনটির স্বচ্ছ নেতাকর্মীরা। কর্মীদের সহিংসতায় মুখে ঠেলে দিয়ে, পার্লারে কর্মরত একজন নারীকে নিয়ে, ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আবাসিক হোটেলে আমোদ-প্রমোদের সময় আটক হন হেফাজতের স্বঘোষিত যুবরাজ মামুনুল হক। এরপর মিথ্যাচার ও কূটকৌশল প্রয়োগ করে, হেফাজত কর্মী এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যবহার করে, ঘটনাস্থল থেকে ভেগে যান এই রাজাকারপুত্র। কিন্তু নিজের স্ত্রীর সাথে প্রতারণা, কর্মীদের সাথে কপটতা এবং নিজের কুকর্ম ঢাকতে ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় মামুনুলকে ধিক্কার দিয়েছেন হেফাজতের একটা অংশ। তারা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তাদের কথা- ব্যক্তির কুকর্মের দায় সংগঠন নেবে না।

৬ এপ্রিল হেফাজতের যুগ্ম-সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুল হককে ধিক্কার জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন হেফাজত নেতা আলহাজ মুফতি নাসির উদ্দিন খান (হেফাজতের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গাজীপুর জেলা)। তিনি বলেছেন, ‘হেফাজতের মামলায় গ্রেফতার, আমাদের ভাইদের মুক্ত করার জন্য যখন আমরা থানায়,পুলিশের কাভার্ড ভ্যানের পেছনে, আর আদালতের বারান্দায় ঘুরছি। তখন আমাদের কওমি অঙ্গনের কিছু ফেসবুকিও আবেগী যোদ্ধারা, ফেসবুকের যুদ্ধে রত। কেউ রিসোর্টে রিফ্রেশমেন্টের মওকাও পেয়ে যান। কোনো ব্যক্তির পদস্খলনের দায় সংগঠন নিতে পারে না। নেওয়া উচিত নয়। সাংগঠনিক কাজ করতে যেয়ে বাধার মুখোমুখি হলে, তখন সংগঠন তার পাশে দাঁড়াবে, সমস্ত শক্তি নিয়ে। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ, দেশের চেয়ে ঈমান বড়, এই কথাই শেষ।’

আবাসিক হোটেলে নারী নিয়ে ধরা খাওয়ার ঘটনায় মামুনুলের ওপর অভ্যন্তরীণভাবে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন আলহাজ মুফতি নাসির উদ্দিন খান। তিনি মাদানিয়া কুরআন শিক্ষা বোর্ডের ঢাকা বিভাগীর আহ্বায়ক এবং জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক। ভণ্ড মামুনুল হকের কুকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি স্ট্যাটাস দেওয়ার পর, সেই স্ট্যাটাসে হামলে পড়ে মামুনুলের অন্ধ-অনুসারীরা। যার জবাবে (রিপ্লাইয়ে) আলহাজ মুফতি নাসির উদ্দিন খান পরবর্তীতে লিখেছেন, ‘গতকাল (৫ এপ্রিল) হেফাজতের মিটিংয়ে মামুনুল হক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি প্রথমে ওই নারীকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছেন। পরে একটি পার্লার করে দিয়েছেন। এরবাইরে, মুরুব্বীদের কাছ থেকে চাক্ষুস শুনে যা পরিষ্কার হয়েছে, তা প্রকাশ পেলে আপনাদের মতো অন্ধ আবেগীদের মুখ থাকবে না।’

এর আগে, দুটো ফোনালাপ থেকে জানা যায় যে, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতারাও মামুনুল হকের নোংরামির দায় নিতে চাচ্ছেন না। দেশজুড়ে কর্মীদের সহিংসতার মুখে ঠেলে দিয়ে, একজন পার্লার কর্মীকে নিয়ে, মামুনুল হকের হোটেলে সময় কাটানোর ঘটনাটি সবার ইমেজ নষ্ট করছে। এমনকি যারা সত্যিকারভাবে ইসলামি আদর্শের চর্চা করেন, তাদের দিকেও মানুষ এখন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে বলে মনে করছেন হেফাজত নেতারা। এমনকি হেফাজতের যুগ্মমহাসচিব মামুনুল হকের অপকর্মের জন্য, পুরো হেফাজত বিপদে পড়েছে বলেও মন্তব্য করছেন তারা।

এবিষয়ে হেফাজতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা ফজলুল করিম কাশেমীকে ফোন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হেফাজত নেতা মো. ফয়সল আহমেদ। মামুনুল হকের সঙ্গে রিসাের্টে সময় কাটাতে যাওয়া পার্লারের ওই নারী কর্মীকে কোথায় রাখা হয়, মাওলানা ফজলুল করিম সে বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ফয়সল আহমেদ বলেন, ‘বসিলায় মামুনুলের একটা ফ্ল্যাট আছে, কেউ জানে না, ওইটা অনেক আগে কেনা, অন্য টাকায়। যাক, এখন আমরা আগে হেফাজতের মান বাচাই। পরে, খেলা হবে।’

হেফাজতের নায়েবে আমির আহমেদ আবদুল কাদেরও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা ফজলুল করিম কাশেমীর কাছে। আবদুল কাদের বলেন, ‘মামুনুলের কুকর্মের কারণে এখন ঘরের বউয়ের কাছ থেকেও ধিক্কার শুনতে হচ্ছে। এর ভাবটা এমন যে, সে কোনো যুবরাজ। ধর্মকর্ম কিচ্ছু নাই, উল্টাপাল্টা রাজনীতি করে বেড়াচ্ছে, পাবলিক ক্ষেপাচ্ছে, সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়া সবকিছু হয় না। আর সব জায়গায় হেডম দেখাতে হয় না। বেশি বাড়লে এরকমই হয়। কোনো বিবেক নাই, ক্ষমতার জন্য পাগল হয়ে গেছে। স্বঘোষিত যুবরাজ, যা খুশি তাই করে।’

জঙ্গিগ্রুপ আইএস-এর টাকা ও জামায়াতের অস্ত্রে সজ্জিত রাজাকারপুত্র মামুনুল হকের ব্যক্তিগত কুকর্মের কারণে বিপাকে পড়েছে হেফাজত। কেন্দ্রীয় নেতাদের ফোনের আলাপ থেকে জানা যায়, মামুনুলের কারণে হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত স্বচ্ছ নেতা ও আলেম সমাজ খুবই বিব্রত কিন্তু প্রকাশ্যে তারা প্রতিবাদ করছে না। সবাই ভাবছে যে, মামুনুল হক যেহেতু হেফাজতের ‘পোস্টার বয়’ হয়েছে, তাই সাধারণ মানুষ মনে করে- মামুনুল মানেই হেফাজত, আর হেফাজত মানেই মামুনুল। তাই হেফাজতের ইমেজ রক্ষার স্বার্থে মামুনুলের অজাচার ও অনৈসলামিক কাজকে ভেতরে ভেতরে সমালোচনা করলেও, প্রকাশ্যে কিছু বলা থেকে বিরত আছেন সংগঠনের নেতারা, তারা এটিকে লজ্জার বিষয় মনে করছেন। তবে সংগঠন মামুনুল হকের এসব অপকর্মের দায় নিতে পারে না এবং মামুনুলের কারণে ব্যক্তিগতভাবে সংগঠনের কেউ সন্মান হারাতে পারে না, তাই অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে অভিহিত করে নিজের পরিবার-সমাজ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিজিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেক নেতা।

এদিকে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা না করা এবং লোক দেখানো শো-ডাউন না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মাদানিয়া কুরআন শিক্ষা বোর্ডের ঢাকা বিভাগীর আহ্বায়ক আলহাজ মুফতি নাসির উদ্দিন খান। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি জানিয়েছেন, ‘হেলিকপ্টার,আর বড় মজমা দেখে প্রভাবিত হবেন না।’

উল্লেখ্য, ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টের ৫০১ নম্বর রুম থেকে নারীসহ হেফাজত নেতা ও খেলাফত মসলিসের মহাসচিব মামুনুল হককে আটক করে স্থানীয়রা। সেসময় ওই নারীকে রেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় মামুনুল। এরপর রিসোর্টের খাতা চেক করে দেখা যায়, মামুনুল হক তার আসল স্ত্রী আমেনা তৈয়বার নামে হোটেলের রুমটি বুকিং করেছিলেন কিন্তু সঙ্গে যে নারী ছিল তিনি অন্য একজন, তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। মিথ্যা বলে ধরা পড়ার পর, ঝর্ণাকে দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করে মামুনুল হক। বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ফোন করে মামুনুল নিজের স্ত্রী আমেনা তৈয়বাকে বলে যে, ‘পরিস্থিতির কারণে এটা বলতে হয়েছে, সে আসলে শহিদ ভাইয়ের বউ, আমার সাথে কিছু না, তবে তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবা যে তুমি বিষয়টি জানো (মামুনুল যা বলেছে, তাতে যেন সহমত পোষণ করে), পরে এসে খুলে বলবো।’ এরপর, হেফাজত কর্মীরা মামুনুল হককে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। তখন মামুনুল জান্নাত আরা ঝর্ণাকে ফোন দিয়ে জানতে চায় যে, পুলিশ কী জানতে চেয়েছে তার কাছে। জবাবে ওই নারী জানায়, বিয়ে কবে হয়েছে ও কোথায় হয়েছে- তা জানতে চেয়েছে। আপনি যেহেতু বলেছেন যে বিয়ে দুবছর আগে হয়েছে, তাই আমিও সেটাই বলেছি। কিন্তু কোথায় বিয়ে হয়েছে, তা বলতে পারিনি। এরপর, মামুনুল বলেন যে- আমাদের এখন এই বিয়ের ব্যাপারটা স্ট্যাবলিশ করতে হবে, যা বলছো সেটাই বলবা, ভুলভাল কিছু বলা যাবে না, খুব সতর্ক।

অন্যদিকে মামুনুলের বোন ও তার আসল স্ত্রীর ফোনের আলাপ থেকে জানা যায়, মামুনুলের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তার আসল স্ত্রী আমেনা তৈয়বাকে ফোন দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন মামুনুলের বোন। তিনি মামুনুলের স্ত্রীকে বলেন, ”এসব কথায় কান দিও না। তোমাকে সাংবাদিকরা ফোন দিলে বা কেউ কিছু জানতে চাইলে তুমি বলবা যে- ‘দুই বছর আগে মামুনুল দ্বিতীয় বিয়ে করছে, আমার শ্বাশুড়ি নিজেই এই বিয়ে দিয়ে গেছেন।’ এরপর ভীতকণ্ঠে মামুনুলের স্ত্রী আবার জানতে চান- ‘ঘটনা কি সত্যি?’। তখন আবারো মামুনুলের বোন বলেন, ‘আরে নাহ। আর মামুনুল যদি তার দরকারে এদিক ওদিক যায়, তো গেসে। তোমার সমস্যা নাই কোনো। আমরা তো আছি তোমার সাথে। আমরা থাকলে তোমার কোনো চিন্তা নাই। তোমারে যা বললাম, কেউ কিছু জানতে চাইলে তুমি তাই বলবা। বলবা যে- তুমি সব জানো। পারিবারিকভাবে মামুনুল বিয়ে করছে, সবাই ছিল তখন।”

এদিকে মামুনুল তার বিয়ের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। অবশেষে কাবিন ছাড়া শুধু ইসলামি শারিয়া মোতাবেক বিয়ের দাবি জানায় সে। এরপর সাংবাদিকরা তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণার বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন তারা জানান- তাদের মেয়ের আগে বিয়ে হয়েছিল, সেটা ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, তবে এই বিয়ের ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না।

ফলে, বিয়ে না করেও শারিয়া মোতাবেক বিয়ের অজুহাত দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও নষ্ট হয়ে যায় মামুনুলের। এদিকে, মেয়ের অভিভাবকের অজান্তে শারিয়া মোতাবেক বিয়ের বৈধ হওয়ার নিয়ম নেই। ফলে সব মিথ্যাচার ও কপটতা ফাঁস হয়ে যায়, এবং সত্য তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ায়, ধীরে ধীরে খোলসের ভেতর ঢুকে পড়েন ধর্মব্যবসায়ী মামুনুল হক। এছাড়া, ধরা পড়ার পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং তার অন্ধভক্তদের কাজে লাগিয়ে তর্জন গর্জন শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু অবশেষে তার মুখোশটা খুলে গেলো।

এরপরের ঘটনা তীব্র হৃদয় বিদারক। ফেসবুকে এসব ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে, ওই নারীর সন্তান ফেসবুক লাইভে এসে জানান, মামুনুল হকের সঙ্গে তার বাবার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার মাকে অনৈতিক প্রস্তাবও দিয়েছিল মামুনুল। তবে তখন তার মা রাজি হয়নি। পরে তার বাবা-মার সংসার ভেঙে যায়, এই সংসার ভাঙার পেছনেও মূল হোতা মামুনুল হক। এরপর মামুনুল তাদের অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থার সুযোগ নেয়। মামুনুলকে সে আলেম ছদ্মবেশী জালেম বলে অভিহিত করেছে।