গুম-বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কিছু মানুষের ‘নিখোঁজ’ হওয়া সংক্রান্ত অতিরঞ্জিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ নিয়ে নিয়ে বহির্বিশ্বে ‘পেইড’ আলোচনা চলছে। নামসর্বস্ব কয়েকটি বিশেষ সংস্থা কর্তৃক ভিত্তিহীন ও ম্যানিপুলেটেড প্রতিবেদন কৌশলে পাঠানো হয় বিশেষ কিছু জায়গায়। যার ফলে উদ্বিগ্ন বলে বিবৃতি দিচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তথাকথিত মানবাধিকারের দোকানদার এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পক্ষ। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গত ১ দশক ধরে নিখোঁজ হওয়া ৭৬ ব্যক্তির একটি তালিকা পাঠিয়ে তাদের বিষয়ে জানতে চেয়েছে কয়েকটি দালাল গোষ্ঠী।

নিজেদের কাজের ধারার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ সংস্থাগুলো নিখোঁজ ৭৬ জনের কথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থের বিনিময়ে প্রচারণা চালিয়ে একে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কলে চিহ্নিত করছে। অথচ জানা গেছে, এই ৭৬ জনের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকা ১০ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিমধ্যে খুঁজে বের করে এনেছে। বাকি ৬৬ জনের মধ্যে ২৮ জনই দাগী সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী। যারা আইনের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মত।

এছাড়া তালিকার বাকিদের মধ্যে প্রেমঘটিত কারণে গৃহত্যাগী কিশোরী, স্বামী প্রবাসে থাকায় প্রেমিককে নিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া গৃহবধূ, ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষের রোষের শিকার অরাজনৈতিক ব্যক্তি, মানসিক বৈকল্যের কারণে নিখোঁজ ব্যক্তি, কর্মহীন বেকার ভবঘুরে, মাদকসেবীসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনও রয়েছে।

আরও পড়ুন : গুম ছাত্রদল কর্মীর হদিস ১২ বছর পর, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হয়রানির দায় নেবে কে?

যে দশজন ফিরে এসেছেন, তাদের নাম: সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘেন, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, শামীম উদ্দিন প্রধান, মোহাম্মদ আখতার হোসেন, মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল ফারুখ রশিদ, মো. হাসিনুর রহমান, মোহাম্মদ আলতাফ হাওলাদার, মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সরকার ও মোহাম্মদ জায়েদুর রহমান। আসুন জেনে নেওয়া যাক, যারা ফিরে এসেছেন, তারা কারা, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে।

Table of Contents

সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘেন :

unlfভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইউএনএলএফ-এর প্রধান এই ভারতীয় নাগরিক সেদেশে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে এই সন্ত্রাসীকে ২০১০ সালে আটক করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এই সন্ত্রাসীর নাম WGEID-এর গুম তালিকায় ওঠানো হয়। দাবি করা হয়, বাংলাদেশ মেঘেনকে গুম করেছে। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের কারণে তার সাজা হয়েছে এবং ভারতের গোয়াহাটি জেলে সাজা খেটে ২০১৯ সালে মেঘেন মুক্তি পেলেও কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তার নাম গুম তালিকায় ছিল।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম :

দোকান কর্মচারী রফিকুল ছিলেন মাজারভক্ত। প্রায়শ বিভিন্ন মাজারে ঘুরে বেড়াতেন। ২০১১ সালে একদিন তিনি নিরুদ্দেশ হন। পরিবার-পরিজন থানায় জিডি করে। কিন্তু তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থার কল্যাণে WGEID-এর প্রতিবেদনে ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের’ বরাতে দাবি করা হয়েছে, রফিকুলকে নাকি র‌্যাব তুলে নিয়ে গেছে। দাবি করা হয়, ৩টি পিকআপ গাড়িতে করে র‌্যাবের ১০ জন অস্ত্রসজ্জিত সদস্য নাকি এসে তাকে নিয়ে গেছে! যদিও র‌্যাবের কাছে তাকে আটকের কোনো তথ্য ছিল না। ৯ মাস পর রফিক পরিবারের কাছে ফিরে এলে জানা যায়, এতদিন তিনি সিলেটে হযরত শাহজালাল ও শাহপরাণের মাজারে ছিলেন। তিনি ২০১২ থেকে পরিবারের কাছে থাকলেও তার নামও গুম তালিকায় ছিল কয়েকদিন আগ পর্যন্ত।

শামীম উদ্দিন প্রধান :

বগুড়া জেলা বিএনপির সক্রিয় একজন নেতা শামীম। যিনি বিএনপির আগুন-সন্ত্রাসের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। হত্যাচেষ্টা, বিস্ফোরক বহন, হরতালে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরসহ অন্তত ১০টি মামলাসহ অসংখ্য অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে যান। তিনি ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হন র‌্যাবের হাতে। কিন্তু গুম হয়েছেন বলে বিএনপি এবং বিভিন্ন সংস্থা দাবি করতে থাকে। ছাড়া পেয়ে পরিবারের সাথে বাস করলেও তার নামও রয়ে গেছে গুমের তালিকায়। এমনকি ‘গুম’ তালিকায় নাম রেখেই তিনি গত বছর ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন!

মোহাম্মদ আখতার হোসেন :

মসজিদের ইমামতির আড়ালে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্তার অভিযোগ থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ ২০১৬ সালে রংপুরের পীরগাছায় তার বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। তার পরিবার বা স্বজনদের কেউই তিনি গুম হয়েছেন মর্মে থানায় অভিযোগ করেননি। অর্থাৎ, তারা জানতেন আখতারকে কেন এবং কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবুও তার নাম গুমের তালিকায় তোলা হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং তার WGEID-এর প্রতিবেদনেও তালিকাভুক্ত হয়। সেই মামলাগুলোতে জামিনে মুক্তি পেয়ে নিজ বাড়িতে বসবাস করলেও তার নাম কিছুদিন আগ পর্যন্ত গুম তালিকায় বহাল ছিল।

মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ :

নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গুম করেছে দাবি করে তার পরিবার একটি মামলা করে। যদিও পরে জানা যায়, র‌্যাবের হাতে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন নাহিদ। তার বিরুদ্ধে পুরনো অনেক মামলা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, নাশকতা, হত্যাচেষ্টা, নাশকতার উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ সংগঠনের সাথে গোপন বৈঠক, বিস্ফোরক দ্রব্য বহন ইত্যাদি। মামলা এবং যাবতীয় আইনি কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর বর্তমানে তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করলেও তার নাম WGEID-এর প্রতিবেদন থেকে নামেনি কিছুদিন আগ পর্যন্ত।

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল ফারুখ রশিদ :

পেশায় ইলেক্ট্রিশিয়ান এবং শিক্ষার্থী ফারুখকে সাদা পোশাকের পুলিশরা নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করে থানায় একটি জিডি করে পরিবারের লোকজন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি ছাড়া পান। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব নিয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়। ছাড়া পেয়ে তিনি তার পরিবারের সাথে বসবাস করলেও তার নাম যথারীতি অন্যদের মত WGEID-এর প্রতিবেদন থেকে নামেনি কিছুদিন আগ পর্যন্ত।

মো. হাসিনুর রহমান :

এ এক বর্ণিল চরিত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৭ বছর বয়স ছিল তার, কিন্তু তাসনিম খলিল-বার্গম্যানের গুম নাটকে নিজেকে বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে হাস্যকর ডায়লগবাজি করেন। মূলত তিনি ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা (লে. কর্নেল)। তার বাবা ছিলেন লাকসাম বিএনপির সভাপতি, চাচা ছিলেন জিয়া আমলের বিএনপির এমপি। বিএনপি পরিবারের সন্তান হওয়ায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের আশীর্বাদে র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের অধিনায়ক হন। চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা মহিমসহ অন্তত ৩৪টি ক্রসফায়ারের সাথে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি দাবি করেন, তাকেও নাকি ‘গুম’ করা হয়েছিল! অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের সাথে সম্পৃক্ততা, জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ, সেনাবাহিনীর স্পর্শকাতর তথ্য পাকিস্থানে পাচারসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগে সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই সামরিক আইনে ২০১৮ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে সেনা-পুলিশ, তাকে সেনা-দপ্তরে সেনা-আইন অনুসারে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, জিজ্ঞাসাবাদ এবং আইনি প্রক্রিয়ার পর দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সেনা আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পর তাকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়।

অর্থাৎ, তার সাথে যা কিছু ঘটেছে, সবই সেনাসদস্য থাকা অবস্থায় সেনা-আইন অনুসারেই হয়েছে। তিনি বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন না, তাকে বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে সেনা-পুলিশ আটক করেনি, সেনা-দপ্তরে বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। দোষী সাব্যস্তের পর বরখাস্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি পূর্ণ সামরিক মর্যাদাই পেয়েছেন। তিনি যে ‘উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া’ হয়েছিল বলে দাবি করেছেন, তা পুরোপুরি মিথ্যাচার। তার অভিনীত এই নাটকের মাধ্যমে দেশে ‘গুম-সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা করেছে যুদ্ধাপরাধী ও দেশবিরোধীদের তল্পিবাহকরা। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছে সেই তথাকথিত মানবাধিকারের দোকানগুলো এবং বিভিন্ন বিবৃতিতে সাক্ষরকারী চিহ্নিত ব্যক্তিবর্গ। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের শুরু থেকেই ছিল একাট্টা। সাজা খেটে তিনিও এখন পরিবারের সাথে বসবাস করছেন। যদিও WGEID-এর গুম তালিকায় রয়েছে তার নাম।

মোহাম্মদ আলতাফ হাওলাদার :

যশোরের শার্শা উপজেলা নিবাসী আলতাফকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, মাদক ব্যবসাসহ কয়েকটি মামলায় ২০১৮ সালে আটক করেছিল র‌্যাব। তখন তার পরিবার থানায় অভিযোগ দেয় আলতাফকে অজ্ঞাতনামা কয়েকজন ব্যক্তি ‘তুলে নিয়ে গেছে’ বলে। যদিও পরবর্তীতে জানা যায় আলতাফ র‌্যাব হেফাজতেই আছেন। কিন্তু সেই যে গুম তালিকায় তার নাম উঠলো, তিনি পরিবারের কাছে ফিরে আসার পর থেকে কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তার নাম সেখান থেকে মোছা হয়নি। পত্র-পত্রিকা এবং বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন তালিকায় তিনি গুম হিসেবেই চিহ্নিত।

মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সরকার এবং মোহাম্মদ জায়েদুর রহমান :

বিভিন্ন মামলায় এই দুজনকে একসাথে নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। নাশকতাসহ কয়েকটি গুরুতর মামলা ছিল তাদের বিরুদ্ধে। ইকবাল এবং জায়েদ-এর স্বজনরা তাদের অবস্থান জানেন, তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলারও হদিস জানেন। তারা গুম হয়েছেন বা কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেছে- এমন কোনো অভিযোগে স্বজনরা থানায় জিডি বা মামলা করেননি। কিন্তু তাদের নাম WGEID-এর তালিকায় তোলা হয়েছে সুকৌশলে। যেহেতু তারা কারাগারে আছেন, তাই তাদের এখনো সন্ধান পাওয়া যানি বলে দাবি করা হয়েছে এসব উদ্ভট প্রতিবেদনে। কাগজে-কলমে কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তারা গুম হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন।

আরও পড়ুন : ইতিহাসের কাঠগড়ায় স্বৈরশাসক জিয়ার গুম ও হত্যার রাজনীতির উপাখ্যান

এবার দেখা যাক, এখনো নিখোঁজ বাকি ৬৬ জন কারা, তাদের সম্পর্কে একটু জেনে নিই।

মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ মোনায়েম :

গুম তালিকাগুলোতে বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের সাথে সম্পৃক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে তাদেরকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার দাবি করা হয়। অথচ অদ্যাবধি নিখোঁজ শফিক উল্লাহ মোনায়েমের রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া হয়নি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই। বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মোনায়েম যখন নিখোঁজ হন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায়। ২০০৭ সালের ১লা ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে কে/কারা তাকে বরিশাল থেকে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। কারো কারো দাবি, বিএনপি-জামায়াতের কারসাজিতে ছাত্রলীগের এই নেতা, যার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত ছিল না, তাকে অপহরণ করেছে। পরবর্তীতে তার নিখোঁজ হওয়া বিষয়ে মামলা করা হয়। কিন্তু এত বছর পর আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই দেখে তদন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এখন বিএনপি এই মোনায়েমের নাম ব্যবহার করছে গুম তালিকার কলেবর বৃদ্ধিতে। আর দায় চাপাচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর, যখন কি না আওয়ামী লীগ ক্ষমতাতেই ছিল না।

মো. হাসান খান :

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গাজীপুর থেকে ২০০৮ সালের ২৫শে মে তাকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত তার হদিস মেলেনি। বিএনপি তাদের অপরাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হাসানের নিখোঁজ হওয়ার দায় চাপিয়েছে আওয়ামী লীগের ওপর, যখন কি না আওয়ামী লীগ ক্ষমতাতেই ছিল না।

মোহাম্মদ চৌধুরী আলম :

ঢাকা থেকে ২০১০ সালের ২৫শে জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কিছু লোক তুলে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা ছিল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে এর আগে তার বাসায় গিয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা, কিন্তু সেসময় তিনি বাসায় অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু পরে তাকে যারা তুলে নিয়ে যান, তারা আদৌ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছিলেন কি না, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। স্বজনদের ধারণা, পূর্ব শত্রুতার জেরে অরাজনৈতিক ব্যক্তি চৌধুরী আলমের ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষরা তাকে অপহরণ করে থাকতে পারে।

তপন দাস :

পেশায় দর্জি এবং জমির দালাল তপন দাসের বিরুদ্ধে থানায় বেশ কিছু মামলা আছে দাবি করে ২০১১ সালের ৩রা আগস্ট ডিবি পরিচয়ে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন ব্যক্তি। তার আর কোনো হদিস মেলেনি। পরিবারের সদস্যরা পুলিশে তার সন্ধান চেয়ে অভিযোগ করলে ডিবি এবং সিআইডি নিশ্চিত করে তপন দাসের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। আর ডিবি তাকে আটক করেছে, এমন কোনো রেকর্ডও মেলেনি। তার অন্তর্ধানকে শত্রুতাবশত কোনো ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে। তপন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

হাবিবুর রহমান হাওলাদার :

২০১২ সালের বাগেরহাট থেকে পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন হাবিব। তাই তার কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ছিল না। হাবিবুর রহমানের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি স্বজনদের কাছে তাই অভাবনীয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক অনুসন্ধানের পরেও কোনো খোঁজ বের করতে পারেনি হাবিবের।

মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম :

সিরাজগঞ্জ থেকে ২০১২ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। WGEID দাবি করেছে, র‌্যাবের লোক ছিল তারা। যদিও এর সত্যতা নিরূপন করা যায়নি। পরিবারও থানায় কোনো জিডি করেনি। অরাজনৈতিক ব্যক্তি নজরুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না।

আল মোকাদ্দাস হোসেন ও মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ :

কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই শিক্ষার্থীকে ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন ব্যক্তি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে এমন দাবি করা হয়েছে। এই দাবিটি উদ্ভট। ডিবি ও র‌্যাব ভিন্ন দুটি সংস্থা, তারা একই দিনে রাজনৈতিভাবে অগুরুত্বপূর্ণ কাউকে এভাবে একসাথে অপারেশন চালিয়ে আটক করবে, এটা মেনে নেয়া কঠিন। যদিও সহপাঠীদের দাবি, তারা উগ্রবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হতে আত্মগোপনে গিয়ে থাকতে পারে। তাদের অভিমত, এই দুজন হয়ত দেশ ছেড়ে আফগানিস্তান বা পাকিস্থানে চলে গেছে।

কে এম শামীম আখতার :

ছাত্র ইউনিয়নের নেতা শামীমকে ২০১২ সালে ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু র‌্যাব এবং পুলিশের তদন্তে জানা যায়, সরকারি কোনো সংস্থাই তাকে গ্রেপ্তার বা আটক করেনি। আরও জানা যায়, একটি মিনিবাসে করে কয়েকজন লোক এসে তাকে তুলে নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিনিবাস ব্যবহার করে না। বাম রাজনীতি করার কারণে তিনি জামায়াত-শিবিরের মত উগ্রপন্থীদের টার্গেট হতে পারেন বলে ধারণা।

মোহাম্মদ ইমাম হাসান :

মুক্তিপণের দাবিতে ঢাকার ফার্মগেট থেকে ২০১২ সালে তিনি অপহৃত হন। পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে র‌্যাব তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। ইতিমধ্যে পরিবার মুক্তিপণের টাকা সময়মত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং র‌্যাবের অনুসন্ধান টের পাওয়ায় অপহরণকারীরা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এর দায়ও সরকারের ওপর চাপিয়েছে বিএনপি।

পারভেজ হুমায়ুন কবির ও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম হিরো :

সামরিক বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে এই দুজনকে ২০১৩ সালে কুমিল্লা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও সামরিক বাহিনীর সদস্য না হলে বেসামরিক নাগরিকদের কাউকে মিলিটারি পুলিশ আটক করার কোনো কারণ নেই। হুমায়ুন ছিলেন লাকসাম বিএনপির সক্রিয় কর্মী এবং সাইফুল ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য। এই দুজনের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের সম্পৃক্ততার কিছু তথ্য রয়েছে বলে জানা যায়।

মোহাম্মদ তৈয়ব প্রামাণিক, মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটোয়ারী ও মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল :

প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই এই তিনজনের। দাবি করা হয়, তাদেরকে নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছ। যদিও তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পায়নি র‌্যাব। তাদেরকে আনা হয়েছে, এমন কোনো রেকর্ডও নেই। তাই তাদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে স্থানীয় শত্রুতা বা অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা।

কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র শিলহেইবা :

জন্মসূত্রে ভারতীয় এই নাগরিক বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। ২০১০ সালে সিলেট থেকে আটককৃত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইউএনএলএফ-এর প্রধান সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘেন-এর সংগঠনের সদস্য এই শিলহেইবা। তাকে ২০১৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে গোয়েন্দারা আটক করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেয়। এই সন্ত্রাসীর নামও উঠেছে WGEID-এর গুম তালিকায়। ধারণা করা হচ্ছে তিনি ভারতের কোনো জেলে সাজা খাটছেন বর্তমানে।

মো. সেলিম রেজা পিন্টু :

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এবং পেশায় ব্যবসায়ী পিন্টুকে ঢাকা থেকে ২০১৪ সালে সাদা পোশাকের তিন ব্যক্তি এসে নিয়ে যায়। তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। যদিও জানা যায়, সরকারি কোনো বাহিনীই তাকে আটক করেনি। ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষরা তাকে গুম করেছে, এমন দাবিও উঠেছে। ২০১২-১৩ সালে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যা, নাশকতা, আগুন সন্ত্রাসসহ বেশ কিছু মামলাও ছিল। তবে একটি অসমর্থিত সূত্রের দাবি, মামলা থেকে বাঁচতে তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন।

মো. আসাদুজ্জামান রানা বাবু, করিম জাহিদুল তানভীর, মো. মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আল–আমিন, ইসলাম সাজেদুল সুমন ও মোহাম্মদ আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম :

২০১৫ সালে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এই ৬ জনকে। এদের মধ্যে সাজেদুল ঢাকার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি এবং তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা ছিল। তবে তাদের বিরুদ্ধে এমন কোনো গুরুতর অভিযোগ ছিল না যে, র‌্যাব গ্রেপ্তার করবে। র‌্যাবের কোনো টিম তাদেরকে নিয়ে গেছে, এমন তথ্য মেলেনি। তাদের এই নিরুদ্দেশের পেছনে দলীয় কোন্দলকে দায়ী করেছেন কয়েকজন নিখোঁজের স্বজনরা।

মো. কাওসার হোসেন ও এ এম আদনান চৌধুরী :

র‌্যাব পরিচয় দিয়ে এই দুজনকে ২০১৩ সালে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়েছে। উপরোক্ত ৬ জনের সাথে এই দুজনের যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। সেই হিসেবে একটি সূত্র বলছে, বিএনপির স্থানীয় কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক কোন্দল এদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে দায়ী।

মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম :

২০১৩ সালের ১১ই মে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে তার গাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেলে সেটি রাখা হয় রমনা থানায়। র‌্যাবের কাছে তাকে তুলে আনার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে তাকে অপহরণ করা হয়ে থাকতে পারে বলে পরিবারের দাবি।

নুরুল আমিন :

লক্ষ্মীপুর থেকে তাকে ২০১৫ সালের ২৯শে মার্চ পুলিশ ও আনসার পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না তিনি। তবে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে স্বজনদের সাথে দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা যায়। সেই দ্বন্দ্বের জেরে তাকে প্রতিপক্ষ কেউ গুম করে থাকতে পারে বলে ধারণা।

নুর আলম :

গাজীপুরে বন্ধুর বাসা থেকে তাকে ২০১৫ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি পরিচিতদের। বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় এবং সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত নুর আলমের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সময় গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা, বিস্ফোরক দ্রব্য বহন, হত্যাচেষ্টাসহ অনেক অপরাধের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নুর আলম গাজীপুর বিএনপির অন্যতম কুখ্যাত নেতা। ধারণা করা হয়, মামলা থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি। আর আইওয়াশ করতে তাকে গুম করা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে তার দল।

সোহেল রানা :

২০১৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়। বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের হয়ে বিভিন্ন সময় সহিংসতা ও নাশকতায় অংশ নিয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। তবে স্থানীয় গ্রুপিংয়ের দ্বন্দ্বে শিকার হয়ে ইতিপূর্বে তিনি বিবাদে জড়ান বিএনপির স্থানীয় এক নেতার সাথে। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে এমন কোনো কারণ থাকতে পারে বলে রাজনৈতিক সহকর্মীদের দাবি।

সাজ্জাদ হোসেন শেখ :

কুষ্টিয়া জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাজ্জাদ। একটি মামলার কাজে ঢাকায় গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট তিনি গাজীপুরের একটি রিসোর্ট অবস্থানকালে গ্রিল কেটে একদল দুর্বৃত্ত তাকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায় বলে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবি! তবে র‌্যাবকে কেন গ্রিল কেটে ঢুকতে হবে- এমন অদ্ভূত প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরাই তাকে খুন করে লাশ গুম করেছে।

মো. হোসেন চঞ্চল, পারভেজ হোসেন, মাহফুজুর রহমান সোহেল ও জহিরুল ইসলাম :

বিএনপির এই কর্মীদের স্বজনদের দাবি, ঢাকা থেকে তাদেরকে ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, সরকারি কোনো সংস্থাই তাদেরকে আটক করেনি। বরং অনুসন্ধানে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের ঢাকা তাণ্ডবের পরবর্তী সময়ে গুজব ও অপপ্রচার চালিয়ে সহিংসতায় উস্কানি দেওয়ার সাথে জড়িত ছিলেন তারা। একপর্যায়ে আইনি ঝামেলা এড়াতে তারা মালয়েশিয়া বিএনপির একজন নেতার মাধ্যমে সেখানে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

মো. নিজাম উদ্দিন :

দাবি করা হয়েছে র‌্যাব ও ডিবি নাকি একসাথে এসে তাকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর তুলে নিয়ে গেছে। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সংস্থা একইসাথে নির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে এসে কাউকে একইসময়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে- এমন অদ্ভূত অভিযোগ করা হয়েছিল তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পর। যার কোনো মীমাংসা হয়নি।

মীর আহমদ বিন কাশেম :

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে বেসামরিক বাংলাদেশি নাগরকিদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কুখ্যাত রাজাকার মীর কাশেম আলীর পুত্র মীর আহমদ। জামায়াতের অর্থনীতির ভিত্তি মীর কাশেমের পরিবার। দেশে-বিদেশে তাদের আস্তানায় আশ্রিত রয়েছে জামায়াতের অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও খুনি। লন্ডনে কাশেম আলীর পরিবার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে এখনো সক্রিয়। ২০১৪ সালে রাজাকার মীর কাশেমের মৃত্যুদণ্ডের পর দেশে সন্ত্রাসবাদের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল এই পরিবারের অর্থায়নে। যার অন্যতম হোতা ছিলেন আহমদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে ৭১-এর পর থেকে এখনো মেনে নিতে পারেনি এই রাজাকারের বংশধররা।

কাশেমের ফাঁসির পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর ছিল সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, আগুন সন্ত্রাস প্রতিরোধে। অবস্থা বেগতিক দেখে আহমদ লন্ডনে অপর দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের মত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দাবি করা হয়, ২০১৬ সালের ৯ই আগস্ট সরকারি সংস্থার লোকজন তাকে বাসা থেকে নিয়ে গেছে! দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্য ছাড়াও পলাতক যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরও আস্তানা লন্ডন। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে, কৌশলে নাম-পরিচয় বদলে লন্ডনে বসবাস করছেন এমন অনেকেই। ধারণা করা হচ্ছে মীর আহমদও সেখানে রয়েছেন এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের পারিবারিক কোনো ব্যবসাই বন্ধ হয়নি, আহমদ সেখানে বসেই হয়ত পরিচালনা করছেন।

মাহাবুব হাসান ও কাজী ফরহাদ :

নারয়ণগঞ্জ ছাত্রদলের এই দুই নেতাকে ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়। যদিও ডিবির কোনো টিম তাদের আটক করেছে, এমন তথ্য মেলেনি। স্বজনদের ধারণা, দলীয় রাজনৈতিক কোন্দলের বলি হয়েছেন এই দুই নেতা। যাদের নাম আসার সম্ভাবনা ছিল পরবর্তী কমিটিতে।

সম্রাট মোল্লা ও খালেদ হাসান :

বিএনপির এই দুই কর্মী বিভিন্ন মামলায় ঢাকা কারাগারে কারাবরণ করছিলেন। ২০১৩ সালের ২৮শে নভেম্বর তারা যখন মুক্তি পান, কারাগারের গেটে দলের সদস্যরা তাদেরকে বরণ করার কথা ছিল। কিন্তু তারা জেল থেকে বেরিয়ে অজ্ঞাতনামা লোকজনকে দেখতে পান। ডিবি পরিচয়ে তাদেরকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। যদিও মামলায় সাজা খাটার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয় তাদের সাথে। কিন্তু তারা নিরুদ্দেশ হন। ধারণা করা হয় এর পেছনে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে।

মোহাম্মদ তারিকুল আলম :

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শার্শা উপজেলার সাবেক সভাপতি এবং বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র তরিকুল আলম ছিলেন দলের নিবেদিতদপ্রাণ কর্মী। আদর্শিক কারণে যশোরের স্থানীয় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাসীদের সাথে তার বিরোধ পুরনো। পুরনো একটি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শার্শায় তার বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেয়ে ফিরে যায় র‌্যাব। সেসময় তিনি ঢাকায় ছিলেন। পরদিন (২০১৩ সালের ৭ই মার্চ) ন্যাম ভবন থেকে বের হওয়ার পর তিনি নিখোঁজ হন। স্বজনরা খোঁজ নিলে র‌্যাব জানায়, ঢাকায় র‌্যাবের কোনো দল তাকে আটক করেনি। তরিকুলের কর্মী-সমর্থকদের ধারণা, বিএনপি বা জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরাই তাকে গুম করেছে।

আবদুল্লাহিল আযমী :

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক এক ক্রিমিনাল বলা চলে বরখাস্তকৃত এই সেনা কর্মকর্তাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে বেসামরিক নাগরকিদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমের পুত্র এই আব্দুল্লাহিল আযমী। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আযম ও তার পরিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি কখনই। বাংলাদেশকে পাকিস্থান বানানোর চেষ্টায় তারা আজও সক্রিয়। পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সাথে সম্পর্ক, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ রাষ্ট্রদ্রোহীতায় সরাসরি সম্পৃক্ততার দায়ে আযমীকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

বিএনপি-জামায়াত সরকারের চক্রান্তে অন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে আযমীকে উর্ধ্বতন পদে বসানো হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল তাকে সেনাপ্রধান করার। আযমী সেনাপ্রধান হলে পাশার দান উল্টে যেত। বাংলাদেশকে পাকিস্থানের ভাবাদর্শে নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়ে যেত। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে পাকিস্থানের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হতো। আর বিএনপি-জামায়াত মিলে আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে একাত্তরের মত নিধন করতে শুরু করত। আযমীর বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ গঠিত হচ্ছিল, ২০১৬ সালের ২২শে আগস্ট থেকে তার তিনি নিখোঁজ। পরিবারের দাবি, তাকে সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়ে গেছে। যদিও পুলিশের কাছে তেমন তথ্য নেই। ধারণা করা হয়, পাকিস্থানি দূতাবাসের সহায়তায় ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্থানে পালিয়ে বর্তমানে সেখানে বসেই তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।

এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন :

ছাত্রলীগের ওয়ার্ড সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঢাকা থেকে ২০১৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি তিনজন অস্ত্রধারী তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ স্বজনদের। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে বলে অনেকের ধারণা।

মো. আবদুল কুদ্দুস প্রামাণিক :

বিএনপি-জামায়াতের মদদে সৃষ্ট ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুহাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। দেশব্যাপী ৫ শতাধিক স্থানে বোমা হামলা চালিয়েছিল। প্রগতিশীল বহু মানুষকে হত্যা করেছে এই সংগঠনটি। সিনেমা হল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে মানুষ মেরেছিল। সেই সংগঠনের একজন সদস্য কুদ্দুস। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাভাই ও আব্দুর রহমানের সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল। তারা একই এলাকার মানুষ। তাকে ২০১৭ সালের ৩০শে মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও অনেকের ধারণা, মামলা থেকে বাঁচতে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়েছেন।

মোহাম্মদ জাকির হোসেন :

কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত ছাত্র শিবিরের নেতা ছিলেন জাকির। তার বিরুদ্ধে নাশকতার বেশ কিছু মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালের ৩রা এপ্রিল ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছে বলে দাবি করে বিএনপি-জামায়াত। যদিও র‌্যাবের কোনো টিম তাকে আটক করেছে বলে তথ্য মেলেনি।

মো. মাহাবুবুর রহমান রিপন :

যুবদলের কর্মী রিপন নিজ দলের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছেন বলে এলাকাবাসী এবং স্বজনদের ধারণা। যার জেরে ২০১৪ সালের ২১শে মার্চ ঢাকা থেকে তাকে র‌্যাব পরিচয়ে কেউ তুলে নিয়ে গেছে বলে শোনা যায়। যদিও র‌্যাবের কোনো টিম তাকে আটক করেছে বলে তথ্য মেলেনি।

মো. রেজাউন হোসেন :

কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত ছাত্র শিবিরের কর্মী ছিলেন রেজাউন। তার বিরুদ্ধে নাশকতার বেশ কিছু মামলা রয়েছে। যশোর থেকে ২০১৭ সালের ৭ই আগস্ট পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে সংগঠনের দাবি। যদিও পুলিশের কোনো টিম তাকে আটক করেছে বলে তথ্য মেলেনি।

শেখ মোকলেসুর রহমান :

কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত ছাত্র শিবিরের কর্মী ছিলেন মোকলেস। নাশকতা, অগ্নিসংযোগসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাতক্ষীরা থেকে ২০১৬ সালের ৪ঠা আগস্ট পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে গেছে বলে সংগঠনের দাবি। যদিও পুলিশের কোনো টিম তাকে আটক করেছে বলে তথ্য মেলেনি।

রাজু ইসলাম :

জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা এবং সাইবার ক্রাইম বিষয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে রাজুর বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের ২০শে মার্চ ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি পরিবারের। যদিও পরিচিতদের ধারণা, জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর সাথে যোগ দিতে তিনি দেশ ছেড়েছেন।

মাইকেল চাকমা :

পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ-এর একজন সশস্ত্র সদস্য মাইকেল চাকমা। পাহাড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে তিনি র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ছাড়া পেয়ে তিনি পাহাড়ে সহিসংতায় উস্কানি দেওয়া এবং পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করার কাজে পুরোদমে নেমে পড়েন। ইউপিডিএফসহ পাহাড়ে বেশ কিছু সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে, তারা অন্যদের শত্রুতে পরিণত হয়। আদর্শিক কারণে একেকটি সংগঠন ভেঙে কয়েক টুকরো হয়। ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পর পর সংগঠনগুলোর মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। মাইকেলের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা চলমান ছিল। ২০১৯ সালের ৯ই এপ্রিল ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। কারো কারো ধারণা, সাংগঠনিক দ্বন্দ্বে তিনি নিহত হয়ে থাকতে পারেন। সরকারি কোনো সংস্থা তাকে আটক করেছে বলে এমন কোনো তথ্য নেই।

ইসমাইল হোসেন :

ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন একসময় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের নেতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ছিল। যদিও তথ্য-প্রমাণের অভাবে তিনি পরবর্তীতে খালাস পান। ধারণা করা হয়, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে তিনি ২০১৯ সালের ১৯শে জুন ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন।

মো. তারা মিয়া :

ছাত্রদল নেতা তারা মিয়া অনেকগুলো নাশকতা ও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ মামলার আসামি। বিএনপির দাবি, ঢাকার মিরপুর থেকে ২০১২ সালের ১৪ই আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। যদিও তদন্তে সরকারি কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে আটক করার তথ্য মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে দলীয় কোন্দলের শিকার হতে পারেন তিনি।

মনির হোসেন :

ছাত্রদলের উত্তরা থানা শাখার সাবেক যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক এবং গুলিস্তান শপিং সেন্টারের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী মনিরের স্বজনদের দাবি ২০১০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে পাল্টাপাল্টি কিছু তথ্য রয়েছে। ব্যবসার জন্য তিনি বড় অঙ্কের দেনার মধ্যে ছিলেন। টাকা শোধ করতে না পেরে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বা পাওনাদরদের রোষের শিকার হয়েছেন। আরেকটি সূত্র বলছে, তিনি যুবদলের পদপ্রত্যাশী ছিলেন এবং এ নিয়ে দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন।

মোহাম্মদ নুর হোসেন হিরু :

মনির হোসেনের মত তিনিও উত্তরা থানা শাখা ছাত্রদলের একজন নেতা (সাংগঠনিক সম্পাদক) ছিলেন। পাশাপাশি তিনিও একটি মার্কেটে দোকান নিয়ে ব্যবসা করতেন। তিনি নিখোঁজ হন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ২০১১ সালের ২০শে জুন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়। মনির হোসেনের সাথে তারও নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ব্যবসা কিংবা দলীয় পদ নিয়ে সৃষ্ট কোন্দলকে দায়ী করেন স্বজনরা।

মোহন মিয়া :

মুদি ব্যবসায়ী মোহন মিয়ার সাথে রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা কিংবা মামলা নেই। তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ২০১৮ সালের ১০ই জুন ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। যদিও তেমন কোনো তথ্য প্রমাণ মেলেনি। তবে তদন্তে জানা যায় আজিজুল হক শ্যামল নামের স্থানীয় একজনের সাথে তার জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ দীর্ঘদিনের। স্থানীয়দের ধারণা, শ্যামল নিজের লোকজনকে দিয়ে এমন একটা নাটক সাজিয়ে তাকে গুম করে থাকতে পারেন।

জাকির হোসেন :

২০১৫ সালের ৭ই এপ্রিল ঢাকার গুলশান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে জাকিরকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। তবে এর পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ জাকির হোসেনের রাজনৈতিক সংযোগ, প্রতিপক্ষের সাথে বিবাদ বা এমন কোনো ঘটনার আলামত পাওয়া যায়নি। তিনি কোনো কারণে স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়েছেন কিংবা পরকীয়া বা এমন কোনো ঘটনা এখানে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে কারো কারো ধারণা।

ইফতেখার আহমেদ দিনার ও জুনায়েদ আহমেদ :

২০১২ সালের ২রা এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ইফতেখার এবং জুনায়েদ। জুনায়েদ সিলেট মহানগর শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সংগঠন দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে তাদের আটক হওয়ার কোনো তথ্য মেলেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে দলের রাজনৈতিক কোন্দলের শিকার হয়েছেন তারা।

এম ইলিয়াস আলী :

গুম ইস্যুতে বিএনপির সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড নেম কুখ্যাত সন্ত্রাসী গডফাদার, ছাত্রলীগ নেতাসহ কয়েকজনকে হত্যাসহ গুরুতর মামলার আসামি ইলিয়াস আলী। ইলিয়াস গুমের পেছনে হাত রয়েছে বিএনপি নেতাদের, ভার্চুয়াল বৈঠকে মুখ ফসকে এমন বক্তব্য দিয়ে তারেক রহমানের রোষের মুখে পড়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেছিলেন ২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে গুম হওয়ার আগের রাতে ইলিয়াসের সাথে বিএনপির একজন নেতার তুমুল বিবাদের কথা। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ইলিয়াস গুম হওয়ার সাথে সিলেট বিএনপির কোন্দলকেও দুষেছেন দলের নেতারা। প্রয়াত বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান গ্রুপ এবং ইলিয়াস গ্রুপের দ্বন্দ্বে এর আগেও খুন হয়েছেন দলের কয়েকজন নেতা-কর্মী।

আনসার আলী :

২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে একটি দাবি করা হয়েছে WGEID-এর প্রতিবেদনে। যদিও আনসার আলী এবং তার পরিচয় কিংবা তার পরিবারের বক্তব্য কোনো কিছুই সুস্পষ্ট নয়। তার ব্যাপারে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য মেলেনি। পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সাইদুর রহমান কাজী :

যশোর পৌর আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। ২০১৭ সালের ৫ই এপ্রিল যশোর থেকে তাকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের মতে স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাকে হত্যা এবং গুম করেছে। কারণ সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সাথে ইতিপূর্বে তার কয়েকবার বিবাদ হয়েছিল।

মোহাম্মদ মোরশিদুল ইসলাম :

রাজশাহীর তাহেরপুর নিবাসী মোরশিদ বিএনপির কর্মী। ২০১৭ সালের ১৯শে এপ্রিল তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে অদ্ভূত ব্যাপার হলো, তাকে রাস্তা থেকে চোখ বেঁধে মোটরসাইকেলে তোলা হয়েছে। এমন অদ্ভূত প্রক্রিয়ায় কাজ করে না সরকারি কোনো সংস্থাই। বিশেষ করে চোখ বেঁধে নিতে হলে মোটরসাইকেল কেন ব্যবহার করা হবে- কাজের ধারার সাথে এসব তথ্য মেলে না। শুধু তা-ই নয়, কাউকে বললে প্রত্যক্ষদর্শীদের হত্যা করা হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো কাউকে আটক করার সময় এমন সিনেম্যাটিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে না। বরং এর সাথে রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষের ভাড়াটে মস্তানদের কাজের মিল পাওয়া যায়।

আবদুল কুদ্দুস মোহাম্মদ :

রাজশাহীর আরেক বিএনপি কর্মী কুদ্দুসকে ২০১৭ সালের ৬ই এপ্রিল মোরশিদ এর মত একইভাবে তুলে নিয়ে যায়। উভয়ের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা একই। একইভাবে চোখ বেঁধে, মোটরসাইকেলে তুলে এবং আশপাশের লোকজনকে হুমকি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিপক্ষের সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের একটা আঁচ করা যায় এসব ঘটনায়।

ফরিদ আহমদ সৈয়দ ও আলমগীর হোসেন :

লাকসাম বিএনপির একজন সক্রিয় সদস্য দুজনই। বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টাসহ বহু মামলার আসামি ফরিদ ও আলমগীর। তাদেরকে ২০১৪ সালের ১২ই জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ। যদিও সরকারি কোনো সংস্থা তাকে আটক করেছে বলে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

কল্পনা চাকমা :

‘৯৬ সালে ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনে মাত্র কয়েকদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া খালেদা জিয়াকে যখন গদি থেকে নেমে যেতে হয়, দেশে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুনঃ নির্বাচনের দিন ঘোষিত হয় ১২ই জুন। নির্বাচন শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পূর্বে গভীর রাতে পাহাড়ি মহিলা ফেডারেশনের (এইচডব্লিউএফ) নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহৃত হন। পাহাড়ি কয়েকটি সংগঠনের দাবি এতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জড়িত। যদিও সেসময় কল্পনার পরিবার, প্রতিবেশি এবং স্বজনরা এই ঘটনায় সেনাসদস্যরা জড়িত নন বলে নিশ্চিত করেন।

এ বিষয়ে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বর্ণনায় কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। দাবি করা হয়েছে, কল্পনার দুই ভাইকেও চোখ এবং হাত-পা বেঁধে অপহরণ করেছে সেনাবাহিনীর লোকজন। আবার দাবি করা হয়েছে তার ভাইয়েরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। রাতের আঁধারে চোখ-হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কেউ পালাতে পারে কি না, এটা যথেষ্ট ভাববার বিষয়। সরকার, কয়েকটি এনজিও, সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্তকারী দল এবং সুশীল সমাজসহ পৃথক তদন্তকারী সংস্থার প্রতিবেদনে এসব অসঙ্গতি উঠে এসেছে। অভিমত রয়েছে, কল্পনা ও তার পরিবার ভারতের ত্রিপুরায় বসবাস করছেন। তবে মামলাটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।

উপরোক্ত ঘটনাগুলোর বিবরণে অনেক কিছুই উঠে আসে। এই নিখোঁজদের মধ্যে এমন কয়েকজন রয়েছেন, যাদের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে বিএনপির সম্পৃক্ততার তথ্য রয়েছে। অনেকেই ২০-২৫ বছর আগে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। যেমন, কল্পনা চাকমার ঘটনার সাথে আওয়ামী লীগপন্থী লোকজনকে ভোটদানে বিরত রাখার একটা প্রচেষ্টার তথ্যও রয়েছে। বিএনপি নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের সেখানে প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল বলে তদন্তেও উঠে এসেছে। এমনও অনেকে রয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় সাজা হওয়ায় বিএনপি তাদেরকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাদের নাম এই তালিকায় তুলে বিএনপি এবং তাদের দোসরদের দাবি, এদেরকে নাকি বর্তমান সরকার কোথাও লুকিয়ে রেখেছে!

এখানে একটু ক্ল্যারিফাই করা জরুরি, গুম এবং নিখোঁজ-এর মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নিখোঁজ অর্থ যার সঠিক কোনো হদিস পাওয়া যায়নি এখনো, তিনি জীবিতও থাকতে পারেন। আর গুম বলতে বোঝানো হয়, যার জীবিত থাকার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, যাকে হত্যা করে লাশ অজ্ঞাতস্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগকারীরা নিশ্চিত।

মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, তালিকার বাইরে থাকা বিএনপি এবং তার দোসরদের দাবিকৃত অনেককেই জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। যার অন্যতম হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এবং সাবেক সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমেদ। যাকে বর্তমান সরকার ‘গুম’ করেছে বলে দাবি ছিল বিএনপির। যদিও পরবর্তীতে অবৈধ অনুপ্রবশ, নাম-পরিচয় বদলে পলাতক থাকায় ভারতীয় গোয়েন্দা পুলিশ তাকে আটক করেছিল। যদিও সেসময় সালাহউদ্দিন হাস্যকর দাবি করেছিলেন, তিনি কীভাবে ভারতে এসেছেন, জানেন না!

এভাবে আরও অনেকের ব্যাপারে সরকার যখন তদন্ত শুরু করে, ধীরে ধীরে বিএনপির তালিকাও ছোট হতে থাকে।

উল্লেখ্য, বিএনপির প্রভাবশালী নেতা এবং ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলাসহ দুর্নীতি ও নানা অপরাধের একাধিক মামলায় নিরুদ্দেশ হারিছ চৌধুরীর ঘটনাটি সবার জানা। তার পরিবার দাবি করেছিল, হারিছ দীর্ঘ ১৪ বছর বাংলাদেশেই আত্মগোপন করে ছিলেন। তার খবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতো না। এখন একইভাবে ইলিয়াস আলী বা তালিকার অন্যরাও যে আত্মগোপনে নেই, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? কাজেই নিখোঁজ হলেই যে সেটি গুম, এই তথ্যটি রাজনৈতিকভাবে মুখরোচক হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তদন্ত বা সত্য উদঘাটনের জন্য ফ্যাক্ট হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শুরুর দিকে বিএনপি বিএনপি এবং তার দোসরদের দাবি ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার দশ হাজারেরও বেশি মানুষকে ‘গুম’ করেছে। গালভরা একটা দাবি নিঃসন্দেহে। কারণ, দশ হাজার মানে ১-এর সাথে আরও ৪টা ০ যুক্ত করতে হবে। টাকার অংকে ১০,০০০ খুব বেশি কিছু না হলেও মানুষের সংখ্যা হিসেবে ১০,০০০ অনেক বড় একটি সংখ্যা। দশ হাজার মানুষকে কোনো ক্লু ছাড়াই ‘গুম’ করা কি আদৌ সম্ভব? বিএনপির সেই মৌখিক দাবি লুফে নিয়ে দেশবিরোধীতার দায়ে নিষিদ্ধ সংস্থা অধিকার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও ব্লাস্টসহ কয়েকটি সংস্থা যাচাই-বাছাই ছাড়াই সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করে।

এই ঘটনাগুলো নিয়ে হাইপ তৈরি করা হলো। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এদের মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে। যেমন, বিএনপি-জামায়াতের মৌখিক দাবি সম্বলিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেন দলগুলোর নেতারা। তাদের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, মানবজমিন, নয়া দিগন্ত, আমার দেশ … ইত্যাদি কিছু চিহ্নিত ঘরানার পত্রিকায়। সংবাদগুলো কপি-পেস্ট আকারে পুনঃ প্রকাশ করে বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আর এসব সংবাদসূত্রকে নথিভুক্ত করে অধিকার, আসক ও ব্লাস্ট। সংবাদপত্রগুলোর মতামত বিভাগে পেইড কলামিস্টরা নিজস্ব মতামত প্রকাশের সময় তথ্যসূত্র হিসেবে মানবাধিকার সংস্থা কিংবা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদকেই সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

অর্থাৎ, আবুল যে পকেটমার নয়, তার সাক্ষী সিঁদেল চোর বাবুল। আর সিঁদেল চোর বাবুলের সাক্ষ্য যে আমলযোগ্য, তার প্রমাণ- পকেটমার আবুল শপথ করে বলেছে, সিঁদেল চোর বাবুল সত্যবাদী সিদ্ধপুরুষ। তথাকথিত মানবাধিকারের দোকানদারদের সাক্ষী হলো পত্রিকা। আর পত্রিকার সংবাদের সূত্র হলো মির্জা ফখরুল, রিজভীদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি। ফখরুল-রিজভীদের কাছে ১০ হাজারের তালিকা চাইলে তারা জানান মানবাধিকারের দোকানদারদের ওয়েবসাইটে আছে ১০ হাজারের কথা। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের লিংক। মানে পরস্পরের পিঠ চাপড়ানোর মত ব্যাপার। এদের সাথে যুক্ত রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠা, দেশের খনিজ সম্পদ বিদেশিদের কাছে বিক্রিতে অত্যুৎসাহী বেশ কিছু ব্যক্তি, যারা সরকাবিরোধী প্রতিটি ইস্যুতেই একাট্টা। তারা এই ইস্যুটি নিয়ে সবচেয়ে সরব।

কিন্তু সরকার যখন শক্ত অবস্থানে গেল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি-জামায়াতকে হতবাক করে দিয়ে এই দশ হাজার ‘গুম’-এর তথ্যকে রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে হালকাভাবে না নিয়ে গুরুত্বসহকারে দেখল, তখন চমক ভাঙলো সবার। বিএনপি-জামায়াত তখন গড়িমসি শুরু করে। একপর্যায়ে দশ হাজার থেকে ‘কয়েক হাজার’ বলে বক্তব্য দিতে লাগলেন তারা। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তখন আরও চেপে ধরল তথ্য চেয়ে। এমনকি ভুক্তভোগীদের পরিবারের হদিসও জানতে চাইলো যখন, তখন মির্জা ফখরুল, রিজভীরা আমতা-আমতা শুরু করলেন। পরবর্তী কয়েক ধাপে সেই ‘কয়েক হাজার’ থেকে নামতে নামতে ‘কয়েকশ’ এবং শেষ পর্যন্ত একশ’র নিচে নেমে এসে ৭৬-এ গিয়ে ঠেকল।

এর আগে ৫ই মে হেফাজতে ইসলামের মতিঝিল তাণ্ডবের পর ৩ হাজার গুমের মিথ্যা অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা এবং দেশদ্রোহীতার দায়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল বিএনপির ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমান এবং তার বিতর্কিত সংস্থা ‘অধিকার’। সরকার ৩ হাজার মৃতের তথ্য চেয়ে চিঠি দিলে তথ্য দিতে ব্যর্থ হন আদিলুর। এক পর্যায়ে ৩ হাজার থেকে কমে সেই সংখ্যা ৬১-তে নামে। অথচ কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ সেরাতে ১৬ জন নিহত হয়েছিলেন। ১৬-কে উল্টে ৬১ করেন আদিুলর। হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের মাঝে থেকে দূরবর্তী বিভিন্ন জায়গার বাছাইকৃত ৬১ জনের একটি তালিকা দেয় ‘অধিকার’। কিন্তু সেই তালিকার প্রায় সবাইকেই পরবর্তীতে জীবিত বলে শনাক্ত করে বেসরকারি টিভি চ্যানেল একাত্তর টেলিভিশন। ফলে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয় ‘অধিকার’।

এবারও যখন ১০ হাজার থেকে ‘গুম’-এর সংখ্যা ৭৬-এ গিয়ে ঠেকল, অচিরেই তার মধ্যে ১০ জনের সন্ধানও মিলে গেল সরকারি বাহিনীগুলোর তৎপরতায়। দেখা গেল, তারা আত্মগোপনে ছিলেন এতদিন। এছাড়া ২৮ জনকে চিহ্নিত করা গেল দাগী আসামী হিসেবে, যারা মামলার সাজা কাঁধে নিয়ে নিরুদ্দেশ। যা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে।

কোল্ড ওয়ারের (স্নায়ুযুদ্ধ) সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয় কোনো নেতা, সামাজিক আন্দোলনে ওপরের সারিতে উঠে আসা কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াত, সেসব দেশের গোয়েন্দারা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বা বদ-উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে যেত। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, রাশিয়ান কেজিবিসহ অনেকেরই এ ধরণের রেকর্ড আছে।

বাংলাদেশে ৭৫-এর পর এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে স্বৈরাচার জিয়া ও স্বৈরাচার এরশাদের আমলে। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ফজলুর রহমান ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা। জিয়ার সময় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার কারণে। তিনি ছাড়াও আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী, যেমন- সাবের হোসেন চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম প্রমুখ এবং আওয়ামী ঘরানার নাগরিক সমাজের বহু সম্মানিত অরাজনৈতিক ব্যক্তি, যেমন- অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক শাহরিয়ার কবিরসহ অনেককেই তেমন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

অথচ বিএনপি-জামায়াতসহ দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয় কোনো নেতা, সামাজিকভাবে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নিখোঁজ হননি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। বিএনপির শীর্ষ সব নেতাই ইচ্ছেমত গণমাধ্যমের সামনে মিথ্যাচার ও গলাবাজি করে যাচ্ছেন, আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে রাস্তায় ভাঙচুর আর রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধণ করছেন নিশ্চিন্তে। কিন্তু অক্ষত অবস্থাতেই আছেন তারা। শুধুমাত্র নাশকতা ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত থাকায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা কারাগারে রয়েছেন। নিয়মিত আদালতে হাজিরাও দিচ্ছেন। কিন্তু নিরুদ্দেশ নন রাজনৈতিক কেউই।

অথচ যাদেরকে ‘গুম’ বলে দাবি করছে বিএনপি, ৬৬ জনের তালিকায় সরকারের মাথাব্যথার কারণ হতে পারেন, তেমন কেউই নেই। এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা প্রয়োজন, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও দেশের সকল নাগরিকের জীবনই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা দাগী আসামী বা দুর্ধর্ষ খুনি হলেও। সিভিলিয়ান অপরাধী হলে সেজন্য দেশের প্রচলিত আইন রয়েছে। আইন অনুসারে তার বিচার হবে। সামরিক সদস্য হলে তার জন্য সেনা-আদালত রয়েছে, নিজস্ব বিধান রয়েছে। তাই রাজনৈতিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের সন্ধান জারি রেখেছে সরকারি কয়েকটি সংস্থা। তাদের এমন তৎপরতার ফলেই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া বা স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকা অনেকেকে প্রকাশ্যে হাজির করা সম্ভব হয়েছে।

গত বছর আবু ত্ব-হা নামের একজন ইসলামি বক্তা ‘গুম’ হয়েছে দাবি করে বিএনপি-জামায়াত বেশ অপপ্রচার চালিয়েছিল। দেশজুড়ে তোলপাড় হয় বিষয়টি। পরে দেখা যায়, ত্ব-হা তার দুই স্ত্রীর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। এমনকি তার সন্ধানে তৎপরতা চলছে জেনেও তিনি প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেননি। যদিও পরে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাই তাকে বন্ধুর বাড়ি থেকে আটক করেন।

নিখোঁজ দাবিকৃত ৬৬ জনের মাঝে মাত্র কয়েকজনের পরিবারকে নিয়ে বিএনপি সমাবেশের আয়োজন করছে গত কয়েক বছর ধরে। বাকিদের পরিবারের কাছ থেকে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আজ অব্দি কোনো তথ্য দূরে থাক, অভিযোগ পর্যন্ত পায়নি। বিএনপি তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে রেখেছে নামকাওয়াস্তে। যাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সমাবেশ করে বিএনপি, তাদের কয়েকজনের পরিবারের দাবি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের পরিচয়ে নাকি তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কীভাবে বুঝলেন তারা সরকারি সংস্থার লোক? এমন প্রশ্নের জবাবে তাদের উত্তর- স্বাস্থ্যবান এবং ছোট করে ছাঁটা চুলের লোকজন মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছিল! এমন জবাব কি আদৌ যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য? এমন ছদ্মবেশে তো যে কেউই আসতে পারে। তাছাড়া ‘গুম’ করার উদ্দেশ্যেই যদি কেউ নিতে চায়, তারা কি এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে, ছদ্মবেশ না নিয়ে আসবে? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না অভিযোগকারীদের কাছে।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতি মোটেই উদ্বেগজনক নয় – জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে হতাশায় বিএনপি

এর আগে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সন্তান, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান-এর স্বামী আবু বকর সিদ্দিক নিরদ্দেশ হয়েছিলেন। সেসময় শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানকে অভিযুক্ত করে রিজওয়ানা দাবি করেছিলেন, তারা তার স্বামীকে ‘গুম’ করেছেন। কিন্তু ৩৫ ঘণ্টা পর বাসায় ফিরে এসে আবু বকর জানালেন, তাকে অস্ত্রধারী লোকজন অপহরণ করেছিল। সরকারি কোনো সংস্থা যদি কাউকে ‘তুলে নেয়’ তাহলে অস্ত্র প্রদর্শন করারই তো প্রয়োজন পড়ে না। যেতে বললেই যে কেউ আইনসঙ্গত কারণে বাধ্য হন। অথচ স্বামী ফিরে আসার পর রিজওয়ানা ভোল বদলে সাংবাদিকদের বলেছিলেনন, আমার কোনো শত্রু নাই, কেউ আমার স্বামীকে কেন তুলে নিয়ে যাবে বুঝতে পারছি না…। না বুঝে থাকলে একজন আইনজীবী হয়েও দুজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তির সম্মানহানি করেছিলেন তিনি, সেজন্য ক্ষমা পর্যন্ত চাননি।

এই যে ‘গুম’ নামক সাম্প্রতিক হাইপ, এতে আরেকটু মশলা যোগ করেছে সুইডেনে পলাতক ইউটিউবার তাসনীম খলিল ও যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্ট ডেভিড বার্গম্যানের গুজবভিত্তিক পোর্টাল ‘নেত্র নিউজ’ প্রযোজিত একটি বস্তাপচা নাটক। সিআইএ’র উইং এনইডি’র ৫০০ কোটি টাকার ফান্ডিংয়ে পরিচালিত নেত্র নিউজ-এর দুই সম্পাদক এবং বিদেশে পলাতক কয়েকজন ইউটিউবারের সম্মিলিত অশ্বডিম্ব প্রযোজনা সেই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল দেশদ্রোহিতা ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার কারণে বরখাস্তকৃত সেনা সদস্য হাসিনুর রহমান। যার সম্পর্কে ওপরে বিস্তারিত বলা হয়েছে। যে নিজেই ছিলেন ৩৪ জনকে গুমের কারিগর।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে হেয় প্রতিপন্ন করার এই ঘৃণ্য অপচেষ্টার মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টের চেষ্টা করেছে কয়েকটি গোষ্ঠী। তারা আবার এসব নিয়ে নালিশ দিয়েছে মার্কিন বিভিন্ন সংস্থাকে। যেসব সংস্থার পেছনে লবিং করানোর জন্য বিএনপি-জামায়াত বিগত কয়েক বছর ধরে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঢেলেছে।

[অনুসন্ধান – বাংলাদেশে গুম, খুন ও মানবাধিকার : তালিকাভুক্তরা কে, কোথায়]

বিভিন্ন দেশেই এমন নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিখোঁজের এমন ঘটনা লাখ লাখ। এই ঘটনাগুলো কেন ঘটে, তার একাধিক কারণ রয়েছে। অদ্ভূত ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের এমন ঘটনাকে ‘গুম’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে আর অন্যদের ক্ষেত্রে শুধুই নিখোঁজ! নিখোঁজ ব্যক্তির হদিস পাওয়ার ক্ষেত্রেও সেসব দেশের সাফল্য তেমন কিছু নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার অভিযোগকারীদের কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পরই কয়েকজনকে ‘স্বেচ্ছায় আত্মগোপনরত’ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে প্রকাশ্যে হাজির করতে সমর্থ হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেউ নিখোঁজ হলেই কি ধরে নিতে হবে যে তিনি ‘গুম’ হয়েছেন? বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, অনেক মামলার আসামী গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেন। অনেক সময় দেখা যায়, দেনার দায়ে ব্যক্তি আত্মগোপন করেন। কেউ কেউ অন্যদেশে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আবার অনেকে বিভিন্ন কারণে নিখোঁজ হন। অপঘাতে মৃত্যু, আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের যে নিখোঁজের তালিকা দিয়েছে মানবাধিকারের দোকানদাররা, তারা আদৌ গুম হয়েছেন নাকি নিজেরাই আত্মগোপনে আছেন, এটি নিঃসন্দেহে তদন্তের বিষয়। তদন্ত ছাড়াই তাদেরকে ‘গুম’ বলা কতটা আইনসিদ্ধ, সে প্রশ্ন অবশ্যই আছে।

আরও পড়ুন :