জিয়া

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্ম ও মৃত্যুদিবসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং প্রবাসে বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ। সেখানে উপস্থিত হন বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। অনেক গরমা-গরম বক্তৃতা দেওয়া হয় এসব অনুষ্ঠানে। কেন্দ্রীয় নেতারাও গণমাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি দেন। কিন্তু সব কিছুর পরেও বিএনপির কোনো নেতাই জিয়া হত্যার বিচার দাবি করেন না। এমনকি লন্ডন থেকেও আসেনা তেমন কোনো বার্তা।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বিএনপি কেন দলের প্রতিষ্ঠাতার হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না? স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের নবম পাঠক জিয়া, সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান, ক্ষমতা দখলকারী স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জিয়া বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ইতিহাসের অংশ। তার পরিবার একাধিকবা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলেও কেন জিয়া হত্যার বিচার হলো না আজ পর্যন্ত? আসুন, ইতিহাস কী বলে দেখি-

আরও পড়ুন : জিয়ার কফিনে লাশ নয়, ছিল পতেঙ্গা থেকে আনা চারটি পঁচা তরমুজ

সময়কাল ১৯৮১ সালের ৩০শে মে শুক্রবার ভোররাত। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির রাত। ফজরের আজানের কিছু আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। কেটে গেছে চার দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ৪০ বছরে কি আপনি কোথাও একবারও শুনেছেন বিএনপি জিয়া হত্যার সুষ্ঠু বিচার চায় বা চেয়েছে? ‘জিয়া হত্যার বিচার চাই’— এই দাবি জিয়ার স্ত্রী; বাংলাদেশের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, ছেলে তারেক ও কোকো কিংবা বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীর মুখে কি শুনেছেন? এই স্বাভাবিক কথাটিই কেন শুনি না, এটি কি ভেবেছেন কখনো?

৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছিলে। তখনকার অনেক সেনা কর্মকর্তার বিশ্বাস ছিল, একটু ঠিকমতো বুদ্ধির খেলা খেলে বন্দুক চালাতে পারলেই ক্ষমতার শিখরে আরোহণ সম্ভব। একটা ডগ রেস শুরু হয়েছিল যেন। ক্ষমতা দখলের এই লড়াইয়ে চতুরতার সঙ্গে জিয়া জয় পেয়ে যান। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মেরুদণ্ড ভেঙে জিয়া ৭৭-এ রাষ্ট্রপতির গদিতে আরোহন করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত এই সময় মোটেই নিস্তরঙ্গ ছিল না। জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ক্যু হয়। জিয়া সবকটি অভ্যুত্থান অত্যন্ত শক্ত হাতে এবং নৃশংস কায়দায় দমন করেন।

সামরিক বাহিনীর প্রায় ৫ হাজারের সদস্যকে বিভিন্ন উপায়ে রাতের আঁধারে ফায়ারিং স্কোয়াডে বা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। তাদের কী অপরাধ ছিল, অনেকেই জানেন না। এমনকি ক্যু-চেষ্টা করেছেন, এমন কারো সাথে নাম মিলে যাওয়ায় একাধিক ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়েছিল। কোর্ট মার্শালের নামে মৃত্যু পরোয়ানায় একের পর এক সই করে গেছেন জিয়া। এক হাতে ব্রেকফাস্ট করছেন, অপর হাতে সই করেছেন। এমনকি বিদেশ যাত্রার সময় বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েও পরোয়ানায় সই করার রেকর্ড আছে তার।

ঘটনাচক্রে সেই জিয়াউর রহমানই প্রাণ হারান একদল সেনা সদস্যদের দ্বারা। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে তারিখে একদল সেনা সদস্য চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করেন। যার বর্ণনা, উদ্দেশ্য আর পরিকল্পনাকারীদের নিয়ে আজও বিভিন্ন প্রশ্ন আছে। আছে নানা অনুসন্ধানের জায়গা।

তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি সম্ভবত এটা যে, এই ঘটনার বিচার চাওয়াতে তার পরিবারের কেউই কখনো আগ্রহী ছিলেন না। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এতটুকু বোঝা যায়, জিয়াউর রহমানের গঠিত বিএনপি, দলের নেতা-কর্মী যারাই আছেন, তারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক, শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা (নতুন সংযোজন- প্রথম মুক্তিযোদ্ধা), বহুদলীয় (যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতসহ) গণতন্ত্রের প্রবক্তা ইত্যাদি নানা আরোপিত উপমা লাগিয়ে মহিমান্বিত করেন। কিন্ত ‍আদতে তাদের কেউই আন্তরিকভাবে জিয়া বা তার মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।zia3

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জিয়া অসংখ্য সেনা সদস্য ও কর্মকর্তার প্রাণ নেন অভ্যুত্থানের অজুহাতে। সেই জিয়া তারই বিশ্বস্ত সেনা কর্মকর্তাদের হাতে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে প্রাণ হারান (পালাতে গিয়ে পিঠে গুলি খেয়ে)।

এই ঘটনার দু’দিন পরেই চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা মো. মোকাররম একটি মামলা করেছিলেন ১০ জনের নামে। প্রধান আসামি মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টে বিচারের মুখোমুখি করার আগেই হত্যা করা হয়েছিল রহস্যজনক কারণে। আর অন্যদের সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। যেদিন এই সেনা কর্মকর্তাদের রায় কার্যকর হওয়ার কথা, তার আগেরদিন সে সময়কার ১৫ দলের নেতাদের একটি দল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে রায় বাতিলের চেষ্টা করেন। Abdus-Sattar

কারণ, এই মামলার যে ৯ জন আসামি, তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বের বিষয়টি সবার জানা ছিল। ওই ৯ জনের ফাঁসি যেন না হয়, এই আবেদন বিচারপতি সাত্তারের কাছে করেছিল ১৫ দল। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার তাদের আবেদন মঞ্জুর করেননি। পরদিনই বাকি ৯ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।

৩০শে মে’র সেই ঘটনার প্রায় ১ বছর পরে ১৯৮২ সালের ১২ই জুন ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুহুল ইসলামের নেতৃত্বে। অন্য ২ জন সদস্য ছিলেন বিচারপতি এ টি এম আফজাল এবং খুলনার সেশন জজ সৈয়দ ফরিদুল ইসলাম। ঠিক হয়েছিল, তারা এই ঘটনার তদন্ত করবেন যে কারা, কী উদ্দেশ্যে এই পরিকল্পনা করেছিল এবং এর পেছনের লোকগুলো কারা? অর্থাৎ পরিকল্পনাটা কোথা থেকে হয়েছে, কীভাবে হয়েছে— এই বিষয়গুলো, এই তথ্যগুলো যেন উদঘাটিত হয়।

৩ সদস্যের এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্ত করে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন এবং যথাসময়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদনটি আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।

এ টি এম আফজালকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারা কি সেই প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছিলেন? এ টি এম আফজাল বলেছিলেন, আমরা যথাসময়ে সেটি জমা দিয়েছি এবং সেটি অনেক পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন। তো, সেটি কি প্রকাশিত হয়েছে? এ টি এম আফজাল বলেছিলেন, না, প্রকাশিত হয়নি।

এই অপ্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন— কী ছিল এই তদন্ত প্রতিবেদনে বা কী থাকতে পারে? যেহেতু এটি প্রকাশিত হয়নি, তাই এটি নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। গবেষণার ফলাফলে তারা যেটা জানিয়েছেন সেটা হলো— যে তদন্ত প্রতিবেদনে এই ঘটনার পেছনে জিয়া পরিবারের সদস্য এবং জিয়ার ঘনিষ্ঠ লোকজনের নাম অর্ন্তভুক্ত ছিল। সে কারণেই এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়নি।

আরও পড়ুন : খালেদা সরকার যে কারণে জিয়া হত্যা মামলাটি চিরতরে ধামাচাপা দিয়েছিল

পরবতীতে ১৯৯১ সালে জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি যখন ক্ষমতাসীন হয়, তখন এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটিকে স্থগিত ঘোষণা করে। এটি সবার মনে প্রশ্ন তৈরি করে, জিয়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, বিএনপি সরকার দেশ চালাচ্ছে, ক্ষমতায় আছে, তারা মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থগিত করে! নিশ্চয়ই গবেষকরা যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, যে তার পরিবারের লোকজন বা তার ঘনিষ্ঠজনেরা এই ঘটনার সাথে জড়িত আছেন, কোথাও না কোথাও কথাটির মধ্যে সত্যতা আছে।

পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হলে ১৯৯৭ সালের ২৬শে নভেম্বর এই মামলার ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অর্থাৎ মামলাটি চলতে আর কোনো বাধা থাকল না। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মামলাটি চালু হয়েছিল, এই মামলার সাক্ষী ছিল ৩৬ জন। সাক্ষীদের মধ্যে জিয়ার বিধবা স্ত্রী খালেদাও ছিলেন। ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, যিনি হত্যাকাণ্ডের দিন গভীর রাত পর্যন্ত জিয়ার সাথে বৈঠক করছিলেন। তিনিও সার্কিট হাউজে পাশের কক্ষে ঘুমিয়েছিলেন সেই রাতে। যদিও পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন, সেই রাতে তিনি নাকি কিছুই টের পাননি!

দীর্ঘদিন ধরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে এই মামলার সাক্ষী যারা ছিলেন, তারা আদালতে সাক্ষী দেওয়ার তারিখগুলোতেও উপস্থিত হননি এবং প্রায় ১৬৮ বার সাক্ষীদের গাফিলতির কারণে মামলার সাক্ষী নেওয়ার তারিখ পিছিয়েছে। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে নাটকীয়ভাবে আবারও মামলাটি খারিজ করায়।

এখানে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নটি হচ্ছে— জিয়া একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যে দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী এখনো বর্তমান। তার স্ত্রী দুই-দুইবার ক্ষমতায় ছিলেন, ছেলে তারেক রহমানও ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তারা এই মামলাটি কেন হিমাগারে পাঠিয়ে দিলেন? কেন তারা নিজেদের পক্ষ থেকে বিচারের দাবি উত্থাপন করলেন না আজ পর্যন্ত? এই বিষয়টি আসলে খুবই রহস্যজনক। কারণ তারা নিজেরা বিচারের দাবি তোলা তো দূরের কথা, বিচারের জন্যে আওয়ামী লীগ সরকার যে মামলার ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছিল, বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে সেই মামলই খারিজ করিয়ে নিল।

জিয়াউর রহমানকে বিএনপি বা দলটির সমর্থকরা প্রায়ই স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক কিংবা ভাঙা স্যুটকেসের মালিক ছিলেন, তার কোনো সম্পদ ছিল না (যদিও পরবর্তীতে আলাদীনের চেরাগের জ্বীন এসে অঢেল সম্পদ দিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে)— এইসব কথা বলে বলে গুণকীর্তনই করেন, কিন্তু কেউই বিচারের বিষয়টি মুখে তোলেন না। দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থক, পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়-স্বজন বা তার ঘনিষ্ঠজন— কেউই চান না বিচার হোক।

আরও পড়ুন : মৃত্যুদিবসেও জিয়া হত্যার বিচার চায়নি কেউ : খালেদা-তারেক এবং নেতা-কর্মীরা কেন বিচার চায় না?

‘আমার বাবা জিয়া হত্যার বিচার চাই’— এই কথাটা কি কখনো শুনেছেন তারেকের মুখে? কিংবা স্বামীহারা দুইবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখে বিচার চাওয়ার কথা শুনেছেন? কিংবা নিদেনপক্ষে এই বিষয়ে একটি পদক্ষেপের কথা কি মনে করতে পারেন? বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর মুখে কি শুনেছেন যে বিচার চাই? বরং যে মামলার বিচারের পথ খুলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, সেটিও হিমাগারে পাঠালো বিএনপি। মামলার কার্যক্রম শেষ করে দিল। বিএনপি যতই বলুক তারা জিয়ার আদর্শের অনুসারী, জিয়ার নামে সমালোচনা শুনলে তাদের রক্ত গরম হয়ে যায়, কিন্তু এসব যে লোক দেখানো, তা যে কেউই বলবে।

[জিয়া হত্যাকাণ্ডে ঘনিষ্ঠরা জড়িত থাকায় তদন্ত রিপোর্ট হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন খালেদা]

পাঠক, একটু বিবেচনা করে দেখুন। এখানে মামলার তারিখ এবং ঘটনার বিস্তারিত দেওয়া হলো। এখন নিজেরাই বিশ্লেষণ করে দেখুন। গবেষকরা বলেছিলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার পেছনে জিয়া পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠরা জড়িত ছিল। আর তাই এটি ধামাচাপা দিতেই কি খালেদা-তারেক গোষ্ঠী চায় না জিয়া হত্যার বিচার হোক? এ কারণে নেতা-কর্মীরাও কখনো জিয়া হত্যার বিচার চায় না।

আরও পড়ুন :