
থাইল্যান্ডের ব্যাংককভিত্তিক সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশান ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিক বাংলাদেশ সম্পর্কিত মানবাধিকার প্রতিবেদনটি খেয়াল করেছেন কী? না করে থাকলে করুন। সেটা আদৌ কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা দ্বারা পরিচালিত প্রতিবেদন নয়। বরং বিএনপি-জামায়ত সরকারের সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমানের বিতর্কিত বেসরকারি সংস্থা ‘অধিকার’ এর প্রতিবেদন সেটি।
সেখানে অধিকার ও আদিলুর যেসব ছবি প্রকাশ করেছেন, সেগুলোতে দেখা যায় যে- শুধু ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মানুষের ব্যাপারে একটি শব্দও লেখা হয়নি সেখানে।
মানবাধিকার প্রতিবেদনের ছদ্মবেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে সাবেক জাসদ নেতা ও বিএনপি’র লয়ালিস্ট আদিলুর রহমান ৪২ পৃষ্টার যে প্রতিবেদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে, সেটা আসলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতের একটি প্রতিবেদন। কিন্তু এটিকে দলীয় অভিযোগ হিসেবে না দিয়ে চতুর বিএনপি-জামায়াত তাদের অন্যতম থিংকট্যাঙ্ক আদিলুর রহমানের প্রতিষ্ঠান অধিকারের মাধ্যমে জমা দিয়েছে।
মূলত মানুষকে আগুন দিয়ে পোড়ানো এবং নাশকতার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে উগ্রবাদের মদতদাদা দল বিএনপি ও জামায়াত। এজন্য মানবাধিকার সংস্থার ক্যামোফ্লেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন মনগড়া এ একপেশে প্রতিবেদন দিচ্ছে তারা।
বিএনপি-জামায়াত এবং অধিকারের মধ্যকার সম্পর্ক কি- তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হবে আরেকটু পর। এই অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা আদিলুর রহমান খানের রাজনৈতিক মিশন এবং অধিকার এর কাজের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন সেখানে।
এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থাও বাংলাদেশের যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেই সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এই আসক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য একজন পাকিস্তানি নারী, তার নাম হামিদা হোসেন।
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার স্বামী ড. কামাল হোসেন। এছাড়াও গণফোরাম নামে আরেকটি রাজনৈতিক দলেরও প্রধান ড. কামাল হোসেন। এই দম্পতির জামাই ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লেখালেখি করে বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল।
এমনকি করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও বার্গম্যান চক্র তাসনিম খলিলদের মতো নামমাত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নামে কুৎসা রটিয়েছে। ড. কামালের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট হেরে যায়, এরপর থেকেই উগ্রবাদীদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার নীলনকশা বাস্তবায়নে কাজ করছে বার্গম্যান। বার্গম্যানের আইনজীবী স্ত্রী সারা হোসেন এখনও বাংলাদেশের সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভিন্ন বিষয়ে একপেশে তথ্য সরবরাহ করে আসছে।
তবে ১৬ জুলাই ২০১২ সালে, দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র নিয়ে বিতর্ক শুরু হরে ব্যক্তিগতভাবে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমে কলাম লিখেছেন আসক-এর নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। সেখানেও বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে নিজেদের নির্দোষ দাবি করার পাশাপাশি তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে- হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে তারা তথ্য সরবরাহ করে থাকে, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মতামত দেন যারা, তারা ও তাদের সংস্থাগুলো ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি বিএনপি-জামায়াতের মতো উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো বিএনপির থিংকট্যাংক আদিলুর রহমানের ‘অধিকার’, আওয়ামী বিরোধী জোটের সমন্বয়ক ড. কামাল হোসেনের স্ত্রী হামিদা হোসেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘আসক’, তাদের জামাই বার্গম্যান ও তার সহকর্মী তাসনিম খলিলের ‘নেত্রনিউজ’, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ও তার স্ত্রী সিগমা হুদার ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’, কুখ্যাত রাজাকার সবুর খানের নাতি ও বার্গম্যানের অন্যতম সহচর ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম।
এই চক্রটির সঙ্গেই রহস্যময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের; একারণে বাংলাদেশের উগ্রবাদী দলগুলো দেশবিরোধী অপপ্রচারের জন্য যেসব একপেশে রাজনৈতিক প্রতিবেদন তৈরি করে এবং সেগুলোকে মানবাধিকার রিপোর্ট বলে চালানোর উদ্যোগ নেয়; ঠিক তখনই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেগুলোকে মানবাধিকার প্রতিবেদন হিসেবে বৈধতা দিয়ে দেয় কোন কোন একটিভিস্ট।
শুধু তাই নয়, হিউম্যান রাইটস এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এসব প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারবিরোধী মন্তব্য প্রদান করেন তারা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত গত কয়েক বছরের কিছু প্রতিবেদন খেয়াল করুন। আল-জাজিরা থেকে শুরু করে পশ্চিমাদের মিডিয়াগুলোতে বিএনপি-জামায়াতের অপিনিয়ন লিডার হিসেবে নিয়মিত বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন সেই একটিভিস্ট।
আরও পড়ুন :
- হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদন: মানবাধিকার বাঁচলে দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে
- Bangladesh scrapping rights group’s licence a ‘chilling message’
- Without a trace: Enforced disappearances in Bangladesh
- Bangladesh minorities bear brunt of violence
- HRW calls for UN probe into Bangladesh ‘enforced disappearances’
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিচেল ব্যাচেলেট। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। এমনকি বিরোধীদলের নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন তিনি। এছাড়াও স্থানীয় অধিকার কর্মী এবং সিভিল সোসাইটির লোকজনের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। সেইসূত্রে সমাজকর্মী ও অধিকারকর্মীর ছদ্মবেশে তার সঙ্গে আবারো দেখা করেন বিএনপি-জামায়াতের এজেন্টরা।
খেয়াল করে দেখবেন, এই তথাকথিত নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা কিন্তু কখনোই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। এমনকি ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে বিএনপি-জামায়াত সরকারের রাষ্ট্রীয় মদতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা এবং সেই ঘটনায় নিহত ২৪ জন ও আহত শতাধিক ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ এবং হামলার ঘটনায় চিহ্নিত অপরাধীদের বিচারের দাবিও জানায় না।
এমনকি তারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর হামলায় নিহত-আহত সাধারণ ও আওয়ামী ঘরানার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার চেয়েও কখনো বিবৃতি দেয় না। এমনকি হেফাজতের তাণ্ডবে সারা দেশে নির্মম হামলার শিকার ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়েও তারা মুখ বন্ধ রাখে।
যানবাহনে ও মানুষের বাড়িতে বিএনপি-জামায়াতের পেট্টোল বোমা হামলা, আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা; এমনকি আওয়ামী নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের জঙ্গিবাদী হামলায় নিহত হলেও তারা প্রতিবাদ করে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময় সারা দেশে উগ্রবাদী উস্কানির কারণে অনেক মানুষের বাড়িঘরে লুটপাট-ভাঙচুর চালায় বিএনপি-জামায়াত মদতপুষ্ট উগ্রবাদী সংগঠনগুলো, হত্যা করে অনেক মানুষকে; কিন্তু এই সুশীল ছদ্মবেশীদের মানবাধিকার বোধ কাজ করে না।
তাদের মানবাধিকার কেনো শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে কাজ করে, তার কিছু কারণ তো অন্তত সবার জানা উচিত। এই ইন্টার নেটের যুগে ছদ্মবেশীদের মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের আসল মুখগুলো সম্পর্কে চলুন সংক্ষেপে জেনে আসি।
সুশীল ছদ্মবেশী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এর রাজনৈতিক পরিচয় :
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় দেয় একটি মহল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রিজওয়ানা একজন উগ্রবাদী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান এবং উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি আওয়ামী-বিরোধী রাজনৈতিক চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে, উভয় সময়েই তার পিতা সৈয়দ মহিবুল হাসান বৃহত্তর সিলেট বিভাগে কট্টর আওয়ামী-বিরোধী রাজনীতি চর্চা চালাতেন। সেই সূত্রেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার পর খুনিদের মদতদাতা স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তার।
এখন বাংলাদেশ পরিবেশবাদী আইনজীবী সমিতি (বেলা)-এর প্রধান নির্বাহী পদকে ছদ্মবেশ হিসেবে ব্যবহার করে বিদেশি গোয়েন্দাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
রিজওয়ানার পিতা মহিবুল হাসান স্বাধীনতার আগে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মুসলিম লীগের উগ্রবাদী ঘরানার একজন নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময় ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে প্রচারণা চালাতেন তিনি। এরপর ১৯৭০ সালে বাঙালি জাতির জাগরণের চূড়ান্ত মহেন্দ্রক্ষণে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি জাতি, সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট করেন তিনি।
তবে নৌকা প্রতীকের পক্ষে দেশজুড়ে তীব্র জনজোয়ারের কারণে ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে গো-হারা হারেন পাকিস্তানিদের এজেন্ট ও কট্টরপন্থী সৈয়দ মহিবুল হাসান। এছাড়াও পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে নির্বাচন করেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছেও জামানত হারাতে হয় তাকে।
এলাকায় আপামর জনতার মধ্যে কোনো জনপ্রিয়তা না থাকলেও, শুধু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার কারণেই স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয় তার। ফলে সেনাপ্রধানের পদে থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর রাজনৈতিক দল গঠনের সময় জেনারেল জিয়াউর রহমান কাছে টেনে নেন তাকে। ১৯৭৯ সালের সাজানো নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রিজওয়ানার বাবা মহিবুলকে জিতিয়ে আনেন জিয়াউর রহমান। এমনকি স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও দেন তুলে দেন তার হাতে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই দলটির একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় এই ব্যক্তি।
সেই ধারাবাহিকতাতেই ১৯৯১ সালে বিএনপির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ও স্বৈরাচার জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও তাদের পুত্র তারেক রহমানের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি। যার ফলশ্রুতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের হয়ে আইনজীবী পরিচয়ের আড়ালে বিভিন্ন আন্ডারকাভার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
সিগমা হুদার মানবাধিকার: চাঁদাবাজির অস্ত্র নাকি রাজনীতির হাতিয়ার
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা, দলটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার আদরের স্ত্রী সিগমা হুদা। পেশায় আইনজীবী হলেও নিজেকে সমাজসেবক বলে পরিচয় দেন তিনি। মূলত, বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তথাকথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের ভবন বানানোর ছদ্মবেশে ২০০৩ সালে অবৈধভাবে রেলওয়ের জমি দখল করে তারা। ২০০৬ সালে সেখানে তৈরি করে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ভবন।
তবে বিএনপি সরকারের পতনের পর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, ২০০৮ সালে সেই কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমি দখলের মামলা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরপর আদালতের নির্দেশে সেই ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের ভবন ভেঙে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এমনকি মানবাধিকারের ছদ্মবেশে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে তাদের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনও মামলা দায়ের করে। দুদকের নথি থেকে জানা যায়, পাচার করা মোট ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা দিয়ে সিগমা হুদা ও দুই মেয়ে যুক্তরাজ্যের সারে কাউন্টির ডেনহাম রোডে একটি ফ্ল্যাট এবং লন্ডনের বারউড প্লেসে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ২০০৭ সালে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার আদালত তাকে তিন বছরের দণ্ড ঘোষণা করে। ‘খবরের অন্তরালে’ খবর নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনার ছদ্মবেশে এবং বিএনপি সরকারের প্রভাব ব্যবহার নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন এই সিগমা হুদা।
পরবর্তীতে সিগমা হুদার স্বামী নাজমুল হুদা ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালাইন্স’ নামে একটি আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী জোট গঠন করে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন। তবে ভোটে গো-হারা হেরে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তারপরও প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা হিসেবে বিএনপির সঙ্গে তার সবসময় একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। এমনকি তার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা আগামীবার বিএনপি থেকে সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ গোপন যোগাযোগ বলে বিএনপি সূত্রেই জানা গেছে। মূলত বিএনপি থেকে মেয়ের মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে কাজ করে চলেছেন সিগমা হুদা।
আরও পড়ুন :
- নাজমুল হুদাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ
- রিভিউতেও পার পেলেন না নাজমুল হুদা দম্পতি
- এবার ধানের শীষ চাইবেন নাজমুল হুদা (ভিডিও)
- ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার স্ত্রী সিগমা হুদার জামিন
- আ.লীগ-বিএনপি থেকে প্রত্যাখ্যাত নাজমুল হুদা এখন ‘ঘরবন্দি’
আদিলুর রহমানের ‘অধিকার’ প্রকৃতপক্ষে কাদের জন্য কাজ করে
আইনজীবী আদিলুর রহমান নিজেকে পরিচয় দেন একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আওয়ামী-বিরোধী রাজনৈতিক বলয় তথা জাসদ-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও, পরবর্তীতে বিএনপির হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় প্রভাব খাটিয়ে ‘অধিকার’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এমনকি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির হয়ে বিভিন্ন এজেন্ডা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হওয়ার কারণে বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হয় আদিলুর। যার পুরস্কার স্বরূপ ২০০১ সালে বিএনপি আবার সরকার গঠনের পর তাকে সরকারি আইনজীবী হিসেবে তথা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়।
সে সময় বিএনপি-জামায়াতের তত্ত্বাবধানে গজিয়ে উঠা জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের বোমা হামলায় শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের প্রাক্তন মন্ত্রী ও নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ ১৩৭ জন মৃত্যুবরণ করেন। আহত হন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ ১৪৫৮ জন।
হবিগঞ্জে বোমা হামলায় প্রাণ হারান প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আ স ম কিবরিয়া। বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের গাজীপুরের এমপি আহসানউল্লাহ মাস্টার। জামায়াতের হামলায় মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউনূস।
হরকাতুল জিহাদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ। সিলেটে শাহজালালের দরগায় গ্রেনেড হামলায় আহত হন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরী।
২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসে মৃত্যু হয় হিন্দু সমাজের বহু লোকের। বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় পূর্ণিমাসহ অনেক কিশোরী-তরুণী, এমনকি শিশুও। ঘরছাড়া হয় বহু হিন্দু পরিবার। কুপিয়ে আহত করা হয় এদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে।
২১ আগষ্ট, ২০০৪ প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় চালানো বাংলাদেশের ভয়াবহতম বোমা হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা ও কর্মী। মারাত্মক আহত হন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ শতাধিক নিরীহ মানুষ। এ হামলার ধকল সামলাতে না পেরে মোহাম্মদ হানিফও মারা যান পরে।
এ সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা তো দূরের কথা, বরং মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে অনেক কর্মীকে বোমা হামলার সাজানো মামলায় জড়ানো হয়েছিল। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়ার নাটক।
এছাড়াও ২০০৫ সালে সারাদেশে একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, দেশের শিক্ষক-সাংবাদিক-বুদ্ধীজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ময়মনসিংহ সিনেমা হলে বোমা হামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল বরেণ্য ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটক করা হয়েছিল লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে।
কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, একজন সহযোগী অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষে তো আর রাষ্ট্রের সমস্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়? কিন্তু এমন একটি রাষ্ট্রীয় পদে থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলেও একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কাজের প্রতিবাদ করতে বাধা কোথায়! আদিলুর রহমান কি বিএনপি-জামায়াতের সময় সংঘটিত ওইসব লাগামহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ব্যর্থতার প্রতিবাদ করেছিলেন? পদত্যাগ করেছিলেন?
তা তো করেননি! বরং তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহায়ক শক্তি হিসেবে ঘটনাগুলোকে আইনি বৈধতা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। তারপর আবার ক্ষমতার বাইরে এসে একজন মানবাধিকার কর্মীর তকমা গায়ে লাগিয়ে একের পর এক তথ্যবিকৃতির মাধ্যমে মানুষের ‘পারসেপশন’ পরিবর্তনের অসৎ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
বাস্তবতা হলো, বিএনপি-জামায়াত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেন আদিলুর রহমান। ফলে বিএনপি-জামায়াতের নীতি-নির্ধারণী শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততা অর্জন করেন তিনি। ফলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সম্মতিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা তথা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তাকে নিয়োগের চূড়ান্ত শর্টলিস্টে নাম রাখা হয়।
কিন্তু ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের পতন হলে সেই প্রক্রিয়া থমকে যায়। দেশের শাসন ব্যবস্থা চলে যায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। পরিস্থিতি বুঝে পদত্যাগ করেন আদিলুর। এরপর বিপুল ভোটে জিতে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
কিন্তু তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর নির্বাহী পরিচয় দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের এডেন্ডা বাস্তবায়নে আবারো আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচারণায় মেতে ওঠেন আদিলুর। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পটভূমি সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
মূলত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটে জড়িত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত দেশদ্রোহীদের বিচার শুরু হলে; যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মাঠে নামেন আদিলুর। তার আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী পরিচয় ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমগুলোকে প্রভাবিত করতে থাকেন তিনি। বিশেষ করে, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামকে পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশে অভ্যুত্থান ঘটানোর যে ষড়যন্ত্র করেছিল বিএনপি-জামায়াত, সেই চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত এই আদিলুর।
২০১৩ সালের মে মাসে রাজধানীর শাপলা চত্বরে বিশৃঙ্খল হেফাজত কর্মীদের তাণ্ডবে যখন অতিষ্ট দেশবাসী, তখন তাদের নাশকতা থামাতে সেখানে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খরা বাহিনী। সেই রাতের সংঘর্ষে ১১ জন পুলিশ মোট ১৬ জন ব্যক্তি মারা যায় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে ষড়যন্ত্র বিফল হওয়ায় ক্ষুব্ধ চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তথ্যসন্ত্রাসের মাধ্যমে আরেক অপতৎপরতা চালায়।
তারা হেফাজতে ইসলামকে দিয়ে প্রথমে গুজব ছড়ায়ে যে- তাদের ৩ হাজার নেতা-কর্মীকে সরকার শাপলা চত্বরে হত্যা করেছে, আর সেই লাশ রাতারাতি গুম করে ফেলেছে। এসব উদ্ভট দাবি প্রত্যাখ্যান করে সরকার যখন নিহতদের নাম-পরিচয় জানতে চায়, তখন হেফাজতে ইসলাম পিছু হটে। কারণ এটি মিথ্যা প্রচারণা। এটিও ছিল সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উস্কে দেওয়ার কৌশল। পরে সেই হাজার হাজার কাল্পনিক হত্যার শিকারদের সংখ্যা কমতে কমতে কয়েকশতে নামায় তারা।
কিন্তু কয়েকশ লাশ একটা বড় এলাকা থেকে রাতারাতি গায়েব করে পুরো শহর ধুয়ে মুছে চকচকে করা সম্ভব নয় যৌক্তিকভাবে? তখন তাকে বৈধতা দিতে দৃশ্যপটে হাজির হন আদিলুর রহমান। তিনি ৬১ জনকে হত্যা এবং গুম করা হয়েছে বলে আরেক উদ্ভট দাবি করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি তার তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর নাম ভাঙিয়ে এহেন মিথ্যাচার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে মিডিয়া ক্যু করার চেষ্টা করেন। তার এই গুজব ও মিথ্যাচারের কারণে সারাদেশের সাধারণ মুসলমানরা উত্তেজিত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালান।
আদিলুর এরমধ্যেই ‘অধিকার’ এর মাধ্যমে একটি ভুয়া রিপোর্ট প্রকাশ করে ২০১৩ সালের ১০ই জুন। তাতে দাবি করা হয়, ৫ মে পুলিশি অভিযানে ‘শত শত’ হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছে! তবে অধিকার প্রাথমিকভাবে নিহত ৬১ জনের কথা বলে। এরপর তথ্য মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে সেই ৬১ জনের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানতে চায়। একই বছরের ১০ই জুলাই ‘অধিকার’কে দেওয়া চিঠিতে তথ্য মন্ত্রণালয় বলে- নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় সরকার প্রকৃত সংখ্যা দেশের নাগারিকদের জানাতে চায়।
কিন্তু আদিলুর বা অধিকার-এর পক্ষ থেকে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, আদিলুরের তালিকায় যাদের মৃত বলে দাবি করা হয়েছে, তাদের কয়েকজনকে জীবিত চিহ্নিত করা হয়।
পরবর্তীতে তথ্য-সন্ত্রাস ও গুজব সৃষ্টির দায়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতরা করা হয় আদিলুরকে। এরপর ২ মাস কারাগারে থেকে জামিনে বের হয়ে কিছুদিন নীরবতা পালন করেন তিনি। তবে ২০১৭ সালে মানবাধিকার সংস্থার একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে মালয়েশিয়ায় যান আদিলুর রহমান। সেখানে বিমানবন্দরে তাকে আটক করে মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতাসহ বেশ কিছু সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় তাকে আটক করে রাখা হয়।
মূলত, মালয়েশিয়ায়র সেকেন্ড হোম প্রজেক্টে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাচারকৃত কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। আদিলুরের ইচ্ছা ছিল, মানবাধিকার সংস্থার নামে নতুন আরেকটি শাখা খুলে মালয়েশিয়ায় বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় সেই প্রকল্পে নিযুক্ত থাকা। আর বিদেশে বসে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা চালানো। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে মামলা চলার কারণে মালয়েশিয়ান পুলিশ আদিলুরকে সেই সুযোগ দেয়নি। পরে মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।
আরও পড়ুন :
- মানবাধিকারকর্মী না ‘মানবাধিকার-ব্যবসায়ী’
- অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান গ্রেপ্তার
- মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নিবন্ধন বাতিল
- মালয়েশিয়া ফেরত পাঠিয়েছে আদিলুরকে
সারা হোসেন কী রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি
ড. কামাল হোসেনের মেয়ে সারা হোসেনের গণ্ডগোলটা কিন্তু একেবারে গোড়ায়, যাকে বলে গোড়ায় গণ্ডগোল। এই আইনজীবীর মা কিন্তু একজন পাকিস্তানি, নাম হামিদা হোসেন। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিক কেন্দ্রের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এছাড়াও সারা হোসেনের স্বামীর নাম ডেভিড বার্গম্যান, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করে নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল- মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। আর কামাল হোসেন নিজেও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত বিরোধী-দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে জিততে ব্যর্থ হয়।
সারা হোসেন নিজের আইনজীবী পরিচয়ের কারণে একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিবৃতি দিয়ে থাকেন। তার বিবৃতিগুলোই আবার প্রকাশ করা হয় আইন ও সালিক কেন্দ্র, ব্লাস্ট, অধিকার-সহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায়, যেগুলোর সঙ্গে তারা পারিবারিকভাবে সম্পৃক্ত। পরে আবার এসব সংস্থার বরাত দিয়েই সংবাদ প্রকাশ করে কিছু গণমাধ্যম।
সেই সূত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সেগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করেন ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব তাকে আন্তর্জাকিত অঙ্গনে চলাফেরা করতে একটা বিশেষ সুবিধা দেয়। অতি সুপরিকল্পিত এক খেলা খেলেন এই চক্রটি। বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে এবং সরকারকে হেয় করে অপপ্রচার চালানোর জন্য যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, তার একটা বড় অংশের মধ্যস্থতা করেছেন এই বার্গম্যান।
ব্যারিস্টার সারার বাবা কামাল হোসেন উগ্রবাদীদের সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মেয়ে সারা হোসেন দেশের মধ্যে সমকামিতার পক্ষে সোচ্চার, আপনারা জেনে থাকবেন হয়তো- বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত এলজিবিটি বা সমকামি ম্যাগাজিন রূপবান-এর প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার সারা। আবার তার স্বামী বার্গম্যান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতাও করছে।
এবার আসুন সারা হোসেনের স্বামী বার্গম্যান বাংলাদেশ-বিরোধী অবস্থান প্রসঙ্গে। ২০০৭ সালে বার্গম্যান টুয়েন্টি টুয়েন্টি নামে লন্ডনের একটি টেলিভিশন প্রডাকশন হাউসে কাজ করতেন। কিন্তু তাকে নানা অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে মদদ দেয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংহতি বিনষ্ট করা সহ একাধিক অভিযোগ উঠেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত তিনটি দেশে ডেভিড বার্গম্যান সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত। এই দেশ তিনটি হলো ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইতালি।
পরে ২০০৯ সালে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর প্রক্রিয়া চলছিল, তারপর থেকেই সারা হোসেনের স্বামী ও ড. কামাল হোসেনের বেকার জামাই ডেভিড বার্গম্যান ঢাকায় অবস্থান শুরু করেন। শ্বশুর বাড়ির পরিচয় ব্যবহার করে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় চাকরি নেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ওকালতি শুরু করেন।
জানা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক প্রচারণার জন্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন বিএনপি নেতা ও যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আইএসআই তখন ব্রিটিশ নাগরিক বার্গম্যানকে এই দায়িত্ব দেয়। এরপরই যুদ্বাপরাধীদের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। তার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। অধিকাংশ লেখাতেই তিনি শুধু সেসব মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছেন, যারা বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
২০১৪ সালের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম কাশিম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ার পর মরিয়া হয়ে ওঠে বার্গম্যান। আল জাজিরাসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় বাংলাদেশবিরোধী বিদ্বেষ ছড়াতে থাকেন তিনি। এমনকি, বার্গম্যানের বিতর্কিত মন্তব্য ও তার সরবরাহ করা তথ্য থেকে লিপিবদ্ধ একটি বইকে (ডেড রেকনিং) যুদ্ধাপরাদীদের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাফাই হিসেবে উপস্থাপন করেছিল উগ্রবাদী দল বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা।
বার্গম্যানের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন- বিশেষ গোষ্ঠী যারা ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে চায়, তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছেন বার্গম্যান। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির দায়ে মহামান্য আদালত তিরস্কার করে বার্গম্যানকে।
শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়েই নয়, বাংলাদেশের সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলন, ইস্যু ও সংকট নিয়েই বার্গম্যানের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশকে হেয় করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মেতে আছেন তিনি। বার্গম্যানের রাজনৈতিক যোগাযোগ এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, তা চাইলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনকি লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের সঙ্গেও তাকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করতে দেখা গেছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় অপেশাদার ও ঔদ্ধত্য আচরণের জন্য দ্য নিউ এজ পত্রিকা এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম থেকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে ডেভিড বার্গম্যানকে। তার বিরুদ্ধে সাংবাদিকতার এথিক্সের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ ছিল। শুধু এ কারণেই মূলধারার গণমাধ্যমে অযোগ্য হয়ে পড়েন তিনি।
এরপর বিদেশে অবস্থান করা কিছু নামধারী সাংবাদিকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের জন্য বিএনপি-জামায়াতের একজন লবিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। জামায়াত নেতাদের পরামর্শে বার্গম্যান ও তাসনিম খলিলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশবিরোধী গ্রাউন্ড তৈরির দায়িত্ব তারেক রহমান। এরপর থেকে সেই মিশন বাস্তবায়নের জন্য একজোট হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই দুই ব্যক্তি।
[মানবাধিকার যেখানে যেমন !]
মানবাধিকারের নামে যারা জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক, নাশকতার মদতদাতা, উগ্রবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে রক্ষার মিশনে নেমেছে; তাদের কি আসলেই মানবাধিকার কর্মী বলা যায়? যারা দেশ রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে, উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হয়ে নিঃস্ব ও অসহায় জীবনযাপন করছে তাদের পক্ষে যারা কথা বলে না, উল্টো দুর্বৃত্তদের রক্ষার অপচেষ্টার মিশনে নেমেছে; তারা কি মানবাধিকার রক্ষা করছে নাকি মানবাধিকারের ছদ্মবেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন করছে-সেটা নিরপেক্ষভাবে জানার এবং উপলব্ধি করার উপডুক্ত সময় এখনই।
উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর পেইড এজেন্ট হিসেবে এরা মূলত ডানপন্থী শক্তিকে ক্ষমতায় আনার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড এবং এদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই সত্য এখন সূর্যের আলোর মতো সত্য। এদের থেকে সতর্ক থাকুন, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পাশে থাকুন।
আরও পড়ুন :
- সব মানবাধিকার কি বিএনপি-জামায়াতের জন্যই? সাধারণ মানুষ ও বিএনপি-জামায়াতের ভিকটিমরা কি মানুষ নয়?
- মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’র আড়ালে বিএনপি’র অর্থায়ন ও নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি
- সুশীলতার আড়ালে বাংলাদেশের ডানপন্থী বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারের দোকানদারদের মুখোশ উন্মোচন