সুইস ব্যাংক

বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর- এমন কিছু সংবাদের দেখা মিলেছে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ডয়চে ভেলেসহ কিছু পত্রিকায়। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ থেকে কেউ কেউ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ ব্যাংক হিসেবে ‘কুখ্যাত’ সুইস ব্যাংকেও বিপুল অর্থ জমা করছেন প্রতি বছর- সেসব সংবাদও জানা যাচ্ছে।

‘কুখ্যাত’ এই অর্থে, সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থ জমাকারীদের তথ্য কাউকে জানায় না। তবে সুইস সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে কাজ করে, এমন একটি সংস্থা কিছু তথ্য হাতে পেয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখার তথ্য জানতে চাওয়ার বিষয়ে সুইস রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাঝে মতদ্বৈধতা প্রকাশ্য হয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ঢাকায় দায়িত্বরত সুইস রাষ্ট্রদূতকে তলবও করেছেন। মূলত সেই ঘটনার পর সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে জানা গেছে।

যার প্রেক্ষিতে সুইস ব্যাংকের বাংলাদেশি অ্যাকাউন্ট হোল্ডার সম্পর্কে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। সরকার সুইস ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে কারা অর্থ গচ্ছিত রাখছে, অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের পরিচয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

আরও পড়ুনঃ টানা পাঁচবার আমাদের এই স্বাধীন দেশ ছিল দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এই চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছিল দেশের জন্য চরম লজ্জার

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে যেসব অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সে ব্যাপারে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে ইতিমধ্যে। এই তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির তিন নেতার পরিবারের কয়েকজন সদস্যের নামেই সুইস ব্যাংকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। সেই বিএনপি নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- দলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মোরশেদ খান, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

বিএনপি নেতা মোরশেদ খান বিএনপির একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবং দলের প্রথম সারির অর্থায়নকারী। বিএনপি আমলে তিনি খালেদা জিয়ার বদান্যতায় মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেল-এর মাধ্যমে একচেটিয়া মনোপলি ব্যবসা করে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, পরবর্তীতে অন্যান্য ব্যবসার আড়ালে দেশে-বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন বলে তথ্য রয়েছে।

[অনুসন্ধান: সুইস ব্যাংকের ৩টি হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকা, মিলেছে মালিকের সন্ধান]

বর্তমানে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করলেও দলের সকল প্রয়োজনে তিনি অর্থ সহায়তা করেন। তার পুত্র ফয়সাল খান, পুত্রবধূ, কন্যা ও জামাতার নামে সুইস ব্যাংকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে অন্তত ১২’শ কোটি টাকা গচ্ছিত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিটিসেল গঠনের সময় সুইস ব্যাংকে দুটি অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন মোরশেদ খান এবং তার পুত্র ফয়সাল খান। ফয়সাল খান ২০০১ সালে সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে টাকা সুইস ব্যাংকে স্থানান্তর করে সেই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। ২০০২ সালে ফয়সাল খানের স্ত্রীর নামে সুইস ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। ২০০২ সালের নভেম্বরে ফয়সাল ও তার স্ত্রীর যৌথ নামে সুইস ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট করেছিলেন।

এছাড়াও মোরশেদ খানের জামাতা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম এবং মোরশেদ খানের কন্যার নামেও সুইস ব্যাংকে একটি যৌথ অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যাতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮০ কোটি টাকা রয়েছে বলে জানা গেছে। মোরশেদ খান আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকের মালিকানায় ছিলেন। যার মাধ্যমে প্রথমে সিঙ্গাপুরের ব্যাংক, তারপর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে টাকা সরানো হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তবে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার শীর্ষে রয়েছেন বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু। প্যারাডাইস পেপার্স, প্যান্ডোরা পেপার্স ও পানামা পেপার্স-এর নথিপত্র ফাঁস হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীদের সাথে আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। বেনামে এবং ভুয়া ব্যবসায়িক কাগজপত্রের মাধ্যমে অর্থ পাচারের প্রক্রিয়ার সাথে মিন্টু পরিবারের সাদস্যরা জড়িত বলে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল।

আব্দুল আউয়াল মিন্টুর শুধু সুইস ব্যাংকে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্তত ১৮টি দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে ট্যাক্স হ্যাভেন বলে চিহ্নিত দেশগুলোতেও আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং তার পুত্রদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে মিন্টুর দুটি কোম্পানির হদিস মিলেছে। যার মাধ্যমে সুইস ব্যাংকে মিন্টু টাকা পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সুইস ব্যাংকে আব্দুল আউয়াল মিন্টুর কয়েকটি অ্যাকাউন্টে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা রয়েছে বলে তথ্য এসেছে। তবে এই টাকার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

[অনুসন্ধান: সুইস ব্যাংকের ৩টি হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকা, মিলেছে মালিকের সন্ধান]

বিএনপির আরেক নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল ২০০০ সালে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা গচ্ছিত রাখা হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমির খসরু সুইস ব্যাংকে তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা দেন এবং উত্তোলন করেন বলে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। সুইস ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টগুলো এখনো সচল রয়েছে এবং সেখান থেকে লন্ডনে অর্থ স্থানান্তর হওয়ার অন্তত ১৬টি ওয়্যার ট্রান্সফারের তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এই তিন বিএনপি নেতার মধ্যে আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং আমির খসরু এখনও তারেক রহমানের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখেন এবং তার বিলাসী জীবনের অন্যতম অর্থায়নকারী হিসেবেও পরিচিত। সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেছে, কর্মকর্তারা এখন সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে কার কত টাকা আছে সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।

উল্লেখ্য, সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা কোনো অপরাধ নয়। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা দেয় বলে অনেকেই সেখানে অর্থ জমা রাখেন। তবে প্রতিটি রাষ্ট্রেরই আর্থিক দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য আইন রয়েছে।

আইনের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে কেউ অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত রাখলে অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গচ্ছিত অর্থের উৎস যদি সুষ্ঠুভাবে দেখাতে ব্যর্থ হয় কেউ, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে অর্থ পাচারের দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে রাষ্ট্র। তাই বিএনপির এই তিন নেতার অর্থের উৎস অনুসন্ধানও শুরু হবে শীঘ্রই।

আরও পড়ুনঃ