
বাবর জিজ্ঞাসাবাদে। নির্বাচনী তহবিলের জন্য পাকিস্তান, কুয়েত ও সৌদি সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ১০০ কোটি টাকা করে মোট ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। ক্ষমতা ছাড়ার আগে খালেদা জিয়ার কুয়েত সফরের সময় সে দেশের আমির এই টাকা দেন। একইভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেরকে (টিএফআই) এসব কথা বলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বাবরকে চার দফায় ১৫ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গত ২৮ মে গুলশানের বাসভবন থেকে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। সূত্র জানায়, বিএনপি বিএনপির নির্বাচনী আনুদানের ব্যাপারে বাবর আরও জানান, পাকিস্তান থেকে পাওয়া ১০০ কোটি টাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে আছে। কুয়েত ও সৌদি আরব থেকে পাওয়ার বিষয়টি দুজন ব্যবসায়ীও জানেন। এদের একজনকে এর আগে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আটক করে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে এসব কথে স্বীকার করেন বলে একাধিক সূত্র জানায়।
টাকা দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তিন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুনঃ
লুৎফুজ্জামান বাবর: দুর্নীতির মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতার আট বছরের কারাদণ্ড
Table of Contents
জিম্মাদের খোঁজেন খালেদা :
জিজ্ঞাসাবাদে বাবর বলেন, ক্ষুতায় থাকার সময় টাকা রাখার জন্য জিম্মাদার খোঁজেন খালেদা জিয়া। তিনি এ জন্য বিশ্বস্ত লোক জোগাড় করতে বলেন। বাবর জানান, তার ভাই গোলাম রব্বানী তাঁর সহায়তায় ২০ কোটি টাকা পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির নামে এফডিআর করে রাখেন। এ টাকার কিছু অংশ বাবর মাচগ ধরার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এসব ট্যাক্স ওয়ারিদ থেকে পাওয়া বলে তিনি পরে জানতে পারেন। বাবর জানান, শান্তিনগরে দুই বিঘা জমি কেনা হয়েছে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর নামে। কিন্তু একটি বিএনপির কার্যালয়ের জমি বলে প্রচার করা হয়।
দরপত্র দুর্নীতি :
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর জিজ্ঞাসাবাদে র্যাোব ও পুলিশের জন্য ১২টি সাঁজোয়া যান ও এক হাজার ১০০ যানবাহন কেনায় দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, গাড়ি কেনার আগে তারেক রহমান তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘গাড়ি কেনা হলে আপনার ব্যাংক ঋন পরিশোধ করা যাবে।’ পরে বাবর তার সঙ্গে কথা বলার জন্য এক ব্যবসায়ীকে পাঠান। ব্যবসায়ী বাবরকে জানান, তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এর আগে বাবর স্বীকার করেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক মোটরসকে কাজ দেওয়া হতো। বিনিময়ে এবি ব্যাংকসহ তাঁর সব ব্যাংকের ঋন পরিশোধ করা হয়। বাবর স্বীকার করেন, দরপত্র রদবদলের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেওয়া হয়।
ওয়ারিদ দুর্নীতি :
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধাবি গ্রুপের ওয়ারিদ টেলিকমের ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দের জন্য দেড় কোটি ডলার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১০লাখ ডলার নিয়েছেন আলী আসগর লবী এবং ৯০ লাখ ডলার নেন আরাফাত রহমান কোকো । ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, লবী তাঁকে বলেছিলেন, দেড় কোটি ডলার দলের জন্য আর ৫০ লাখ ডলার কোকোর জন্য। এ ছাড়া আরও ১০ শতাংশ শেয়ার কোকোর পাওয়ার কথা ছিল। বিটিআরসির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক তাঁর ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তিনি বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেন। বাবর জানান, ওয়ারিদের স্থানীয় প্রতিনিধি তাঁকে ১০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা নেননি। দুবাই প্রবাসী মাহতাব ও অন্য এক ব্যক্তির মাধ্যমে হুন্ডি করে কোকোর টাকা আনা হয়।
[পাকিস্তান, কুয়েত ও সৌদি ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছিলো বিএনপিকে: জিজ্ঞাসাবাদে বাবর – টাকা রাখার জন্য জিম্মাদার খোঁজেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া]
টিএ্যান্ডটির যন্ত্রপাতি কেনা :
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর জানান, টিএ্যান্ডটিতে খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের কাজ একটি চীনা কোম্পানিকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য আরাফাত রহমান কোকো ২০ থেকে ৩০ লাখ ডলার নেন এবং অর্থমন্ত্রীর ছেলে বাবুও ঘুষ নেন।
অস্ত্র কেনা :
বিএনপি সরকারের আমলে র্যা ব ও পুলিশের অস্ত্র কেনায় দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, হাওয়া ভবন অস্ত্রপ্রতি ১০০ ডলার করে অর্থাৎ প্রায় দুই কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। র্যা বের সাব-মেশিনগান কেনার জন্য পাকিস্তানে গিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব পাঁচতারা হোটেলে অবস্থান করেন। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এসব কাজ দেওয়া হতো বলে তিনি স্বীকার করেন।
বেতারযন্ত্র কেনা :
বাবর স্বীকার করেন, গত পাঁচ বছরে পুলিশের জন্য ৩০ কোটি টাকার বেতারযন্ত্র কেনা হয়েছে। এতে ১০ কোটি টাকার বেশী দুর্নীতি হয়েছে। এসব যন্ত্রের মধ্যে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৫০০ টি এফএম বেতার ও এক হাজার ব্যাটারি কেনা হয়। একইভাবে ১৫০টি স্থায়ী যন্ত্র কেনায় আড়াই কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এসব ক্রয়ে খুলনা পুলিশের জন্য নিয়মনীতি ছাড়া বেতারের রিপিটার কেনায় দুর্নীতি হয়। এসব কেনাকাটায় দুর্নীতি বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁরা অনেক কিছুই জানতে পারছেন। সবকিছু পরিষ্কার হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ডটেল :
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেন, ওয়ার্ল্ডটেল বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য বিএনপিকে কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি তদবির করতে রাজি হন। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ডটেলের প্রতিনিধি নাইম এম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মফিদুল হাসান তৃপ্তির মাধ্যমে। তিনিই প্রথম শেয়ারের বিনিময়ে তদবির করতে বলেন। তাঁর প্রবাসী এক বন্ধু এ ব্যাপারে তাঁকে অনুরোধ করেন বলে বাবর জানান। বাবর আরও বলেন, পরে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনার পর ওয়ার্ল্ডটেলের ৩০ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। তিনি জানান, ওয়ার্ল্ডটেলের আট শতাংশ শেয়ার তাঁর দুবাই প্রবাসী বন্ধু মাহতাব কেনেন। এ জন্য মাহতাব আট কোটি টাকা দিলেও এখনো সে টাকা ফেরত পাননি। অবশ্য এর আগে নাইম চৌধুরী প্রথম আলোকে এসব লেনদেনে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
[পাকিস্তান, কুয়েত ও সৌদি ৩০০ কোটি টাকা দিয়েছিলো বিএনপিকে: জিজ্ঞাসাবাদে বাবর – টাকা রাখার জন্য জিম্মাদার খোঁজেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া]
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট :
মেশিনের সাহায্যে পড়া সম্ভব এম পাসপোর্ট তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই কাজটি একটি জার্মান কোম্পানি পেয়েছিল। আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে এ নিয়ে গোপন লেনদেন হয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান নানা অজুহাতে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। পরে জানা যায়, অর্থমন্ত্রীর ছেলে নাছের রহমানের হস্তক্ষেপে বিষয়টি স্থগিত হয়ে যায়। তবে শুরুতে সাইফুর রহমান এ প্রকল্পের পক্ষে ছিলেন বলে বাবর জানান।
সাভারের জমি দখল :
বাবর জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সাভারে ১০ একর জমি তিনি অবৈধভাবে বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। একটি থাই কোম্পানির নামে অর্কিড চাষের জন্য তিনি এই অবৈধ বন্দোবস্ত করে দেন। এতে তাঁর ৫০ শতাংশ শেয়ার ছিলো বলেও তিনি জানান।
২০ বার হেলিকপ্টার ভ্রমন :
জিজ্ঞাসাবাদে বাবর জানান, ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি সরকারি হেলিকপ্টার নিয়ে ২০ বার নেত্রকোনায় যান। এতে সরকারের আট লাখ টাকা ক্ষতি হয়। সড়কপথে তিনি ৩০-৩৫ বার সেখানে যান। ব্যক্তিগত সফরকে সরকারি বলে দেখানো ঠিক হয়নি বলে তিনি জানান।
সূত্র প্রথম আলো ১১ জুন ২০০৭
আরও পড়ুনঃ
১৭ আগস্ট ২০০৫ : বিএনপি জামাত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে সারাদেশে জেএমবি’র সিরিজ বোমা হামলা