জামায়াত-যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বশেষ মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্ট আমার দীর্ঘদিনের অবস্থানকে বৈধতা দিয়েছে – যে ভানই ধরুক না কেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে ওয়াশিংটনের প্রধান মিত্ররা মৌলবাদী সংগঠনের পদাতিক সৈনিক।

১৯৫০ -এর দশকে ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাত করা থেকে শুরু করে কট্টর ইসলামপন্থীদের ব্যবহার করে আফগান জিহাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সৌদি আরবের সবচেয়ে আগ্রাসী শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করা পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই শাসন পরিবর্তনের  উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামিক বিশ্বের প্রগতিশীল শক্তিকে পরাজিত করতে মৌলবাদী শক্তিকে ব্যবহার করেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনের জন্য গামাল নাসের, সাদ্দাম হোসেন বা মোসাদ্দেকের মতো আরব বা পারস্য জাতীয়তাবাদীরা প্রধান শত্রু ছিল। তবে মাঝে মাঝে, স্ক্রিপ্টটি ওয়াশিংটনের জন্য ভুল হয়েছে,  বিশেষ করে আগ্নেয়গিরির মতো যখন ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়েছিল বা ১৯৯৬ সালে তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করেছিল।

আমাদের মতো যারা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরের ঘটনাগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে কভার করেছেন, তারা মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতা খুঁজে পেয়েছেন – প্রথমে রক্তপিপাসু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন করা এবং তারপরে ১৯৭৫ সালের নৃশংস অভ্যুত্থানে ওয়াশিংটনের গোপন সমর্থন দান। নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন “সোভিয়েত-ভারতীয় প্রক্সি”। ফলে নাসেরের মতো আরব জাতীয়তাবাদীদের প্রতি ওয়াশিংটনের অপছন্দ সহজেই শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদীর প্রতি অবিশ্বাসে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে  হাসিনা সরকারকে ভৎসর্না করার বিষয়ে আমি তাই বিস্মিত নই।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট“বিরোধী দলের কর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন। দেশের বৃহত্তম ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা হয়রানির কারণে তারা সাংবিধানিক বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতা চর্চা করতে পারেনি,” মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার  জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করা হয়।  মজার বিষয় হল, হাইকোর্টের একটি আদেশ শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের যে নিবন্ধন ছিল সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য জনপ্রিয় আন্দোলনের সময় সারা বাংলাদেশে অনুরণিত হয়েছিল এই দাবিটি।

হাস্যকরভাবে, মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: “দলটির নেতা এবং সদস্যদের বক্তৃতা এবং সমাবেশের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করা হয়েছিল।”

চলুন সঠিক ইতিহাসটি খুঁজি।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশে ছিল এবং তাদের সমর্থকরা পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে বাঙালিদের উপর ভয়ঙ্কর নৃশংসতা চালায়।

তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা হত্যা, ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ এবং অগ্নিসংযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর কয়েকজনের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে।

আরও পড়ুন : ক্ষমতা দখলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র করছে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি; কলকাঠি নাড়ছে বিএনপি

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট যেভাবে জামায়াতকে সমর্থন জানিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অনেকেই হতবাক হয়েছেন। অথচ দলটির ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেতনাকে ক্ষুণ্ন করে একটি পাকিস্তান-স্টাইলের ইসলামী প্রজাতন্ত্র তৈরি করা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এমন সমর্থনে আমি অবাক হইনি।

[জামায়াতের পক্ষেই যুক্তরাষ্ট্র!]

২০১৩ সালে জামায়াতের জৈষ্ঠ্য নেতারা যুদ্ধপরাধের বিচারের মুখোমুখি হয়, পাশাপাশি দলটির প্রধান মিত্র বিএনপিও নির্বাচন বর্জন করে। ফলে কট্টরপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে অনেক ইস্যুতে সহিংসভাবে আন্দোলন করেছিল জামায়াত। যাত্রীবাহী বাস ও ট্রেনে তাদের আগুনে ও বোমা হামলায় কয়েক ডজন নিরপরাধ মানুষ মারা গেছে। আর পুলিশ বাহিনীর উপর ধারাবাহিকভাবে নির্মম আক্রমণ আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয়ঙ্করভাবে নির্মূল করার মিশনতো ছিলই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে যে সহিংস জামাত ক্যাডার এবং তাদের সমমনা মৌলবাদী দলগুলি ছাড়া এগুলো ঘটতে পারে না।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে জামায়াতের প্রতি এই মার্কিন সমর্থন বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী শক্তির পক্ষে আমেরিকান নীতির একটি ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে। ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান বা গামাল নাসেরের মতো আবেগপ্রবণ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সবসময় সমস্যা ছিল। পশ্চিমা কৌশলগত স্বার্থের হয়ে খেলা করতে সৌদি আরব বা পাকিস্তানের মতো  পশ্চাদমুখী শাসনব্যবস্থা সবসময়ই উন্মুখ হয়ে থাকে যার ফলে ওয়াশিংটনের আস্থাভাজন হিসেবে নিজেদের যোগ্য করে  তুলেছে।

তাই, ভিন্নমতাবলম্বী জামাল খাশোগির নির্মম হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও জো বাইডেনকে সৌদি আরবকে একটি অচ্ছূত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার হুমকি গ্রাস করে হাউস অফ সৌদের কাছে পৌঁছাতে হবে। তিনি কি খাশোগির নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত সৌদি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সাহস করতে পারবেন?

না। কিন্তু হাস্যকরভাবে, ঢাকাকে ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের “অধিকার অস্বীকারের” জন্য দায়ী করা হবে যারা বাংলাদেশকে তালেবানের মতো পশ্চাদমুখী রাষ্ট্র তৈরি করতে চায়।

মীর কাসেম আলিজামায়াতের সাবেক টাকার কুমির মীর কাসেম আলী যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে কীভাবে প্রভাবশালী একটি মার্কিন লবি ফার্ম ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সাথে ২৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছিলেন যাতে মার্কিন সরকার তার স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে – সেটি দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

(নিবন্ধটির লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত একজন প্রবীণ কলামিস্ট এবং বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের উপর “মিডনাইট ম্যাসাকার (মধ্যরাতের গণহত্যা)” এর লেখক। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন করতেন।)

আরও পড়ুন :