ইউনূস

শুরু থেকেই অনেক উচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে পদ্মা সেতু তৈরির বিরোধিতা করে গেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নোবেল লরিয়েট হওয়ায় নিজের ইমেজ ব্যবহার করেছেন তিনি এক্ষেত্রে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যখন বিশ্বব্যাংক কোনো অর্থ ছাড় করেনি, সেই সময় থেকেই দুর্নীতির এক আজগুবি অভিযোগ তোলা হয়। অর্থ ছাড় না হলে কীভাবে সেখানে আর্থিক দুর্নীতি হয়- সেটা পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করবে? কিন্তু ইউনূস এবং বাংলাদেশের দুটো দুষ্ট পত্রিকা- প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের পরিকল্পনায় গল্পের গরুকে গাছের মগডালে তোলা হয় সুকৌশলে।

তাদের লক্ষ্য ছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ ব্যাহত হোক এবং বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধুলায় মিশে যাক। সেজন্য তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন হোমরা-চোমরাদের শরণাপন্ন হয়ে পুরো গেমটি সাজিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের ষড়যন্ত্র বিফল হয়, আর পদ্মা সেতু আজ এক বাস্তবতা। যাই হোক, এ সবই চর্বিত-চর্বণ, সবাই জানেন। ড. ইউনূস আজ বাংলাদেশে ঘৃণিত এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার মুখোশ খুলে যাওয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যদের কাছে তার আবেদনও ফুরিয়েছে। এমতাবস্থায় এত বছর পর ড. ইউনূসের মালিকানাধীন ইউনূস সেন্টার এই ষড়যন্ত্রীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নেমেছে।

ইউনূস সেন্টার এক বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যা যা বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সবই নাকি অপপ্রচার! তারা জাতিকে নয়-ছয় বোঝানোর জন্য এই বিবৃতি ছেড়েছে, আর তা সোনামুখ করে প্রচারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। এমন বিবৃতি দেয়ার আরেকটি কারণ রয়েছে। এটা তার ভাবমূর্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ইউনূসের বিরোধিতার যত প্রতিবেদন প্রকাশ হবে, তার লেজুড় হিসেবে যুক্ত থাকবে- ইউনূস এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বলে। বিদেশে অনেক উচ্চশ্রেণির লিংক আছে ইউনূসের। তাদের সামনে দুধে ধোয়া তুলসি পাতা সাজা জরুরি তার জন্য।

ইউনূসের দোসর ড. কামাল হলেন আরেক ষড়যন্ত্রী। বাংলাদেশের যত শ্রমিক বিদেশে থাকেন, তারা কাজ করে টাকা পাঠান দেশে। বিদেশে তারা নানাভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু কামাল বা ইউনূসরা তেমন কিছু করেছেন কোনোদিন, তা কি কেউ জানেন অথবা শুনেছেন কখনো? অথচ তারা তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্যে কতকিছু করতে পারতেন। কিন্তু এরা যা কিছু করেন-করেছেন, সবই নিজের জন্যে। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের জন্যে। এই ড. কামাল হলেন ড. ইউনূসের আইনজীবী। আমে-দুধে একেবারে মাখামাখি।

ইউনূস সেন্টারের দেওয়া বিবৃতিতে কোনো সারবত্তা নেই। তবুও বিবৃতিটির আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাক।

গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে ইউনূস সেন্টারের দাবিতে যে কারো মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, গ্রামীণ ব্যাংক যেন স্পেসশিপে করে ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আগত কোনো প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের নিয়মনীতি, আইন-কানুন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলবে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মনীতি দেশের সব ব্যাংক মানতে বাধ্য হলেও গ্রামীণ ব্যাংক যেন সেসব মানতে বাধ্য নয়। তারা জনগণের টাকা ইচ্ছেমত নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখবে কিন্তু পরিচালিত হবে নিজেদের বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী।

বিষয়টা পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে না? একই কাজতো ডেসটিনি-ইভ্যালি-ইঅরেঞ্জের মত প্রতিষ্ঠানগুলোও করতো। গ্রামীণ ব্যাংককে ইনডেমনিটি দিলে ডেসটিনি-ইভ্যালি-ইঅরেঞ্জকে কেন জালিয়াত বলা হবে? তাদের বিরুদ্ধে এতো ব্যবস্থা কেন! গ্রাহকদের অধিকাংশইতো তাদের পক্ষে আছে। তবুরও সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, কারণ তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি।

প্রশ্ন হলো, গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য কেন আলাদা নিয়ম হবে? দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যেই দেশীয় প্রতিষ্ঠান চলবে। ব্যাংকের এমডি থাকতে ৬০ বছর বয়সসীমার নিয়মনীতি নাকি গ্রামীণের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, তাদের পরিচালকরা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ড. ইউনূসই বারবার এমডি থাকিবেন। গ্রামীণ ব্যাংক চালানোর জন্য নাকি আর কোনো যোগ্য লোক নাই! আইনি লড়াই করেও হারলেন ইউনূস। ড. কামালের মত জাঁদরেল আইনজীবীরাও তার পক্ষে ছিলেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ড. ইউনূসকে অপসারণ করা হলে তিনি আদালত পর্যন্ত যান। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সুপ্রিমকোর্ট সব আদালতে তিনি হেরেছেন। সরকারি ব্যাংক সংক্রান্ত আইনেই আছে এমডির বয়স ৬০ বছরে বেশি হবেনা। ড. ইউনূসের বয়স তখন ৭০-এর বেশি। এরপর তিনি বন্ধু হিলারি ক্লিনটন, চেরী ব্লেয়ারসহ অনেককে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোন করান। হিলারী ফোন করেছেন দেখলে অন্য কেউ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে যেত। কিন্তু শেখ হাসিনা ঠান্ডা মাথায় তাকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইন সম্পর্কে বোঝান। হিলারী রাগে গজগজ করতে করতে ফোন রাখেন।

একটি কথা ইউনূস সেন্টার সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। আগ্রহীরা চাইলে অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন। গ্রামীণ ব্যাংকের বহু ডিএমডিকে তারা হেনস্তা করে ব্যাংক থেকে বিদায় করেছেন। যারা গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে জড়িত ছিলেন, যাদের অক্লান্ত শ্রমে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত, ডিএমডি হবার পরপরই কোনো না কোনো অভিযোগ এনে হেনস্তা করে তাদের বিদায় করে দেওয়া হতো। কারণ নিয়মানুযায়ী তারাই ব্যাংকের পরবর্তী এমডি পদের দাবিদার ছিলেন। এই কাজটি করত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আর পরিচালনা পর্ষদ নিজের ইচ্ছায় বানাতেন ইউনূস।

পত্র-পত্রিকার কল্যাণে সবাই জানেন, দেশের প্রতিটি দুর্যোগ বা ক্রাইসিস মোমেন্টে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সহায়তার হাত নিয়ে এগিয়ে আসে। মাত্র কয়েকদিন আগেও বন্যার্তদের জন্য ব্যাংক মালিকরা ৩০০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি, দেশের কোনো দুর্যোগে ড. ইউনূস জনগণের পাশে ছিলেন কি না! অথচ সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’কে তিনি ২০১১ সালে ১৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছেন। আর এই তথ্যটি ইউনূস সেন্টার তাদের বিবৃতিতে পুরোপুরি অস্বীকার করেছে।

আগ্রহীদের জন্য তাহলে সূত্রটি দেওয়া যাক- ২০১৬ সালের ১৭ই এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ডেইলি কলার’ ক্লিনটন ওয়েবসাইটের [লিংক- https://dailycaller.com/2016/04/17/exclusive-disgraced-clinton-donor-got-13m-in-state-dept-grants-under-hillary] বরাতে জানিয়েছিল, ড. ইউনূস কীভাবে সেখানে ৩ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। সেই সংবাদের প্রতিবাদ কিন্তু সেসময় কিংবা পরবর্তী সময়ে ড. ইউনূস বা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের কেউই করেননি।

আরও পড়ুনঃ EXCLUSIVE: Disgraced Clinton Donor Got $13M In State Dept Grants Under Hillary

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের তোয়াক্কা করেনি ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক। তাদের সুদের হার ছিল সবার চেয়ে অনেক বেশি- ২০ থেকে ২৭ শতাংশ। এই উচ্চ সুদ টানতে কত শত পরিবার যে নিঃস্ব হয়েছে, এর হিসাব নেই। পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যেত ছবি- সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষকের গরু-ছাগল টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের লোকজন, গৃহস্থালী সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে, দেনার দায় শোধ করতে ব্যর্থ কৃষক গলায় ফাঁস দিয়েছেন গাছের ডালে… এমন ভুরি ভুরি ঘটনার সাক্ষী বাংলার জনগণ।

প্রবাদ আছে, যেখানে মোরগ ডাকে না সেখানেও সকাল হয়। ড. ইউনূস ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক কিন্তু আজ এক দশক ধরে সুন্দরমতো চলছে। কোনো আওয়াজ আছে? কোনো হৈ চৈ আছে?

[সাফাই গাইতে গিয়ে উল্টো ইউনূসের বস্ত্রহরণ!]

বিবৃতিতে ইউনূস জোর গলায় দাবি করেছেন, পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের ষড়যন্ত্রে তিনি জড়িত নন। কিন্তু উইকিলিকস-এর প্রকাশিত নথির বিষয়টি এড়িয়ে গেছে ইউনূস সেন্টার। যেসব তথ্য দেশের গণমাধ্যমে বহুবার প্রচারিত হয়েছে। যেখানে স্পষ্টভাবে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের ষড়যন্ত্রে ইউনূসের নাম আছে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মাঝে এ সংক্রান্ত ই-মেইল চালাচালির তথ্যও সেখানে আছে।

বিবৃতির একটি লাইন আছে, যাতে ইউনূসের বস্ত্রহরণ আরো সুস্পষ্ট হয়। এতে পরিষ্কার হবে, পদ্মা সেতুর ঋণ বন্ধের ষড়যন্ত্রে তিনি জড়িত ছিলেন কি না। তারা লিখেছেন- “দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্ব ব্যাংকের সতর্ক সংকেতের ঘটনা একই সময়ে ঘটেছিল।” লক্ষ্য করুন, তারা লিখেছে “দুর্নীতির কারণে”। পদ্মা সেতু ইস্যুতে সবাই বলছে, এমনকি খোদ বিশ্বব্যাংকও বলছে “দুর্নীতির অভিযোগ”, অর্থাৎ বিষয়টি প্রমাণিত নয়। পরে কানাডার আদালতও যা ভুয়া বলে রায় দিয়েছে। অথচ ইউনূস সেন্টার আজও বলেছে, ‘দুর্নীতির কারণে’ অর্থাৎ সেখানে দুর্নীতি হয়েছে বলে তারা এখনো বিশ্বাস করে। চোর যত সাবধানেই চুরি করুক না কেন, কিছু চিহ্ন রেখে যায়। এখানেও ইউনূস সেন্টার তাই করেছে। আর তা ইউনূসের মুখোশ খুলে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ

অনেকের একটা প্রশ্ন আছে, ড. ইউনূস কেন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন? সমস্যার শুরুটা কোথায়? দেখা যাক সেই বিষয়টি।

ড. ইউনূস নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে দেশের ক্ষতি করেছেন, পদ্মা সেতুর কাজ আটকে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি দেখতে পারেননা- এসব সবাই জানেন। ইউনূস ভেবেছিলেন পদ্মা সেতু না হলে শেখ হাসিনা বেশ জব্দ হবেন। সেই চিন্তায় তিনি যে দেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন, তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। গ্রামীণফোন থেকেই সেই ক্রোধের উৎপত্তি। অথচ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনাই গ্রামীণফোনের লাইসেন্স দিয়েছেন।

এর আগে বিএনপি আমলে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে দলের নেতা এম মোরশেদ খানকে মনোপলি ব্যবসা করতে দিতে সিটিসেল ছাড়া আর কোনো মোবাইল ফোন কোম্পানিকে লাইসেন্স দেননি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ড. ইউনূস তথা গ্রামীণফোনকে (যার শেয়ার হোল্ডার গ্রামীণ টেলিকম) লাইসেন্স দিয়ে সেই মনোপলি ব্যবসা ভেঙে দেন। সিটিসেলে ইনকামিং চার্জ ছিল। গ্রামীণও ইনকামিং চার্জ আরোপ করে। শেখ হাসিনা সিটিসেল ও গ্রামীণফোনের ইনকামিং চার্জের বিরোধিতা করায় ক্ষিপ্ত হন ড. ইউনূস! তিনি তখন বেশ কিছু মার্কিন সিনেটর-কংগ্রেসম্যানকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি লেখান! এসব চিঠিতে লেখা হয় ‘ড. ইউনূস আমাদের বন্ধু। তাকে যেন সরকার দেখে রাখে’! কিন্তু সবাই জানেন, বিদেশি চাপ-খবরদারিকে থোড়াই কেয়ার করেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা।

আর তাই শেখ হাসিনাও ইনকামিং চার্জ বাতিলের বিষয়ে অটল থাকেন। ড. ইউনূসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের তিক্ততা তখন থেকে। এরপর ১/১১’র সময় এর শোধ নিতে চান ইউনূস! তার মনে হলো শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দেবার এখনই সময়। এতে কামিয়াব হলে তিনি ক্ষমতায় বসতে পারবেন। তাকে সেরকমই আশ্বাস দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে কে না চায়। কতজনের সুখ মনে মনে! কিন্তু ড. ইউনূস হেঁটেছিলেন ভুল পথে। সামরিক শাসকদের গোলাম হবার পথে।

২০০৭ সালে ১/১১ সরকারের সময় রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য মাঠে নেমেছিলেন ইউনূস। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার গোষ্ঠীর ‘মাইনাস’ ফর্মূলাটি সফল হলে ইউনূস গং ক্ষমতায় বসবে, আর বাংলাদেশ হয়ে যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্ত একটি ঘাঁটি, এমনই ছিল পরিকল্পনা। ইউনূসকে রাজনৈতিক দল গঠনের দায়িত্ব দেন জেনারেল মঈন। আর এভাবে দেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তিত্ব সামরিক শাসকের গোলাম হবার কাজে হাঁটা শুরু করেন। মঈনের মাথার ওপর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ছাতা, এটা মনে রাখুন।

ইউনূস দলের চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মঈন তাকে কিংস পার্টির চেয়ারম্যান করে না দেওয়ায় দুই নেত্রীকে মাইনাস করে দেশের অধীশ্বর হবার স্বপ্নপূরণ হয়নি ইউনূসের। এদিকে আরেক সুশীল ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে মঈনের সখ্যতা ছিল। মঈনের সামরিক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন দেবপ্রিয়। এজন্য তিনি সেনা সদরদপ্তরে সাক্ষাৎকারও দেন। কিন্তু মঈনের শাসন বেশিদিন না টেকায় দেবপ্রিয়র স্বপ্নও ভেঙে যায়। যদিও তার গলাবাজি চলমান এখনো। এরা জ্ঞানী লোক। কিন্তু ক্ষমতার লোভে হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। রক্তমাংসের মানুষ হলেও তারা দেবতার ভাব ধরেন। ধরাকে সরা জ্ঞান করেন।

ড. ইউনূসের রাজনৈতিক অভিলাষ কিন্তু এটাই প্রথম নয়। এর আগে তিনি ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘পথের বাধা সরাতে হবে’ শিরোনামের একটি লিখিত বক্তব্য দেন। গণফোরামের ভবিষ্যত অন্ধকার টের পেয়ে তিনি আর এতে জড়াননি। জেনারেল মঈনের সঙ্গেও ড. ইউনূসের সম্পর্ক বেশদিন টেকেনি। সেই মঈনকে আশ্রয় দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তিনি এখন সেখানেই বসবাস করেন। অন্যদিকে ইউনূস হোঁচট খেলেন, জনগণের কাছে পাত্তা পাননি।

কর্পোরেট কোম্পানি চালানো আর দেশের মানুষের পালস বুঝে রাজনীতি করা যে এক নয়, তা বুঝতে পেরে ধাক্কা খান ইউনূস। তার বোঝার কথাও নয়। তিনি কাজ করেছেন অর্থনীতি নিয়ে, যদিও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন শান্তিতে। কী এমন বিশ্বশান্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো? এটা এখনো এক রহস্য বটে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছে। আসুন, এটা নিয়ে কিছু তথ্য দেওয়া যাক।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। নরওয়েজিয়ান পালার্মেন্ট এই নোবেল কমিটির মনোনয়ন দেয়। আর গ্রামীণফোনেরও মালিক নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর, যা নরওয়ে সরকারের মালিকানাধীন। বিশ্বের অনেক দেশে তাদের ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা আর বিনিয়োগ রয়েছে। এখন আসা যাক গ্রামীণফোনের বিষয়ে। শান্তিতে নোবেলদাতা দেশ নরওয়ের সরকারি সংস্থা টেলিনর-এর সাথে ইউনূসের ব্যবসার মধ্যে অভ্যন্তরীণ কী গোমর ছিল সেটা একটা রহস্য। রহস্যটা ফাঁস করা হবে একটু পর।

শুরুতে গ্রামীণফোনের সুন্দর একটি ”দেশীয় লোগো” ছিল। গ্রামীণ কৃষক-কৃষাণীরা মোবাইল ফোন কানে দিয়ে কথা বলছেন। লাল-সবুজের লোগো। বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও বোঝানো হচ্ছিল, এটা বাংলাদেশি ফোন। বাঙালি আবেগী জাতি। লোগো আর বিজ্ঞাপনে ধরেই নিয়েছে, এই কোম্পানির মালিক গ্রামীণ জনগণ, গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব সদস্যরা। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, গ্রামীণফোনও একচেটিয়া ব্যবসা করে গেল। প্রতি মিনিটে ১০ টাকা করে চার্জ কাটে, ইনকামিং-আউটগোয়িং দুদিকেই কাটত টাকা। ৩০০ টাকার, ৬০০ টাকার কার্ড চার্জ করে কথা বলতে না বলতেই ফুড়ুৎ!

তবুও জনগণ হুমড়ি খেয়েছে। কারণ, সাধারণের ধারনা- এর লভ্যাংশের মালিক তো তৃণমূল জনগণ। আর গ্রামীণফোনের মালিক তো গ্রামীণ টেলিকম, যে ‘গ্রামীণ’ ব্র্যান্ডনেম-এর কপিরাইট গ্রামীণ ব্যাংকের। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকের মতোই তাদের সিস্টার কনসার্ন গ্ৰুপ গ্রামীণ টেলিকম। যেমন আছে- গ্রামীণ চেক, গ্রামীণ শক্তি ইত্যাদি। যার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ‘প্রখ্যাত’ ইউনূস সাহেব। এনজিও এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নামের আবেগ ব্যবহার করে লাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরী করাও একটি বড় রকমের প্রতারণা। ভাবখানা এমন, এসবেরও লভ্যাংশ পাচ্ছেন গ্রামীণ ব্যাংকের তৃণমূলের সদস্যরা। আসলে পাচ্ছেন ইউনূস সাহেব একা, আর কেউ না।

এমনই ছিল সাধারণ মানুষের প্রচলিত ধারণা। সাধারণ জনগণকে এভাবেই বোঝানো হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার ৮ বছর পর গ্রামীণ ফোনের লোগো হঠাৎ এক রাতেই বদলে গেল। লাল-সবুজের ফোন হয়ে গেলো নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির ফোন। অর্থাৎ টেলিনর কোম্পানির লোগো বসে গেল গ্রামীণফোনে। যেই নরওয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়, সেই নরওয়ের সরকারের কোম্পানি এই টেলিনর, যার নাম আগে বাঙালি শোনেনি। ২০০৬ সালের ১৮ই নভেম্বর এক রাতেই লোগো বদলে গেল এবং ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন এর ঠিক ২২ দিন পর, অর্থাৎ ১০ই ডিসেম্বর ২০০৬। কী বুঝলেন?

[সাফাই গাইতে গিয়ে উল্টো ইউনূসের বস্ত্রহরণ!]

আসুন, ইউনূস এবং গ্রামীণফোনের সম্পর্কটা আসলে কোথায়, সেই রহস্যটা ফাঁস করি।

নরওয়ের টেলিনর-এর মালিকানাধীন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন-এর ৩৪.২০ শতাংশের মালিক ড. ইউনূসের মালিনাকাধীন গ্রামীণ টেলিকম। গ্রামীণফোনের কাছ থেকে প্রতি বছর গ্রামীণ টেলিকম ডিভিডেন্ট পায় হাজার কোটি টাকার ওপরে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই তাদের ডিভিডেন্ট এসেছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যার ৫% শ্রমিক কল্যাণে দেওয়ার কথা থাকলেও ১ টাকাও পরিশোধ করেনি গ্রামীণ টেলিকম। আর এভাবে ২০০৬ সাল থেকে জমতে জমতে এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকায়। ফলে ক্ষুব্ধ কর্মীরা বকেয়া পাওনা চেয়ে ১০৭টি মামলা দায়ের করেছেন।

মামলার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর টনক নড়ে ইউনূস গং-এর। ঢাকার শ্রম আদালতে দায়েরকৃত ১০৭টি মামলা থেকে বাঁচতে প্রায় ১৪ কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দেয় গ্রামীণ টেলিকম। যে কোনোভাবেই হোক এই মামলা জিতিয়ে দিতে চুক্তি সই করে গ্রামীণ কল্যাণ আর ঢাকা লজিস্টিক সার্ভিসেস অ্যান্ড সলিউশন। আর, সেই চুক্তি অনুমোদন করেন খোদ ড. ইউনূস।

২০২১ সালের ১৪ই জুন পরিচালনা পর্ষদের ভার্চুয়াল সভায় মামলাগুলো জিততে ঢাকা লজিস্টিকের সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়। চুক্তি অনুসারে, ঢাকা লজিস্টিক মামলাগুলোর রায় গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষে আনতে প্রশাসনের বিভিন্ন পক্ষের সাথে ‘এনগেইজ’ করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘সন্তুষ্ট’ করার কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলা, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং শ্রমিক নেতাদেরও। এই পুরো কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যয় ধরা হয়ছে ১৪ কোটি টাকা। বোর্ড সভায় এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমোদন দেন স্বয়ং ড. ইউনূস।

এর আগেও মামলা করার অপরাধে ৯৯ জন কর্মীকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরাসরি ছাঁটাই করে গ্রামীণ টেলিকম। সেই মামলা জিততেও গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আদালতে ঘুষ দেয় ইউনূস কোম্পানি। সেই উদাহরণটিও উল্লেখ করা হয় এই চুক্তিপত্রে। যদিও এসব তথ্য স্বাভাবিকভাবে উঠে আসেনি ইউনূস সেন্টারের বিবৃতিতে। জনগণের সামনে ইউনূসের মুখোশ খুলে দেওয়ার স্বার্থে সংযুক্ত করা হলো।

কোনো হুমকি-ধমকিতে পিছপা হননি শেখ হাসিনা। সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষে তা উদ্বোধনও করেছেন। একটি সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের অভিনন্দন আসে, এটা আগে কখনও দেখা যায়নি। এতে বোঝা যায়, এই সেতু বাংলাদেশের জন্যে বিশেষ কিছু। দেশের মানুষের কাছে এর নাম এখন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পত্রিকার কল্যাণে দেখা গেছে উচ্ছ্বসিত জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের সন্তানের নাম রেখেছেন এই সেতুর নামে। এই সেতু দেশের অনেকের মন খারাপ করে দিয়েছে, অনেককে বিবস্ত্র করেছে। অনেক ষড়যন্ত্রীকে নতুন করে জাতির সামনে তুলে ধরেছে।

আর তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের বিবৃতিতে ড. ইউনূস নিজেকে ফেরেস্তা প্রমাণে বলতে চেয়েছেন, কিরা কেটে বলছি, আমি কিস্যু করিনি পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে চাঁদা দেইনি। কিন্তু ইউনূসের বক্তব্য যে অসার-অসত্য এর প্রমাণ তো মার্কিন নথি। উইকিলিকসও তা ফাঁস করে দিয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে। এসব জেনেও বিবৃতি দিয়েছে ইউনূস সেন্টার। কারণ তো আগেই বলা হয়েছে। ইউনূস এসব অভিযোগকে (আসলে প্রামাণিক দলিল) অস্বীকার করেছেন, সেই লেজুড় যেন সংবাদে যুক্ত হয়, সেজন্যই এই বিবৃতি।

এদিকে পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। একে একে উদ্ঘাটিত হবে অনেক ষড়যন্ত্রের খবর। উন্মোচিত হবে অনেকের মুখোশ।

জনাব নোবেল লরিয়েট ইউনূস, পদ্মা সেতু নিয়ে জাতির বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এবার অন্তত ক্ষমা চান। তাতে যদি পাপের বোঝা একটু কমে।

আরও পড়ুনঃ