
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শফিকুল ইসলাম। এই সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠার পর সরে যান আগের প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। তার জায়গায় ২০১১ সালের নভেম্বরে নিয়োগ পান শফিকুল। বাংলাদেশের অহংকার পদ্মা সেতুর ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের পুরোটা দেখভাল করেছেন তিনি। বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটি উদ্বোধনের ক্ষণে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অভিজ্ঞ এই প্রকৌশলী।
প্রশ্ন: দাতা গোষ্ঠী পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প থেকে চলে যাওয়ার পরের কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেয়া হলো?
শফিকুল ইসলাম: আমি শুরু থেকে এই প্রকল্পে ছিলাম না। এখানে এসেছি ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার কারণে ক্রাইসিস তৈরি হলো। তখন আমাদের সে সময়ের সচিব, পিডি (প্রকল্প পরিচালক), এমনকি মন্ত্রীও চলে গেছেন। ওই সময়ে আমি এলাম এবং একজন নতুন মন্ত্রী ও নতুন সচিবও এলেন দায়িত্বে।
বাই দিস টাইম ডিজাইন ওয়াজ কমপ্লিট। টেন্ডার ডকুমেন্ট ওয়াজ কমপ্লিট, প্রি কোয়ালিফিকেশনও কমপ্লিট। সরকার বলল, যেখানে থেকে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আমরা শুরু করব।
আমরা কিছু কিছু ফাউন্ডেশন পেয়েছি। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছি, এটা বলা ঠিক হবে না, ভুল হবে। নির্মাণকাজের শুরুটা আমাদের সময়ের। তার মানে ফুল টেন্ডার, টেন্ডার প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশন আমাদের হাতে হয়েছে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন হলো প্রকিউরমেন্ট। প্রকিউরমেন্টে অনেক গন্ডগোল লাগে, মামলা-মোকদ্দমা হয়, এটা-সেটা অনেক কিছু হয়। এই প্রকল্পে ওসব কিছু ওভারকাম করে আমরা নির্মাণকাজ করতে পেরেছি।
প্রশ্ন: চ্যালেঞ্জ নেয়ার সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?
শফিকুল ইসলাম: এখানে আসার আগে আমি ঢাকা-চট্টগ্রামে ফোর লেন প্রজেক্টের অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও পিডি ছিলাম। ওটা তখন রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট ছিল। তো আমি চ্যালেঞ্জটা নেয়ার জন্যই এখানে এসেছিলাম। ভাবলাম, দেখি না কেউ না কেউ তো এটা করবেই। সো হোয়াই নট মি? ওটা আমার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল।
আরো পড়ুনঃ পদ্মা সেতুর নাট খোলা নিয়ে অপপ্রচারে বিএনপি!
প্রশ্ন: আপনি তো একটা অচলাবস্থা থেকে শুরু করলেন, সে ক্ষেত্রে…?
শফিকুল ইসলাম: ওটা অচলাবস্থা ঠিক আছে, কিন্তু উই গট সাপোর্ট ফ্রম এভরি কর্নার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের বললেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করব। অনেকের প্রশ্ন ছিল যে, নিজস্ব অর্থায়ন কীভাবে সম্ভব? কারণ আমাদের বাজেটের আকার এমন, এটা হলে সব উন্নয়ন থমকে যাবে। একই সঙ্গে এত ফরেন কারেন্সি আমরা কোথায় পাব? ৮০ ভাগ ফরেন কারেন্সি, আড়াই বিলিয়ন ডলার ফরেন কারেন্সি লাগবে। এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় কাজ করেছে।
তখন আমি মিটিং করেছি ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে। সে সময় উনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ছিলেন। ওনার সঙ্গে মিট করা হলো। আমার ব্যাংকার ছিল অগ্রণী ব্যাংক। তাদের দুই জিএম সাহেবকে নিয়ে আমি গেলাম। তারপর ওনাকে ব্যাখ্যা করলাম যে টাকা তো আমাদের একবারে লাগবে না। চার-পাঁচ বছরে টাকাটা লাগবে।
শুনতে আড়াই বিলিয়ন ডলার মনে হলেও এটা তো আর একসঙ্গে লাগছে না। বাংলাদেশের তখনকার বাজেটের হয়তো একটা বড় অংশ, তবে পরের বাজেটে কিন্তু এটা কমে আসবে। কারণ বাজেট বড় হচ্ছে। আমার সেতুর বাজেট তো আর সামনে বাড়বে না।
ওনারা কনভিন্সড হলেন। অগ্রণী ব্যাংক বলল, যে টাকাটা লাগবে তারা দিতে পারবে। আমি বললাম, আমার এক মাসে ম্যাক্সিমাম ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) ডলার লাগতে পারে। তখন অগ্রণী ব্যাংক বলল, তারা এটা দিতে পারবে।
গভর্নর সাহেব খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে ফাইন। তাহলে তো আমার ওপর কোনো চাপই নাই। লাগলে আমি আপনাকে সাহায্য করব।’
পরে বিষয়টা আমরা আমাদের হাই অথরিটির কাছে ব্যাখ্যা করলাম। তারাও দেখল টাকা তো আর একবারে লাগছে না। আমাদেরও কনফিডেন্স বাড়ল, ঠিক আছে, উই ক্যান পে। ফরেন কারেন্সির জন্য কোনো সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন: এই আলোচনা কি প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে হয়েছিল?
শফিকুল ইসলাম: এটা আসলে নির্দিষ্টভাবে মনে নেই। এটা একটা চলমান প্রসেস ছিল। আমরা মালয়েশিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলাম। অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলাম। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রকম কাজ হচ্ছিল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা হয়তো উনি (প্রধানমন্ত্রী) পরেই দিয়েছেন।
ওই সময়ে আমরা একাধিকবার মালয়েশিয়ায় গেছি। ওরাও আমাদের দেশে এসেছে। সেটাও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই হয়েছে।
যতটুকু জানি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে আমাদের মরহুম অর্থমন্ত্রী মহোদয় (আবুল মাল আবদুল মুহিত) রাজি ছিলেন না। ওনার ধারণা ছিল এতে বাজেটে চাপ পড়বে। সে জন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছিল বাজেটের চাপ কমানোর জন্য।
প্রশ্ন: এটা তো অর্থায়নের দিক গেল, কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতারা চলে যাওয়ার পর টেকনিক্যাল গ্র্যাউন্ডেও তো আপনাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছিল…
শফিকুল ইসলাম: হ্যাঁ। এই প্রকল্পে অর্থনীতি একটা পার্ট, তবে সবটাই তো আর অর্থনৈতিক নয়। এর মধ্যে অনেক সামাজিক ও কারিগরি দিকও আছে।
দাতারা চলে যাওয়ার পর আমরা যদি নিজেরা টেন্ডার করি, সেগুলো ইভ্যালুয়েশন করি তাহলে বিদেশিরা নাও আসতে পারত। তারা ভাবতে পারে যে বাংলাদেশের খুব বেশি সুনাম নাই।
যারা টেন্ডার জমা দেয় তাদের অনেক খরচ হয়। এই টেন্ডারটা দিতে গেলে আপনাকে ৫-১০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। তারটা যথাযথ মূল্যায়ন হবে কি না, সেই আস্থা না থাকলে সে নাও আসতে পারে। তখন আমি আমাদের সচিব মহোদয়কে পরামর্শ দিলাম, যারা ডিজাইন করেছে তাদের কাজ শেষে তারা চলে যাবে ডকুমেন্ট বানিয়ে। তো ওদেরকে আমরা প্রকিউরমেন্টে রেখে দিই। আমাদের নিজস্ব টাকায় তার মধ্যে কনট্রাক্ট আমরা এক্সটেন্ড করলাম, যাতে প্রকিউরমেন্টে তারা হেল্প করে।
এই যে এত বড় টেন্ডার, তার দুটি পার্ট। একটা টেকনিক্যাল আরেকটা ফাইন্যান্সিয়াল। টেকনিক্যাল পার্টটা ইভ্যালুয়েশন করার যোগ্যতা ফ্র্যাংকলি আমাদের নাই। আমরা এত বড় ব্রিজ করি নাই আগে। আমি এবং আমাদের টিম অনেক ব্রিজ করেছি। আমার ডিপিডি সাহেব পাকশী ব্রিজ করেছেন, তবে পাকশী ব্রিজ পদ্মা ব্রিজের কাছে কিছুই না। আমি নিজেও বহু ব্রিজ করেছি; ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০ মিটার ব্রিজ করেছি, কিন্তু এত বড় ব্রিজ তো দেশে হয়নি আগে।
কাজেই কারিগরি মূল্যায়নটা তারা ছাড়া আমাদের দ্বারা করা সম্ভব ছিল না। সে জন্য তাদের রেখে দেয়া হয়েছিল। তারা পুরো প্রকিউরমেন্টটায় আমাদের হেল্প করল। এটা একটা জটিল প্রকিউরমেন্ট। এটাতে বিদেশিরাও আস্থা পেল যে এইকমের মতো একটা কনসালট্যান্ট আমাদের প্রকিউরমেন্ট টিমে থাকবে। তখন আমরা একটা আস্থা পেলাম যে তারা টেন্ডারে পার্টিসিপেট করবে এবং তা করলও।
তারা অনেক টাইম চেয়ে নিয়েছিল, আমরা টাইম দিয়েছি। যদিও চাপ ছিল তাড়াতাড়ি করার জন্য। আমরা কর্তৃপক্ষকে বোঝালাম, তাড়াহুড়া করলে আমরা টেন্ডারই পাব না। তখন কী হবে? আমরা আট মাস এডিশনাল টাইম দিয়েছি, কারণ ওদের আনতে হবে। তারা যদি না আসে তাহলে তাড়াহুড়া করে লাভ কী? কার জন্য তাড়াহুড়া করছি?
প্রশ্ন: কতটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল?
শফিকুল ইসলাম: আবেদন তো আগেই হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক আমাদের টেন্ডার ডকুমেন্ট রেডি করে দিয়ে গেছে; প্রিকোয়ালিফেকেশন করে দিয়ে গেছে। কোরিয়া, চীন এবং ইউরোপের একটি দেশের প্রিকোয়ালিফাইড টেন্ডার ছিল। ওদের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। কারণ প্রিকোয়ালিফিকেশন একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নতুন করে করতে হলে আবার অ্যাপ্লিকেশন আহ্বান করতে হবে, যাতে দেড়-দুই বছর চলে যাবে।
কারণ প্রিকোয়ালিফিকেশন করতে হলে প্রচুর ডকুমেন্ট শো করতে হয়। সাইট ভিজিট করতে হবে, খরচ আছে। তাই আমরা বললাম, যেখানে শেষ করেছি, সেখান থেকে আবার শুরু করছি। এটাই ছিল আমাদের ইনস্ট্রাকশন। যেখানে শেষ, সেখান থেকে আবার শুরু।
যে ডকুমেন্টগুলো ছিল সেগুলো কোনো চেঞ্জ করিনি। ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্ট এবং এনবিআরের ভেটেড করা। একটা পরিবর্তন ছিল ডোনারের স্থানে। ডকুমেন্টে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের জায়গায় জিওবি বসানো হয়েছিল। অন্য কিছু পরিবর্তন করা হয়নি, যাতে কোনো আস্থা নষ্ট না হয়।
ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারে কিছু কন্ডিশন থাকে, যেটা উইন উইন সিচুয়েশন। এটা কারও ফেভারে থাকে না। কনট্রাক্টর এবং ওনার দুজনের পক্ষেই থাকবে। আর যদি আরবিট্রেশন হয়, সেটা হবে সিঙ্গাপুরে, বাংলাদেশে না। এটা আমরা মেনেই নিয়েছি, কারণ ইন্টারন্যাশনালই কেউ আসতে চাইবে না। যেখানে যারা যারা ছিল ওদের মাধ্যমেই আমরা আবার করেছি। এটাই নিয়ম। বিশ্বব্যাংক যা করত, আমরা তাই-ই করেছি।
প্রশ্ন: সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রাথমিক হিসাব থেকে কয়েক গুণ বাড়ার কারণ কী?
শফিকুল ইসলাম: ২০০৭ সালে আমরা প্রথম টেন্ডার করেছি। এরপর জাইকা বলল, ফিজিবিলিটি স্টাডি করলে একটা কস্ট ধরতে হয়, সেই কস্টটা আমরা ডিপিপি করলাম। ডিপিপিতে লেখা ছিল, ডিটেইল ডিজাইন করার পরে এই ডিপিপিটাকে আবার রিকাস্ট করা হবে। এটা ওদের শর্ত ছিল।
কারণ তখন তো কোনো টেন্ডার নাই, ডিজাইন নাই, পাইল কয়টা হবে জানা নাই। এমনকি সে সময় রেলওয়েটা ইনক্লুডেড ছিল না। সে সময় অনুমানের ভিত্তিতে উইদাউট রেল হিসাব করা হয়েছিল। তখন এমন ছিল যে, তিনটা স্প্যান থাকবে নেভিগেবল (নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের উপযোগী), বাকিগুলো থাকবে নিচু। শুধু তিনটা স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌ চলাচল করতে পারবে, এমন কনসেপ্টে কাজ শুরু হয় প্রথমে।
কাজ শুরু করতে হলে একটা ডিপিপি লাগে। ডিপিপি ছাড়া কাজ শুরু করা যায় না, কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া যায় না, জমি অধিগ্রহণ করা যায় না। ডিপিপি ছাড়া আপনি টাকা পাবেন কোথায়? ওই জন্য ২০০৭ সালে ডিপিপিটা করা হয়েছিল।
তারপর ২০১১ সালে ডিটেইল ডিজাইন হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক বলল তোমরা ডিপিপিটা রিভাইস করো। আমরাও সিদ্ধান্তে এলাম রেললাইন করব, ডাবল স্টেক কনটেইনার করব, নদীশাসনের জন্য কিছু কাজ বাড়ল।
তখন আবার আরডিপিপি করব কীভাবে…কারণ অনেক কিছুর রেট আমাদের জানা নেই। আমাদের আশপাশের কোনো দেশে নিচে ট্রেন আর ওপরে রোড দিয়ে কোনো ব্রিজ হয়নি। ১২০ মিটার পাইল আমাদের কোথাও হয়নি। তাহলে এই রেটটা পাবে কোথায়?
তখন সিদ্ধান্ত হলো, অনুমানের ভিত্তিতেই এটা করা হোক। কারণ এর ওপর ভিত্তি করেই তো বিশ্বব্যাংকে লোন হবে। আগের কস্টে লোন দিলে তো হবে না। কাজের ব্যাপকতা হিসাব করে তারা আবার একটা ডিপিপি করল টু নেগোশিয়েট উইথ দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকার সঙ্গে। তখন ২০১১ সালে ডিপিপি করা হলো ২০ হাজার কোটি টাকা। আগে ২০০৭ সালেরটা ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা।
এই নতুন ডিপিপিতে কস্ট কম রাখার জন্য ডলারের রেট বাড়ানো হয়নি, আগের রেট ৬৯ টাকাই রাখে। আগের ডিপিপি ছিল ২০০৭ সালের, যা ২০১১ সালের বাস্তবতা ছিল না।
ডলারের আগের রেট রাখার কারণ হলো, বেশি টাকা দেখালে বিশ্বব্যাংক হয়তো লোন দিতে চাইবে না। এটা আমার শোনা কথা, কারণ সে সময় আমি ছিলাম না।
তবে এটাও তো ঠিক ২০১১ সালে এসে ডলারের রেট ৬৯ টাকা থাকবে কেন? এটা তো থাকার কথা না। তারপর ২০১১ সালে আমরা আসার পর টেন্ডারে গেলাম। ২০১৪ সালে টেন্ডারগুলো পেয়ে গেলাম। টেন্ডার পাওয়ার পর যেই কমপিটিটিভ প্রাইস পেলাম সেটাই আমরা অ্যাকচুয়াল খরচ ধরেছি।
কারণ এর কমে কে কাজ করবে? কমপিটিটিভ প্রাইস পাওয়ার পর ডিপিপি রিভাইজ করলাম ২৮ হাজার কোটি টাকায়। এটা কিন্তু আমাদের যে নিজস্ব কনসালট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এসটিমেট করছে, তার চেয়ে প্রায় ৭-৮ শতাংশ কম। এ জন্য আমাদের ইভ্যালুয়েশন কমিটি রিকমেন্ড করল যে এর থেকে আর কম পাওয়া যাবে না। আমাদের জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের নেতৃত্বে একটা ইন্টারনাল প্রকিউরমেন্ট কমিটি ছিল। ওনারা এটা একসেপ্ট করলেন।
দেশের আইন অনুযায়ী আমরা কনসালট্যান্টের ওপর ভিত্তি করে কিছু করতে পারি না। প্রত্যেকটা টেন্ডারে একটা ইভ্যালুয়েশন কমিটি থাকে, সেখানে আমাদের ডিপার্টমেন্টের লোক থাকে এবং বাইরের লোকও থাকে। সেখানে আমরা ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার এবং বুয়েটের কয়েকজন প্রফেসরকে রাখলাম। কারণ এটা জটিল কাজ।
কনসালট্যান্টের কাজ রিকমেন্ড করা আর ইভ্যালুয়েশন কমিটির কাজ আইনগত দিক বিচার করা। সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য তাদের লাগবে। তো সবার মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে ২৮ হাজার কোটি টাকা এগ্রি করা হলো।
পরবর্তী সময়ে আবার ১৪০০ কোটি টাকা বাড়ল। আমাদের কথা ছিল এখানে ৪০০ কোটি সিএফটি বালি উত্তোলন হবে। আমরা যে মাটির নিচে ২৮ মিটার পর্যন্ত যাবে, সেই বালি রাখব কোথায়? ২০১১ সালের ডিপিপিতে ছিল যে নদীর চরের যে খাস জমি আছে, সেখানে ফেলব। সেটার জন্য সে সময় কস্ট ধরা ছিল না। ২০১৬-২০১৭ সালে দেখা গেল, শরীয়তপুর অংশে চরে বালি ফেলতে পারলাম, কিন্তু মাদারীপুরে আমাদের ফেলার সুযোগ হলো না। ওখানকার লোকজন জমি ভাড়া দিল না। তারা জমি অ্যাকোয়ারের জন্য রাজি হলো। তখন সাড়ে ১১০০ হেক্টর জমি অ্যাকোয়ার করা হলো ১৪০০ কোটি টাকায়। তাই মোট ব্যয় বেড়ে হলো ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
পরবর্তী সময়ে জমি অ্যাকোয়ার বাদে সেতুর মূল কস্ট কিন্তু ২৮ হাজার কোটি টাকাই আছে। এটা একটা রেকর্ড বলতে পারেন যে, ২০১৬ সালে যে এস্টিমেট ছিল, এখন পর্যন্ত এক পয়সাও তার থেকে বাড়েনি। গত সাত বছরে বাড়েনি।
এখন আমাদেরকে বলা হচ্ছে ২০০৭ সাল থেকে বাড়ল কেন? ২০১০ সাল থেকে বাড়ল কেন? এগুলোর জবাব দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
কেন ২০০৭ সালে এত কম কস্ট ধরল, কেন রেল অন্তর্ভুক্ত করল না, কেন তারা শুধু তিনটা স্প্যান নেভিগেবল রাখল, আমার জানা নেই।
তিনটা স্প্যান নেভিগেবল থাকলে কী হতো…আমাদের এক্সপার্ট যারা তারা বললেন…এই নদী একবার এই দিকে, একবার ওই দিকে নেভিগেবল থাকে। তাহলে মাঝখানের তিনটা যদি শুধু নেভিগেবল রাখি তাহলে একটা সময় চর পড়ে যাবে। তাহলে জাহাজ বা নৌকা যাবে কোন দিক দিয়ে? এ জন্য চেষ্টা করতে হবে ফুল নেভিগেবল রাখার। সেতুর নিচে সব স্থান দিয়ে যেন নৌ চলাচল করতে পারে। আর এ জন্য আমাদের হাইট বাড়াতে হলো। এতে খরচ বেড়ে গেল।
প্রশ্ন: এই ব্রিজের পরিকল্পনা করার সময় আপনারা নাব্যতার হিসাব কীভাবে করেছেন?
শফিকুল ইসলাম: ব্রিজ টেকসই ধরা হয়েছে ১০০ বছর। আর নাব্যতার ব্যাপারে আমাদের যেটা স্টাডি… প্রতি ১২ থেকে ১৫ বছরে একবার মাওয়া পাড়ের দিকে থাকে, আবার অন্য পাড়ে চলে যায় নাব্যতা। যেমন এখন ২-৩ বছর ধরে জাজিরার দিকে চলে যাচ্ছে। আমাদের অ্যাকোয়ার করা জমি নদীর ভেতরে চলে গেছে, যেটা ম্যাপ দেখলেই বোঝা যাবে। এখন আর এদিকে নাব্যতা নাই। আপনি পুরোনো ফেরিঘাটের দিকে যান, দেখবেন চর পড়ে গেছে।
প্রশ্ন: এমন কি হতে পারে যে ৫০ বছর পর সেতুর নিচেই আর পদ্মা নদী নেই?
শফিকুল ইসলাম: বর্তমান যে অংশে সেতু, এর বাইরে পদ্মার না যাওয়ার জন্যই তো নদীশাসন। নদীকে শাসন করা হচ্ছে যে তুমি বাইরে যেতে পারবে না। ডান দিকের এই সীমানা, বাম দিকের এই সীমানা। এর ভেতরেই থাকতে হবে। নদী তার মর্জিমতো বহমান থাকবে, কিন্তু আমাদের সীমানার বাইরে যাতে না যেতে পারে, সে জন্যই নদীশাসন।
প্রশ্ন: তার মানে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বিষয়টি আপনারা মাথায় রেখেছেন…
শফিকুল ইসলাম: হ্যাঁ। ওটাই তো মূল কাজ। যেমন যমুনাতে আমাদের ব্রিজের চাইতে নদীশাসনের ব্যয় বেশি ছিল। যমুনা কিন্তু ১২ কিলোমিটার ছিল, সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটারে আনা হয়েছিল, বাকি সাত কিলোমিটার ডিক্লাইন করা হয়েছে। ওই যে এক জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তারপরও তো চর পড়ছে।
প্রশ্ন: কিছু মানুষ মনে করেন পদ্মা হলো সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল সেতু। আপনি কী বলবেন?
শফিকুল ইসলাম: আপনারা তো সাংবাদিক। আমি আপনাদের অনুরোধ করব আপনারা অনুসন্ধান করেন। আমার মুখের কথায় হবে না, আমি আপনাকে কিছু হিন্টস দিচ্ছি, আপনি সেটা অনুসন্ধান করেন। আমি তো আমারটার সাফাই গাইবই। আমি সঠিক বলছি কি না, সেটা যাচাই করেন।
সম্প্রতি আমাদের দাউদকান্দি, মেঘনা আর শীতলক্ষ্যার যে ব্রিজ হলো, সেই তিনটা মিলে তিন কিলোমিটারের কম। সেখানে কত খরচ হয়েছে?
ওই নদীগুলো তো পদ্মার মতো কঠিন নদী না; লেকের মতোই। তো এই নদীতে ব্রিজ করতে প্রতি মিটার বা কিলোমিটারে কত খরচ হলো আর পদ্মা সেতুতে কত খরচ হলো সেটা আপনারা বের করেন প্লিজ।
সব তথ্যই দেয়া আছে। আপনি গত বছরের এডিপিতে গেলেই দেখতে পাবেন কার কত খরচ হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে। উইদাউট রেল আর নদীশাসন বাদ দিয়ে ব্রিজ টু ব্রিজ তুলনা করেন। ওরা কত খরচ করেছে আর আমি কত খরচ করছি। আবার শুধু রেলওয়ে ব্রিজ হচ্ছে, সেটার সঙ্গে তুলনা করেন।
প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয়?
শফিকুল ইসলাম: সেটা আপনারা বের করেন। আমি মনে করছি পদ্মা ব্রিজ ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট কস্ট ব্রিজ।
প্রশ্ন: পদ্মা তো একটা বিশেষায়িত নদী…
শফিকুল ইসলাম: বিশেষায়িত দরকার নেই। আপনি অবিশেষায়িতের সঙ্গে তুলনা করেন। তাতেই হবে। উইদাউট রেল তিন কিলোমিটারের কম ব্রিজে কত খরচ হয়েছে, আর ৯.৮ কিলোমিটারের পদ্মা ব্রিজে কত খরচ হয়েছে তুলনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আমার ব্রিজের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় বেশি খরচ হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে যদি আমি সবাইকে তুলোধোনা করি সেটা কি ঠিক হবে? আপনারা সাংবাদিকরা করতে পারেন। আমি একজন সরকারি চাকুরে হিসাবে আরেকটার সমালোচনা করতে পারি না, তবে যেটা বলা হচ্ছে সেটা সঠিক তথ্যভিত্তিক না।
প্রশ্ন: এই সেতু করতে কোন চ্যালেঞ্জগুলো নিতে হয়েছে, যেগুলো আপনাদের ধারণায় ছিল না?
শফিকুল ইসলাম: এখানে পানির স্রোত অনেক বেশি, প্রায় ৪ মিটার পার সেকেন্ড। কারণ দুটি নদীর সম্মিলন ঘটেছে এখানে। আমরা এর আগে পদ্মাতেও ব্রিজ করেছি, যমুনাতেও করেছি। লালন শাহ ব্রিজ করেছি পদ্মায়, আর যমুনায় করেছি বঙ্গবন্ধু সেতু, তবে এখানে কিন্তু ওই দুইটা নদীর কম্বিনেশন।
সাধারণ সেন্সই তো বলবে দুই নদীর স্রোত যখন এক জায়গায় আসে, তখন সমস্যা এমনিতেই বেশি হবে। যমুনায় আমরা তলদেশে ৮০ মিটার যাওয়ার পর হার্ড লেয়ার পেয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে এর থেকে মজার আর ভালো কিছুই হতে পারে না। আর এখানে আমরা ১৪০ মিটার গিয়েও হার্ড লেয়ার পাচ্ছি না। সে ক্ষেত্রে বিয়ারিংয়ের জন্য আমার অন্যান্য মেথড খাটাতে হয়েছে, যে কারণে অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।
৬০ শতাংশ মার্কস আর লেটার মার্কসের মধ্যে যে কত পার্থক্য, সেটা সেই শিক্ষার্থীই বোঝে যে জানে এর পেছনে কত পরিমাণ বাড়তি শ্রম আর মেধা লাগছে। তেমনই ৮০ মিটার পাইল আর ১২০ মিটার পাইলের মধ্যে পার্থক্য শুধু দেড় গুণ নয়, অনেক বেশি এনার্জি এখানে খরচ করতে হয়।
মাটির ভিন্নতা থাকার কারণে ২২টা পিলারে আমরা বিয়ারিং ক্যাপাসিটি পাইনি। পরে আবার ডিজাইন করা হয়েছে। সেখানে ছয়টার জায়গায় সাতটা পাইল দেয়া হয়েছে। তারপরেও আমাদের বিয়ারিং আসছিল না। তখন আমরা একটা নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করেছি। সেটার নাম গ্রাউটিং, যেটা আগে বাংলাদেশে ব্যবহার হয়নি।
আবার যে সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে সেটা আগে বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়নি। মাইক্রোফাইন সিমেন্ট, যেটা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে। এই সিমেন্ট আর গ্রাউটিং দিয়ে বিয়ারিং ক্যাপাসিটি বাড়ানো হয়েছে।
এরপরেও আমরা কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। শুধু থিওরিটিক্যালি দেখলে আসলে হবে না, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তো প্র্যাকটিকাল বিষয়। আপনারা দেখবেন পাইলিংয়ের লোড টেস্ট হয়। বিল্ডিং বানাতে গেলেও লোড টেস্ট করে। ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে ডিজাইন করে দেয় পাইলের লেন্থ এত হবে। সেটা হওয়ার পরে কিন্তু আবার লোড টেস্ট করে যে থিওরিটিক্যাল ক্যালকুলেশন বাস্তবের সঙ্গে মিলছে কি না। আমরাও তেমন টেস্ট করেছি এবং সেটায় ভালো ফল আসছে। এরপর আত্মবিশ্বাস আরও বাড়াতে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো টেস্ট করেছি। এটা বিশ্বে শুধু পদ্মা সেতুতেই হয়েছে। সেটাতেও ভালো ফল আসায় আমরা কনফার্ম হয়েছি, হ্যাঁ এখন এটাতে যেতে পারি।
পদ্মা সেতুতে ১২০ মিটার পাইল বিশ্বরেকর্ড। একই সঙ্গে গ্রাউটিং টেকনোলজি ও মাইক্রোফাইন সিমেন্ট দেয়াটাও বিশ্বরেকর্ড। আরও বিশ্বরেকর্ড হলো, আমরা ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য বিয়ারিং ব্যবহার করেছি ৯০.৬ হাজার কিলো ইউনিট টন, মানে সবচেয়ে বড়। পৃথিবীতে এত বড় বিয়ারিং আর কোনো সেতুতে ব্যবহার হয়নি। নদীশাসনের ক্ষেত্রেও বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। এখানে ২৮ মিটার ডেপথে এত বড় লেন্থে নদীশাসন আর কোথাও হয়নি।
প্রশ্ন: এই সেতু রিখটার স্কেলে কতটা ভূমিকম্প সহনীয়?
শফিকুল ইসলাম: এটা ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় .১৪ জি পর্যন্ত। আর সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য রিখটার স্কেলে ৮-এর কাছাকাছি।
আমাদের যে ডিজাইনটা করা হয়েছে, সেখানে দুই-তিনটা ক্রাইটেরিয়া রয়েছে। যখন আমরা নেভিগেশন ঠিক করি, তখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিবেচনা করেছি। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। আমরা এখন ১৮ মিটার বলছি, পরবর্তী সময়ে এটা হয়তো থাকবে না। সে জন্য আমরা আরও ৩০০ মিলিমিটার বাড়িয়ে ধরেছি, যাতে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে আমাদের সমস্যা না হয়।
এই নদী একটি সচল নদী। এখানে অনেক নৌযান চলাচল করে। তো সেগুলো অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুতে ধাক্কা দিতে পারে। এসব ধাক্কা যাতে সেতু সহ্য করতে পারে সে বিষয়টাও ঠিক রাখা হয়েছে। জাহাজের ধাক্কা লাগলেও যাতে ব্রিজের ক্ষতি না হয় ডিজাইনটা সেভাবে করা হয়েছে।
আবার আমরা যে ১২০ মিটার পাইল করেছি তার মধ্যে ৬২ মিটার এখনকার জন্য অদরকারি। আবার এটা ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ এমন হতে পারে পাইলের পাশ থেকে হঠাৎ মাটি সরে গেল। তখন কী হবে, বিয়ারিং কমে যাবে, যাতে বাকিটায় নিতে পারে সে জন্য এত বড় পাইল করা হয়েছে, কারণ নিচে তো হার্ড বেল্ট নেই।
প্রশ্ন: আমরা জেনেছি পদ্মা সেতুতে স্পেশাল লাইটিং থাকবে। সেটা কতদূর হলো?
শফিকুল ইসলাম: আর্কিটেকচার লাইটিংয়ের একটা প্রোভিশন আছে। আমরা এখনও শুরু করতে পারিনি। হয়তো জুলাই থেকে শুরু করা যাবে। এটা কারা করবে, সেটা এখনও ঠিক হয়নি, তবে বাংলাদেশে এ রকম ঠিকাদার নেই।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশেষ কী কী সরঞ্জাম ব্যবহার হয়েছে?
শফিকুল ইসলাম: এখানে যে ক্রেনটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা পাঁচ হাজার টন ক্যাপাসিটির। এর নাম তিয়ান-ই, চাইনিজ একটি ক্রেন। এটি পৃথিবীর অন্যতম বড় ক্রেন, সবচেয়ে বড় ক্রেন কি না জানা নেই। যেহেতু আমাদের স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন, তাই এর চেয়ে বেশি ক্যাপাসিটির ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে।
এ সেতুর ব্যবহৃত হ্যামারটাও বিশেষ হ্যামার। যমুনাতেও একই কোম্পানির হ্যামার ব্যবহার হয়েছিল, তবে সেটা এত বড় ছিল না। এখানে যেহেতু ডেপথ বেশি, তাই হ্যামারের ক্যাপাসিটিও বেশি লেগেছে।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতু দিয়ে যে ইউটিলিটি লাইন যাচ্ছে তার মধ্যে কী কী আছে?
শফিকুল ইসলাম: ইলেকট্রিক লাইন, গ্যাস লাইন আর অপটিক্যাল ফাইবারের কিছু অংশ। অপটিক্যাল ফাইবারের কাজ চলছে। আশা করছি জুনে না হলেও আগামী জুলাই মাসে শেষ হবে। ইলেকট্রিক লাইনের কাজ শেষ। আর গ্যাস লাইনের কাজও শেষ। কিছু টুকটাক কাজ আছে সেটা জুনের মধ্যেই শেষ হবে। তা ছাড়া ব্রিজের উদ্বোধনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কিছু টুকটাক কাজ হয়তো থাকবে। সেগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: সেতুতে ব্যবহার করা লাইটের কি কোনো বিশেষত্ব আছে?
শফিকুল ইসলাম: স্ট্রিট লাইটের মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই, তবে আমরা চেষ্টা করেছি কোয়ালিটি জিনিস দেয়ার। আমাদের ম্যানুফ্যাকচারকে বলেছি সুইজারল্যান্ডের ফিলিপসের কোয়ালিটিটা ফলো করতে, যাতে একটা পর্যায়ে আলো না কমে যায়। এটা কনট্রাক্টরের দায়িত্ব। আমরা মনিটর করেছি যাতে সঠিক জিনিসটা আসে। আবার ইলেকট্রিক পোস্টগুলোও চায়না থেকে আনা হয়েছে মান ঠিক রাখার জন্য।
প্রশ্ন: কুয়াশার সময় কোনো সমস্যা হবে কি না?
শফিকুল ইসলাম: কিছুটা ঝামেলা হতে পারে। কারণ এটা কুয়াশা প্রুফ লাইট না, তবে ফগ লাইট তো গাড়িতে থাকে।
প্রশ্ন: এত বড় প্রকল্প শেষ করা তো সাহসের কাজ…এটা করার পর বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা কতটা বেড়েছে?
শফিকুল ইসলাম: প্রধানমন্ত্রী তো নিজে বলেছেন বাংলাদেশের মর্যাদা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে। আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপাসিটি প্রমাণিত হয়েছে। এই ব্রিজটা তো আমরা বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়াররাই ম্যানেজ করেছি। যমুনা নদীতে ব্রিজ করার সময় চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ব্রিটিশ। এখানে চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমি।
আমি তো বুয়েটে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হওয়া লোক নই। আমি পিএইচডিও করিনি। তাহলে আমি যদি এটা করতে পারি তাহলে আমার সিনিয়র-জুনিয়র অনেকের সাহসও বৃদ্ধি পাবে। তারা ভাববেন, উনি যদি এত বড় কাজ করতে পারেন, তাহলে আমরা কেন নয়। এভাবেই তো সক্ষমতা বাড়ে। সাহস বাড়ে।
ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার আরও বড় বড় প্রকল্প নিচ্ছে। এটা তো অবশ্যই অনেক বড় উৎসাহের ব্যাপার। আমাকেই দেখে হয়তো অনেকে বলবেন, ইয়েস উই ক্যান ডু ইট। তা ছাড়া পদ্মা সেতুতে যারা কাজ করেছেন তাদের আরও বেটার অপরচুনিটি আসছে। এভাবেই তো মানুষ এগোয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অহংকার এই সেতুর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কী?
শফিকুল ইসলাম: যেকোনো কাজ শেষ করতে পারাটা তৃপ্তির। ছোট বা বড় যা-ই হোক, ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারাটা তৃপ্তির। এটা আল্লাহর রহমত। আমরা একটা বড় কাজ শেষ করতে পেরেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানানোর মতো জিনিস।
যদিও অনেকে অনেক কথা বলে, তবে আমরা মনে করি এটা ভালো কাজ হয়েছে। ১০০ বছর স্থায়ী হবে।