
পল জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন জার্মানির কুখ্যাত নাৎসি পার্টির একজন শীর্ষ নেতা। দলের প্রধান অপপ্রচারকারী (Chief propagandist) হিসেবে অফিসিয়ালি দায়িত্ব পালন করেন। সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে পরবর্তীতে হিটলারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন। গোয়েবলস বলতেন, একটি মিথ্যা দশবার প্রচার চালালে লোকে তা সত্য বলে মেনে নিতে শুরু করে। হিটলার এবং তার অনুসারীদের পতন ঘটলেও গোয়েবলসীয় ফর্মূলা টিকে যায়।
ক্যান্টনমেন্টে গড়ে ওঠা দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্থানে সেনা কলেজে পড়াশোনার সময় সেই গোয়েবলসীয় থিওরি আত্মস্থ করেন। যা তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে পুরোপুরি কাজে লাগান। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, বঙ্গবন্ধুর নাম, তাঁর ভাষণের কপি পর্যন্ত মুছে ফেলার সকল যোগাড়যন্ত্র করেছিলেন জিয়া। এমনকি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস নেতাদেরকে পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে মিথ্যা ইতিহাস গেলান কয়েকটি প্রজন্মকে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইতে বাংলাদেশের ওপর নিপীড়ন চালানো গোষ্ঠীকে ‘হানাদার’ বলে উল্লেখ করা হতো, পাকিস্থানের নাম পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি, পাছে শিশু-কিশোররা পাকিস্থানের আসল চেহারা সম্পর্কে জানতে না পারে। ছিল না বঙ্গবন্ধুর নাম ও তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কিত কিছু। পাকিস্থানপন্থীদের হাতে রচিত হয় বাংলাদেশের মিথ্যা ও ফাঁক-ফোকরযুক্ত ইতিহাস। নাৎসী গোয়েবলসীয় ফর্মূলা বহাল তবিয়তে চালিয়ে গেছে বিএনপি। জিয়ার সেই শিক্ষা যথাযথভাবে কাজে লাগায় তার দলের নেতারা।
আরো পড়ুনঃ ‘রাতের ভোট’ নামক প্রমাণহীন এক আজগুবি তত্ত্বের আবিষ্কার হয়েছিল যেভাবে
২৬ হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে হত্যা করা, লাখো সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতনকারী বিএনপিকে নাৎসী বাহিনীর সাথে তুলনা করা যায়। জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়া হলেন হিটলারের ভূমিকায়। আর সেই বাহিনীর বর্তমান শীর্ষ প্রোপাগান্ডিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দলের দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমদে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা।
তবে সাহিত্যের ভাষায় বেশ রসালো ভঙ্গিমায় গলাবাজি করতে পারে বলে বিএনপিতে বেশ কদর রয়েছে রিজভীর। নিজ বাড়িতে ঠাঁই নাই, দলীয় কার্যালয়ের একটি বিলাসবহুল কক্ষে বছরের পর বছর অবস্থানকারী ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এক আজগুবি তত্ত্ব বের করলেন। সারাদিন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার পর রিজভী যখন বুঝলেন বিএনপির ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই লন্ডন থেকে নাজিল হওয়া ‘ওহি’ অনুযায়ী লিখিত বক্তব্য নিয়ে হাজির হলেন মিডিয়ার সামনে। দাবি করলেন ভোট নাকি আগের দিন ‘রাতে’ করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ! তার এমন বক্তব্যে সারাদেশ স্তম্ভিত!
রাতে যদি ভোট হয়েই যায়, তবে রাতভর মিডিয়ার সামনে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরল না কেন বিএনপি? দিনভর ভোটে অংশগ্রহণ করার পর কেন সন্ধ্যায় রিজভীর সেই কথা মনে পড়লো? বাংলা সিনেমার স্মৃতিভ্রষ্ট নায়িকা যেভাবে দেয়ালে মাথা ঠুকে হারানো স্মৃতি ফিরে পায়, রিজভীও কি তবে বিএনপি কার্যালয়ের সিঁড়ির চিপায় দেয়ালে আঘাত পেয়ে হুঁশ ফিরে পেয়েছিলেন?
দেশের ন্যূনতম একটি ভোটকেন্দ্রেও রাতে ভোট হচ্ছে- এমন কোনো ঘটনারও স্থিরচিত্র বা ভিডিও বিএনপি কেন দেখাতে পারেনি আজ পর্যন্ত? রিজভী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কেন্দ্র দখল করে সব ব্যালটে সিল মেরে রাখে। তাহলে বিএনপি যদি নিশ্চিত হয়, তবে সিল মারার কোনো ছবি/ভিডিও নেই কেন? এমন প্রশ্নের কিন্তু কোনো উত্তর নেই। শুধু তা-ই নয়, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শতাধিক পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালের ভ্রাম্যমান সাংবাদিক ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে, তারাও পর্যন্ত রুহুল কবির রিজভীর এই আজগুবি তত্ত্বের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
তবে নাটকীয় বলে রাতারাতি স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অতি প্রচারের কারণে জনপ্রিয়তা পায় এই রূপকথার গপ্পোটি। গোয়েবলসীয় অপপ্রচারের পক্ষে কোনো সলিড তথ্য-প্রমাণ থাকে না।
হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া বিএনপি পরাজয় বুঝতে পেরে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু তারাও জানে এসব গালভরা বুলি দলের লোকজন বিশ্বাস করলেও কোথাও ধোপে টিকবে না।
নির্বাচনের সময় যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে বা কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটে, এ তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাছে আসতে হয়। সে তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই গণমাধ্যম এবং রিটার্নিং অফিসারদের কাছ থেকে। নির্বাচনের দিনও আমরা সারা দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সামনে বসা ছিলাম, তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমরা দেখেছি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ইসি চলে আইনের মাধ্যমে, যখন কোনো অভিযোগ আসে, তখন সেটার আমরা তদন্ত হয়, সে হিসেবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কোনো প্রিসাইডিং অফিসার যদি তাৎক্ষণিক জানায় সমস্যা হচ্ছে বা আমরা যদি কোথাও থেকে খবর আসে যে অনিয়ম হচ্ছে, তাহলে আমরাও নির্বাচন বন্ধ হতে পারে। আইন অনুযায়ী কোনো নির্বাচনের ফল যখন রিটার্নিং অফিসার আমাদের কাছে জমা দেন, তখন আমরা সেটার গেজেট প্রকাশ করি। সেটা না মানলে সংক্ষুব্ধ প্রার্থী লিখিত অভিযোগ দেবেন।
এ ছাড়া গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। এর বাইরে তখন আর নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার থাকে না। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনে একজন ব্যক্তিও নির্বাচন কমিশনে কিংবা আদালতে এ বিষয়ে অভিযোগ করেননি, কোনো প্রতিকার চাননি।
যদি কেউ অভিযোগ করত, আদালত যদি নির্দেশ দিত, তদন্ত হতো, হয়তো কিছু বেরিয়ে আসত, বেরিয়ে এলে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যেত। হয়তো সারা দেশে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যেত বা কিছু এলাকায় নির্বাচন বন্ধ হতো। এটা কেন তখন কোনো রাজনৈতিক দল অভিযোগ করেনি, পদক্ষেপ নেয়নি তারাই ভালো জানে।
এটা স্পষ্ট, বিএনপি কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারবে না জেনেই আদালতের দ্বারস্থ হয়নি। মৌখিক প্রোপাগান্ডার মাধ্যমেই এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার গোয়েবলসীয় ফর্মূলা বেছে নিয়েছে এই নব্য নাৎসী দল বিএনপি।
সহিংসতা ও নাশকতার নির্দেশসহ মওদুদ আহমেদ, বরকতউল্লাহ ভুলু, জয়নুল আবেদিন ফারুক প্রমুখ বিএনপির অনেক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়েছিল এ সময়। এমনকি নোয়াখালীতে বিএনপি নেতার কেন্দ্র দখলের উদ্দেশে নেতা-কর্মীদের নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণের ভিডিও পর্যন্ত দেখা গেছে।
তাই জাতির কাছে বিবেচনার ভার, বাংলাদেশের মানুষকে বারবার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করলো কারা? গণতন্ত্রের শত্রু নব্য নাৎসী বিএনপিকে প্রতিহত করা তাই জরুরি।